(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সবকিছু ভালোয় ভালোয় শেষ হলো। কোথাও কোন ঝামেলায় পড়লাম না, হলাম না হয়রানি। বিদেশের মাটিতে বিষয়টি যে কী পরিমাণ সুখকর তা বলে বুঝানো যাবে না। আমার সুখের আরো একটি বড় কারণ রয়েছে। এই কারণটি শুধুমাত্র অনুভবের। মেলবোর্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার মধ্য দিয়ে একেবারে নতুন একটি মহাদেশে পা রাখলাম আমি। নতুন দেশই কেবল নয়, অস্ট্রেলিয়া আমার জন্য নতুন মহাদেশও। আমার ভিতরে কেমন যেনো শিহরণ জাগছিল! পৃথিবীর প্রায় সবকটি মহাদেশেই পা পড়লো আমার!! আসলেই বিষয়টা সুখের, এই সুখ একটু অন্যরকমের। মফস্বল থেকে উঠে আসা চুনোপুটি একজন সাংবাদিক পৃথিবীর মহাদেশ থেকে মহাদেশে চক্কর মারছে! এতে শুধু বেড়ানোর আনন্দই নয়, অন্তরজোড়া তৃপ্তিও রয়েছে। অন্তরের এই শান্তির কথা লিখে বা বলে বুঝানো কঠিন, এটি পুরোপুরি উপলব্দির। আমি বিনয়াবনত চিত্তে আমার স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নোয়ালাম।
অস্ট্রেলিয়া ঘুরে দেখার বহুদিনকার একটি ইচ্ছেও আজ বাস্তবে ধরা দিল। স্বপ্ন সত্যি হওয়ায় আর দশজনের মতো আমারও খুশী লাগছিল। তাছাড়া নতুন কোন দেশে, নতুন কোন শহরে পা রাখার সাথে সাথে আমার ভিতরে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে শুরু করে। মেলবোর্নেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
অচেনা মেলবোর্ন শহর হয়তো রয়ে সয়ে চেনা যাবে, চেনা যাবে অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য শহরও। আপাততঃ দলের সাথে হোটেলে পৌঁছানো দরকার। ছত্রিশ ঘন্টারও বেশি সময় রাস্তায় কেটে গেছে, আকাশেও কেটেছে অন্তত আঠারঘন্টা। চীনের গুয়াংজু থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে হংকং, হংকং থেকে মেলবোর্ণ– এ যেনো এক ভিন্নরকমের বিমানযাত্রা!! বারো হাজার কিলোমিটারের এই আকাশপথ পাড়ি দিতে আনন্দের চেয়ে বেশি আছে বোকামি, হয়রানি এবং ভোগান্তি। অতএব নতুন মহাদেশের নয়া দেশের নতুন শহরে আগে হোটেল ধরি, পরে অন্য চিন্তা করা যাবে!
লায়ন্স ক্লাবের আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে যোগ দিতে আমাদের মেলবোর্ন আসা। ঢাকা চট্টগ্রামের ত্রিশ জনের মতো লায়ন সদস্যের একটি গ্রুপ আমরা মেলবোর্ন এসেছি। ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সি আমাদের অস্ট্রেলিয়ার ট্যুর প্ল্যান করার পাশাপাশি যাবতীয় আয়োজনও করে দিয়েছে। ট্যুর অপারেটর নিজেও লায়ন সদস্য। তিনিও আমাদের সাথে রয়েছেন। এতে করে ভ্রমনকালে কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে সমাধান মিলে যাবে। এই গ্রুপে আমরা চট্টগ্রামের চারজন রয়েছি। আমার বন্ধু লায়ন ফজলে করিম, ডালিয়া করিম এবং লায়ন বিজয় শেখর দাশসহ আমরা চারজন ঢাকার গ্রুপটির সাথে যুক্ত হয়েছি। আমাদের থাকা খাওয়া ঘোরাঘুরি থেকে শুরু করে সবকিছুরই দায়–দায়িত্ব এই ট্যুর অপারেটরের। শুধু শপিং কিংবা প্ল্যানের বাইরে কোথাও গেলে তার দায় নিজের।
