যে-জীবন কবিতার

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ২২ জুলাই, ২০২৫ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

বেনেদেত্তো ক্রোস ছিলেন একজন ইতালীয় আদর্শবাদী দার্শনিক, ইতিহাসবিদ এবং রাজনীতিবিদ; যিনি দর্শন, ইতিহাস এবং নন্দনতত্ত্বসহ অসংখ্য বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। এক কথায় নন্দনতত্ত্ববিদ। তাঁর মতে, সমস্ত মানবজাতির মাতৃভাষাই হলো কাব্য। আদি মানবেরা সকলেই প্রকৃতিপ্রদত্ত শক্তিতে বড় কবি ছিলেন।

সাম্প্রতিক সাহিত্য, যা শিল্পেরই একটি শাখা। যার আদি উৎস দর্শন। তাই দর্শনবোধ ব্যতীত কোনো মহৎ সাহিত্য রচিত হয় না। আমরা যে কোনো মহান সাহিত্যিক এবং তাঁদের সৃষ্টিকর্ম বিশ্লেষণ করে সামনের দিকে এগোতে পারি। কখনও প্রেম, কখনও বিপ্লব, কখনও জীবনের রূঢ় দর্শনবোধ খুঁজে পাবো এই মহান সাহিত্যিকদের রচনায়।

কবি হোসাইন কবির। সমকালীন বাংলা কবিতায় উজ্জ্বল নাম। গত শতকের আশির দশকের এক মনস্বী কবি। সম্প্রতি খড়িমাটি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘নির্বাচিত কবিতা’ গ্রন্থ। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কবির ৬টি বইয়ের নির্বাচিত কবিতাগুলো। বইগুলো হলো: ‘জলের কল্লোল বৃক্ষের ক্রন্দন’ (১৯৯৭) ‘ও মাটি ও শূন্যতা’ (২০০৪), ‘সাঁকোর নিচে শান্তজল’ (২০১৪), ‘নিঃসঙ্গ পাতার বাঁশি’ (২০২০), ‘ডাহুক এখনো ডাকে’ (২০২২) এবং ‘অগ্নিজলে সুগন্ধশরীর’ (২০২৫)। আমি তাঁর গ্রন্থ আলোচনায় যাবো না। কেবল অভিনন্দন জানাবো তাঁর এমন প্রয়াসের জন্য। প্রশংসাকৃপণ সমাজে কেবল তাঁকে জানিয়ে দেওয়াআপনার সুন্দর সৃষ্টিকর্মের সহযাত্রী আমরাও, পাঠক হিসেবে। কোনোরকম ভাবালুতা দিয়ে নয়, পরতে পরতে শব্দের মালা গেঁথে যুক্তির পসরা সাজিয়ে তিনি দাঁড় করিয়েছেন নিজের কবিতাদর্শন। আমাদের ধারণা, হোসাইন কবিরের কবিতার প্রধানতম দিক হলো দর্শন। যদিও গ্রন্থের ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে, ‘চিত্রকল্পের অপূর্ব শৈলী আর দার্শনিক গভীরতায় কবি হোসাইন কবির স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর’। তবে কেউ কেউ বলতে পারেন, আমরা কবিতা পড়বো কবিতার সৌন্দর্যের জন্য, দর্শনের জন্য নয়। তাদের উদ্দেশে এটা বলা সমীচীন যে, হোসাইন কবিরের কবিতায় সৌন্দর্যও আছে, দর্শনও আছে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, ‘কবিতাই প্রথমে এসেছে, তারপরে দর্শন। কিন্তু কবিতা দর্শনকে খুঁজেছে, যদিও দু’য়ের মধ্যে ব্যবধান বিস্তরজন্মসময়গত যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি চরিত্রগত। কবিতার তথা সাহিত্যের উপজীব্য হচ্ছে বিশেষ, দর্শনের নির্বিশেষ; তাদের অবলম্বন ভিন্ন ভিন্ন; সাহিত্য বিশ্বাস করে সংশ্লেষণে, দর্শন বিশ্লেষণে। তবু সাহিত্যের এই দর্শনানুসন্ধান অপরিহার্য। কেননা মানুষের বিশেষ অনুভূতিগুলোর প্রবণতা থাকে নির্বিশেষ সরলীকরণের দিকে; সব সময়ই তাই দেখা যায় তারা কোনো জ্ঞানের অভিমুখে যেতে চাইছে। অন্যদিকে আবার দর্শন যদিও বিশ্লেষণধর্মী ও চিন্তানির্ভর, তথাপি দর্শন বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের মতো খণ্ড খণ্ড করে অবলোকন করে না সে জীবন ও জগৎকে সংলগ্ন ও ঐক্যবদ্ধ করতে চায়, অনেক সময় আকাঙ্ক্ষা রাখে সমগ্রকে ব্যাখ্যা করবে একক কোনো মানদণ্ডে। তবে সত্য থাকে এটা যে, দর্শনের তবু সাহিত্যকে বাদ দিলে চলে, কিন্তু সাহিত্যের কখনোই চলতে পারে না দর্শনকে বাদ দিয়ে।’

