বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আমরা মর্মাহত। আমাদের শোক প্রকাশের ভাষা নেই। জাতীয় জীবনে এ এক বড় ট্র্যাজেডির দিন ছিল গতকাল। এ পর্যন্ত ২০ জনের অধিক নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় বলেন, ‘বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় আমি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। এই দুর্ঘটনায় বিমানসেনা ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক–কর্মচারীসহ অন্যান্যদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। জাতির জন্য এটি একটি গভীর বেদনার ক্ষণ।’ তিনি আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা এবং সংশ্লিষ্ট হাসপাতালসহ সকল কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশ দেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকার দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করবে।
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় আজ মঙ্গলবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় শোক উপলক্ষ্যে দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পাশাপাশি সব সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।
জানা যায়, গতকাল বেলা ১টার পর স্কুল ভবনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে বিমানটি উড্ডয়ন করে। পরে বিধ্বস্ত হয়। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে মাইলস্টোনের দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের সময় ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, ‘বিমানবাহিনীর একটি এফ–সেভেন বিজেআই ফাইটার এয়ারক্র্যাফট আমাদের মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তরা শাখার দোতলা স্কুল ভবনে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করেছে। এই দোতলা ভবনের প্রথম তলায় ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বাচ্চাদের ক্লাস। দ্বিতীয় তলায় ছিল দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস। তার সাথে ছিল প্রিন্সিপালের (অধ্যক্ষের) অফিস মিটিং রুম। একটা কোচিংয়ের ক্লাস চলমান ছিল। ক্র্যাশ ল্যান্ডিং যখন হয়, তখন স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল এবং ওই সময় যে জায়গায় টিচার্স রুমের সাথে যে ল্যান্ডিং হয় ,আঘাত করে, ওই জায়গায় বাচ্চাকাচ্চারা জড়ো হয়েছিল এবং তাদের সাথে হয়তো কিছু অভিভাবকও ছিল।’
বিশ্লেষকরা বলেন, যুদ্ধবিমানগুলো সবচেয়ে উন্নত এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। এফ–৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমানটি উড্ডয়নের মাত্র ১২ মিনিটের মধ্যে ভেঙে পড়া শুধু প্রযুক্তিগত ত্রুটির ব্যর্থতা নয়, বরং রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ এবং দুর্যোগ মোকাবিলা পরিকল্পনার সামগ্রিক দুর্বলতার প্রতিফলন। এই ঘটনায় দেখা গেছে, দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস ও জরুরি সেবার ধীরগতি। স্কুল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ ছিল না এবং প্রাথমিক চিকিৎসা ও উদ্ধার সমন্বয় ছিল দুর্বল। এক্ষেত্রে অবশ্য গণমাধ্যমকর্মী, উৎসুক জনতা, অতিউৎসাহী ইউটিউবারদের ভিড়ে অভিভাবকগণ, প্রশাসনের লোকজন এবং উদ্ধারকর্মীরা তাদের স্বীয় দায়িত্ব পালনে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বিশাল। কিন্তু যেকোনো দুর্ঘটনার পর পরিষ্কার বোঝা যায়, এর প্রভাব মাঠপর্যায়ে অতি সামান্যই। যার মূল কারণগুলো হলো দুর্নীতি ও অদক্ষতা, বরাদ্দ অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার না হওয়া। অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, উদ্ধারকর্মীদের দক্ষতা কম এবং আধুনিক সরঞ্জামের অভাব। প্রতিরোধমূলক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি, দুর্ঘটনা ঘটার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অভ্যাস নেই। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে রাজনৈতিকীকরণ এবং দলীয় স্বার্থ জড়িত।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘বাংলাদেশের দুর্ঘটনার ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে যে, সাধারণ জনগণই প্রথমে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রানা প্লাজার ধসে হাজারও মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নিয়েছে। চকবাজার বা বঙ্গবাজারে স্থানীয়রা নিজেরা পানি ও বালি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অক্ষমতা জনগণকে অনেক সময় অসহায় করে তোলে।’
কিছু কিছু দুর্ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। তেমনি এক দুর্ঘটনা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা। আমরা এধরনের দুর্ঘটনার পরিসমাপ্তি চাই। থাকুক সতর্কতা, থাকুক নিরাপত্তা।