বিমানবন্দর থেকে হোটেলে পৌঁছানোর জন্য ট্যুর অপারেটর সুন্দর একটি বাসের আয়োজন করে রেখেছে। বড় গ্রুপের জন্য বাসই ভালো। খরচ সাশ্রয় হয়, আরামও। বিমানবন্দরের সামনে থেকেই আমাদেরকে বাসে তোলা হলো। লাগেজ নিজেদেরকে ঠেলেঠুলে বাসের লাগেজ স্পেসে তুলতে হলো। ড্রাইভার একা মানুষ, বয়স্ক। তবে বেশ প্রানোচ্ছ্বল। তার কোন সহকারী নেই। তিনি নিজেই লাগেজ টানাটুনির চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু আমরা নিজেরা সবাই সবাইকে হেল্প করছিলাম।
বাস যাত্রা করলো, সবাই হুড়োহুড়ি করে সামনের দিকের সিটগুলোতে বসে পড়েছেন। আমরা চট্টগ্রামের চারজনকে পেছনের দিকের সিটে গিয়ে বসতে হলো। আমি এবং বিজয় শেখর দাশ পেছনে জানালা নিয়ে বসলাম। আমাদের দুইজনেরই পাশের সিট খালি। বাসের সিট বেশ প্রশস্ত, আরামদায়ক। হেলান দেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। বাসে ওয়াই–ফাই পাশাপাশি চার্জিং পোর্ট সবই রয়েছে। আমার মোবাইল রোমিং করা হলেও আমি বাসের ফ্রি ওয়াইফাই সেট করে নিলাম। বাসে বসে ভিডিও কলে দেশে কথা বলে ফেললাম। মেলবোর্নের রাস্তাঘাটও দেখিয়ে দিলাম। বিমাবন্দর থেকে শহরের দিকে যাত্রা শুরুর অল্পক্ষনের মধ্যেই আমার মনে হলো মেলবোর্ন অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং আধুনিক একটি শহর। এই শহর অবশ্যই ভালো লাগবে।
বিমানবন্দর আমাদের বাস টুলামারিন ফ্রিওয়ে ধরে এগুচ্ছিলো। মহাসড়কটি বেশ চওড়া। শুধু শহরের দিকে ছুটছে পাঁচ লেনে গাড়ি। ট্রাফিক প্রচুর, তবে যানজট নেই। নেই থেমে থাকা। রাস্তার কোথাও পুলিশ দেখলাম না, অথচ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না।
বিমাববন্দর থেকে শহরের দিকে যাচ্ছি। পথে কোথাও খোলা প্রান্তর, কোথাও গাছগাছালী, ঝোপঝাড়। কোথাও ভবন, দোকানপাট, পেট্রোল পাম্প (ওরা বলে গ্যাস স্টেশন), অফিস আদালত। শহরটি বেশ পরিচ্ছন্ন, গোছানো।
ফ্লেমিংটন নামের একটি এলাকায় ঢোকার সময় বাসের গতি বেশ কমে গেলো। জানালার পাশে তাকিয়ে দেখি ফ্লেমিংটন রেসকোর্স মাঠ। অস্ট্রেলিয়া ঘোড়ার জন্য বিখ্যাত। বেশ বড়সড় ঘোড়া রয়েছে তাদের– অস্ট্রেলিয়ান হর্স। এই মাঠে নাকি সেই বড় বড় ঘোড়াগুলোর দৌঁড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা ঘোড়দৌঁড় আজো বেশ যত্নের সাথে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এটাকে অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহ্য বলেও মনে করা হয়।
গাড়ি চলছিল। প্রচুর গাড়ি রাস্তায়। কিন্তু যানজট নেই। নিজের লেন ধরে এগুচ্ছে গাড়িগুলো। একেবারে গোছানোভাবেই সবকিছু চলছে। যেনো সব কিছু নিখুঁতভাবে কেউ একজন সাজিয়ে রেখেছে। অটো সিগন্যাল, গাড়ি থামছে, চলছে। কেউ হর্ন দিচ্ছে না, কেউ তাড়া দিচ্ছে না। ডানে বামে কেউ কাউকে ওভারটেক করছে না। সবচেয়ে ভালো লাগলো যে, রাস্তায় কোন হুড়োহুড়ি নেই, রিক্সা টেক্সি ভ্যান কিংবা মোটর সাইকেলের দৌরাত্ম নেই। একটি শান্ত শহর কেমন হয় তাই যেনো মেলবোর্ন জানান দিচ্ছিলো।
খেয়াল করে দেখলাম যে, এলাকাগুলোর প্রায় সবগুলো নামই ব্রিটিশ। ব্রিটিশেরা তাদের শাসনামলে যেসব নাম রাস্তাগুলোর দিয়ে গেছে সেগুলো তারা আর পরিবর্তন ঘটায়নি। ঐতিহ্য মনে করে লালন করছে।