হোসাইন কবিরের কবিতাগুলোতে এমন কিছু দিকের শৈল্পিক প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়েছে, যা কবিতাগুলোকে দর্শনশিল্পের উচ্চ আসনে নিয়ে গেছে। তার সঙ্গে আরো যুক্ত হয়েছে অপরূপকথার কল্পচিত্রিক মায়াজাল। তিনি অবলীলায় উচ্চারণ করেন :

পথ গেছে চৌরাস্তায়

যেখানে মানুষ লাল নীল সবুজ হলুদ

বাতি হয়ে জ্বলে আর নিভে

ভাবি একদিন

পথ ও মানুষ অগ্নিজলে একাকার হবে

জন্মমৃত্যুর পরম্পরা ভুলে

ধূপধুনায় পোড়াবে সুগন্ধশরীর

কবিতায় গভীর জীবনবোধের সুস্পষ্ট দর্শন ফুটে উঠেছে। কবি তাঁর কবিতায় তাঁর অন্তঃস্থিত বোধ, প্রেম ও ব্যক্তিসত্তাকে তুলে ধরেছেন। নানা পংক্তিতে ব্যক্ত হয়েছে তাঁর জীবনের গভীরতম বোধের উপলব্ধির নির্যাস। যা পড়ে পাঠক হৃদয় জাগ্রত হয় প্রাপ্তির গভীরতায়।

আমাদের জীবন তো বিস্মৃতিময়। স্মৃতির আড়ালে লুকায়িত থাকে বেদনার গান। এসব উপভোগের জন্য কেবল উপলব্ধি করতে হয়। জীবন নানারঙে বিন্যস্ত। কত সহজেই অচেনা হয়ে যায় পরিচিত মুখ। পাল্টে যায় দৃশ্য। সহজেই ধরা পড়ে যাচ্ছে পরিবর্তনগুলো। লীন হয়ে যাচ্ছে পটভূমিগুলো। হোসাইন কবির লিখেন ‘এ কোন্‌ বাংলাদেশ। বলেন :

বাংলাদেশ,

আমরা তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, আলোর ভুবন থেকে

উদার প্রাঙ্গণ থেকে অনেক দূরে, অসহায় করুণ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছো।

বাংলাদেশ,

তুমিও আজ আমাদের মত বড্ড অসহায়।

শিক্ষক শ্যামল কান্তি হয়ে তুমি! হ্যাঁ তুমিই গিয়েছিলে কারাগারে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ,

তোমার চেতনার আলখেল্লায় মুখোশ পরাদের ভিড়ে আজ আর

তোমাকে চেনা যায় না, বড্ড বেমানান তুমি।

বাংলাদেশ,

এ কোন্‌ আঁধারে কৃষ্ণপক্ষে হারিয়ে যাচ্ছো তুমি

অনমনীয় দানবীয় সামপ্রদায়িক শক্তির কাছে তোমার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ

আমরা মানি না, মেনে নিতে কষ্ট হয় ভীষণ।

বাংলাদেশ,

তবে কী তোমার বায়ান্ন, ঊনসত্তর, ৭মার্চের অমোঘ বজ্র নিনাদ, মুক্তিযুদ্ধ, মাবোনের সম্ভ্রম, লাখো শহীদের আত্মদান, বঙ্গবন্ধু, পঁচাত্তরের ঘোর অমানিশা ইতিহাসের কালো অধ্যায় আজ কী কেবলই মলিন পাণ্ডুলিপি।

বাংলাদেশ,

তবে কী তুমিও আজ হাতেপায়ে শেকল পরা মৃত এক কয়েদি!

কালো কাপড়ে মোড়ানো একটি কফিন!

বাংলাদেশ,

এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়বলো?”

