সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কয়েক বছর আগে। দেড় বছর ধরে শুধু টেন্ডার আহ্বানই চলছে। শর্ত শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও চট্টগ্রাম বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোড়াশালে বড় ধরনের একটি ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপো (আইসিডি) স্থাপনের টেন্ডারে সাড়া মিলছে না। একদিন আগে নতুন করে তৃতীয় দফায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। বছরে ১ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই আইসিডি দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের কন্টেনার পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও নির্মাতার অভাবে এটি এখন দুরাশায় পরিণত হচ্ছে। রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন কন্টেনার কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল) নতুন এই আইসিডি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে শুধু টেন্ডার আহ্বান করে চলেছে। দেশীয় কোম্পানি এককভাবে এবং বিদেশি কোম্পানি হলে দেশীয় কোম্পানির সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারে টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে বলে তৃতীয় দফার টেন্ডারেও উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য দেশীয় আইসিডিতে বিনিয়োগকারী একাধিক প্রতিষ্ঠান বলছে, যেভাবে সরকার আইসিডি নির্মাণের চেষ্টা করছে সেভাবে কোনোদিন হবে না। নির্মাণের শর্তে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।
সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের ২১টি বেসরকারি এবং কমলাপুর সরকারি আইসিডি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। রপ্তানি বাণিজ্যের শতভাগ কন্টেনার আইসিডিগুলোতে প্রস্তুত করে জাহাজিকরণের জন্য পাঠানো হয়। ৬৫ ধরনের আমদানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার আইসিডি থেকে খালাস করা হয়। আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের কর্মযজ্ঞের একটি বড় অংশ আইসিডিগুলোতে স্থানান্তরিত হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের গতি বহুলাংশে বেড়েছে।
ঢাকা অঞ্চলের কন্টেনার বাণিজ্যে গতি আনতে সরকার আশির দশকের শেষ দিকে কমলাপুর আইসিডি নির্মাণ করে। কিন্তু দীর্ঘদিনে কমলাপুর আইসিডির ওপর চাপ এত বেড়ে গেছে যে, ঢাকা অঞ্চলের চাহিদা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে ঢাকা অঞ্চলের মাত্র ৬ শতাংশ কন্টেনার কমলাপুর আইসিডি হ্যান্ডলিং করতে পারে। বাকি কন্টেনার সড়কপথে চট্টগ্রাম থেকে হ্যান্ডলিং হচ্ছে; যা কাজের গতি কমানোর পাশাপাশি ঢাকা– চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার গাজীপুরের ধীরাশ্রমে ২২২ একর জমিতে একটি আইসিডি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। চীন সরকার এই প্রকল্পটির ব্যাপারে শুরুতে আগ্রহ দেখালেও পরে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার পর আইসিডি নিয়ে বেশিদূর এগোয়নি। এছাড়া ধীরাশ্রমে আইসিডি নির্মাণ করতে হলে ২৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এতে আড়াই হাজার কোটির বেশি টাকা ব্যয় হতো শুধু ভূমি অধিগ্রহণ খাতে। তাই প্রকল্পটি নিয়ে সরকার আর বেশিদূর অগ্রসর হয়নি।
এ অবস্থায় বছর কয়েক আগে সরকার রেল মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সিসিবিএলের মাধ্যমে ঘোড়াশালে রেলওয়ের নিজস্ব জায়গায় একটি আইসিডি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ঘোড়াশাল পৌরসভার ঘোড়াশাল রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন চামড়াবো থেকে ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত ২০ একর জায়গায় ঘোড়াশাল ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপো স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এই আইসিডি স্থাপনে সরকার কোনো অর্থ বিনিয়োগ করবে না। পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। সরকার শুধু ভূমির সংস্থান করবে। আইসিডির ডিজাইন, নির্মাণ, অর্থায়ন, পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেয়াদ শেষে সিসিবিএলকে হস্তান্তর করার (ডিবিএফওএমটি) শর্তে আইসিডিটি নির্মিত হবে। নির্মাণের পর থেকে ৩০ বছর আইসিডি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকলেও পরে তা সিসিবিএলকে হস্তান্তর করে যেতে হবে।
গত বছরের ১০ জানুয়ারি ঘোড়াশাল আইসিডি স্থাপনের জন্য প্রথম টেন্ডার আহ্বান করা হয়। কিন্তু প্রথম টেন্ডারে ১৪টি টেন্ডার ডকুমেন্টস বিক্রি হলেও একটি দরপত্রও জমা পড়েনি। বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফায় উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। প্রায় এক বছর পর টেন্ডারের শর্ত শিথিল করে দ্বিতীয় দফায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এতেও তেমন সাড়া মিলেনি। প্রায় আট মাস পর ওই টেন্ডার বাতিল করে গত ২১ জুলাই নতুন করে তৃতীয় দফায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এতে করে গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে কেবল টেন্ডারই আহ্বান করা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সিসিবিএলের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা গতকাল আজাদীকে বলেন, প্রথম টেন্ডারে কেউ অংশ না নেওয়ায় দ্বিতীয় দফা টেন্ডার আহ্বান করা হয়। তাতেও সাড়া না পাওয়ায় আমরা তৃতীয় দফায় টেন্ডার আহ্বান করেছি। কিছু প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখালেও কেন যে টেন্ডারে অংশ নিচ্ছে না তা বুঝতে পারছি না। তবে বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই সজাগ রয়েছি।
এ ব্যাপারে দেশের বেসরকারি আইসিডি খাতে বিনিয়োগকারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, টেন্ডারের শর্ত এবং জায়গাটির অবস্থানের কারণে ওখানে কেউ ইনভেস্ট করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। জায়গাটি নিচু। বিশ থেকে চল্লিশ ফুট পর্যন্ত মাটি ভরাট করতে হতে পারে। অনেকগুলো পুকুর রয়েছে। যেগুলোতে পাইলিং করে ইয়ার্ড নির্মাণ করতে হবে। নরম্যালি আমরা ইয়ার্ডে ১২ ইঞ্চি আরসিসি ঢালাই দিই, ওখানে দিতে হবে ২৪ ইঞ্চি। সচরাচর আমাদের ১১শ টাকার স্থলে ওখানে ২২শ টাকা প্রতি বর্গফুটে নির্মাণ খরচ হবে। এত বিপুল বিনিয়োগের পর যদি ২৫/৩০ বছর পর ডিপো ছেড়ে দিয়ে আসতে হয় তাহলে রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট ওঠানো সম্ভব হবে না। তাই কমপক্ষে ৫০ থেকে ৭৫ বছরের জন্য ডিপো পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে। অন্যথায় খরচ ওঠার সময় দেখা যাবে আপনি আর সেখানে নেই। তাই কেউ এই আইসিডি নির্মাণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না।