আমরা ডকল্যান্ডস এলাকায় প্রবেশ করলাম। মেলবোর্ন শহরের দৃশ্যপট এখানে যেনো হঠাৎ করেই বদলে গেছে। চারদিকে গগনচুম্বী ভবন, কাচের দেয়াল, আধুনিক নির্মাণশৈলী–সবকিছু মিলে এক আলীশান শহর। বাস থেকেই দেখলাম মার্বেল স্টেডিয়াম। বিশাল স্টেডিয়ামটি নাকি অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল লীগের ঘাঁটি। পুরো এলাকায় অনেকগুলো ব্যাংক, অফিস আর নামী দামি রেস্টুরেন্ট, বার, ক্লাবে ঠাসা। কিছুটা দূরে দেখা গেল ইয়ারা নদী। এই নদীই নাকি মেলবোর্ন শহরের প্রাণ। ইয়ারাকে মেলবোর্নবাসী মায়ের মতো যত্ন করে, সন্তানের মতো পালন করে। তাই দূর থেকেও ইয়ারার স্বচ্চ পানি আমাকে যেনো হাতছানি দিচ্ছিলো, কিংবা স্বাগত জানাচ্ছিলো মেলবোর্ন শহরে।
রাস্তার একেবারে পাশ ঘেঁষে বাস পার্কিং করা হলো। বুঝতে পারলাম যে, গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। আমাদের ট্যুর অপারেটর জানালেন যে, আমাদের হোটেলে পৌঁছে গেছি। তিনি বাসের মাইকে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ধীরে সুস্থে নামুন। কোন হুড়োহুড়ি করবেন না। হোটেলের লবিতে গিয়ে অপেক্ষা করুন। আমি নাম ধরে ডেকে ডেকে সবাইকে রুমের চাবি দেবো। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে সাজানো আছে। আপনারা একটু সহযোগিতা করলেই সবকিছু সুন্দরভাবে সম্পন্ন হবে।
আমরা রয়ে সয়ে বাস থেকে নামলাম। হালকা একটি ঠান্ডা আমেজ আমার চোখে মুখে আদর বুলিয়ে দিলো।
আমাদের হোটেলটি স্পেন্সার এলাকায়। বেশ ব্যস্ত একটি এলাকা। অভিজাত এবং ঐতিহ্যে মোড়ানো। রাস্তার মাঝখান দিয়ে ট্রাম চলছে। সবুজ এবং সাদা রঙের দারুন কম্বিনেশন ট্রামের গতরজুড়ে। এটিই নাকি মেলবোর্নের প্রতীক!
চারদিকে কাঁচের ভবন, আধুনিক ডিজাইনের হোটেল, রেস্টুরেন্ট। আমাদের হোটেলটি বেশ সুন্দর। আমি এবং বিজয় শেখর দাশ একই রুমে উঠেছে। আমাদের রুম যথেষ্ট সুন্দর, গোছানো, পরিষ্কার এবং অবশ্যই আরামদায়ক।
রুমে ঢুকে টের পেলাম যে, লাগেজের তালা ঠিকঠাক থাকলেও আমি চাবি হারিয়ে ফেলেছি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও চাবির হদিশ মিললো না। তালা ভাঙ্গার চেষ্টা করলাম, তাও পারলাম না। বিজয় দা’ বুদ্ধি দিয়ে বললেন, ‘রিসিপশনে চলে যান। ওরা নিশ্চয় একটি ব্যবস্থা করতে পারবে।’ বিশাল ব্যাগটি নিয়ে আবার রিসিপশনে হাজির হলাম। অস্ট্রেলিয়ান এক তরুনী সেখানে। তিনি একাই সব কাজ করছিলেন। আমাদের এতোগুলো লোকের পাসপোর্ট জমা নিয়ে ফরম পূরণ করে চেকইন করা এবং রুমের চাবি বুঝিয়ে দেয়া পর্যন্ত সব কাজ তিনি করছিলেন। এখন আমার লাগেজ নিয়ে ফেরত আসা দেখে তিনি কি ভাবলেন কে জানে, তবে একটু হাসলেন। আমি চাবি হারিয়ে ফেলার কথা বলতেই তিনি আমাকে একটি বড়সড় লোহার কাঁচির মতো যন্ত্র দিলেন। ওটা দিয়ে তালাটি টুক করে ভেঙ্গে ফেললাম। মজা করে বললাম যে, আমি যে চাবি হারাবো তা কি আপনি জানতেন, একেবারে যন্ত্র নিয়ে বসে আছেন! তিনি হাসলেন, ‘বললেন, আপনার মতো দুয়েকজন চাবি হারানো পাবলিক প্রতিদিন এখানে আসে। তাদের জন্য এটা এখানে রাখা হয়েছে।’ যাক, নিজের দলে আরো লোকজন আছে জেনে শান্তি পেলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।