আসলে হোসাইন কবির এমন সব বিষয়ের অবতারণা করেছেন, জীবনের এ দুঃসময়ে হতাশায় নুয়ে পড়ে মন, কেবল ভাসছে প্রশ্ন আর প্রশ্ন। এসব চিন্তায় অস্থির মনোরাজ্য। আর ভেবে ভেবে ক্রমশ ভারাক্রান্ত হচ্ছে শিল্পাঙ্গন। শিল্পসাহিত্যের বোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশের প্রতি মায়াসব ক্ষেত্রে আমাদের দায়বদ্ধতা বাড়ায়। দুঃখকষ্ট, যুদ্ধ আর প্রতিহিংসার পৃথিবীতে একটু শান্তি আর মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলবার প্রত্যয়ে বাড়িয়ে দিতে হয় হাত শিল্পের। হোসাইন কবিরের মতো আমাদেরও মুক্তবুদ্ধি ও মানবিকতার চর্চায় মনোযোগী হওয়া উচিত।

কবিতা কখন শিল্প হয়ে ওঠে? যখন ভাষা, উপমা, শব্দ ইত্যাদির ব্যবহার হয় শিল্পসম্মত, শিল্পের জন্য। এবং তার ওপর নির্ভর করছে একটি কবিতার সৌন্দর্য। যখন হোসাইন কবির বলেন :

পাঁজরে রাখবো হাত

অন্ধকারে ধু ধু মাঠে প্রান্তরেখায়

মাটির মূর্তির অগ্নিবালক অস্তিত্বে আমার

ছুঁয়ে দেখ

এই হাতে শত আলোকবর্ষের কোমল পরশ

আদি নারী ইভের দোহাই

পালঙ্কে সরিয়ে রাখো ঘুমরাত

অরণ্যবাসর পাললিক ডানা

বিদ্রূপের হাসি নয়

কান পেতে শোন

ধমনীতে ক্রন্দন অগ্নিবৃষ্টির

আর বুকে বাজে সুর প্রত্ন দোহার’

তখন কৌতূহলী হয়ে ওঠে পঞ্চেন্দ্রিয়। এমন কাব্যিক ব্যঞ্জনায় অসামান্য প্রকাশের নামই তো শিল্প। হোসাইন কবিরের ভাবনা খুবই গভীর। তাঁর কবিতাগুলো আমাদের ভাবায়। নানা কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন :

গ্রামগুলো শহর হলেপাখিরা যাবে কোথায়!’

সিঁড়িতে পা রাখতেই রক্তস্রোতে ভেসে যাই, ডুবে যাই।’

জীবন তো এমনইযেতে যেতে নিজের কাছে নিজেকে মলিন পরিত্যক্ত মনে হয়।’

কোথাও মৃত্তিকা নেই, ফুল পাখি নারী

লাল রঙ পাথর হয়ে জ্বলছে..মৃত্তিকার সংসারে।’

কে তুমি!

পেছন থেকে সম্মুখে এসে দাঁড়াও

সেই স্বপ্নমুখর একুশ পেরুনো বয়সন্ধি সীমায়!

আজো না হয় একবার পরখ করি রাতের মেঘ হয়ে উড়ন্ত আকাশে

আর পোড়াই অসমাপ্ত প্রহর নৈকট্য যাবতীয় নামাবলি’

প্রতিটি পঙ্‌ক্তি সুন্দর, আঁটোসাটো ও স্মার্ট। এতে প্রতিফলিত হয়েছে কবির চিন্তনের অভিব্যক্তি, যে চিন্তা কখনও বোধগম্য, আবার কখনও ব্যাখ্যারও অতীত। কবির ভাবনার সঙ্গে পাঠকের ভাবনার মেলবন্ধন হয়, আর না হলেও সমস্যা নেই।

হোসাইন কবির একজন শিক্ষাবিদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক। চিন্তক। দুটো প্রবন্ধের বইও আছে তাঁর। তবু তিনি আপাদমস্তক কবিতারই মানুষ। কবিতার জন্য যাপন করছেন জীবন। আমরা তাঁর সাফল্য কামনা করি। কবিতার জন্য ব্যয় হোক একটা জীবন।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো, বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসড়কে অব্যবস্থাপনা : থামানো যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল
পরবর্তী নিবন্ধইয়ামালের ১০ নম্বর জার্সি নিয়ে কাড়াকাড়ি