আমাদের জীবনে এমন কিছু লেখা আসে, যা শুধু পাঠ্য নয় সঙ্গী হয়ে ওঠে। সাঈদ বারীর লেখা ‘যাপিত জীবন’ ঠিক তেমনই একটি বই। শুধু ‘বই’ বললে কম বলা হয় এটা যেন প্রতিদিনের জীবনযাপনের ভেতর থেকে উঠে আসা হাসি–কান্না–রাগ–অনুরাগের এক অভিজ্ঞান, যা পড়ে মনে হয় ‘আরে! এই তো আমার ঘরের কথাই!’
‘যাপিত জীবন’ এক নিছক রম্যসাহিত্য নয় এটি এক রকম জীবন–নথি, যেখানে হাস্যরসের আবরণে লুকিয়ে আছে আমাদের সংসার–সংস্কৃতির ভেতরের টানাপোড়েন, মায়া–মমতা, এবং নিত্যদিনের সহনীয় অস্বস্তিগুলোর সৎ ও সরল প্রকাশ।
লেখাগুলোর জন্ম ফেসবুকে, বৈশ্বিক মহামারি কোভিড–১৯ এর নিঃসঙ্গ, নিস্তব্ধ সময়ে। অথচ সেই গৃহবন্দিত্ব থেকে উঠে এসেছে এমনসব দাম্পত্য কথোপকথন, ছোটখাটো ভুল–বোঝাবুঝি, সন্তানের আচরণ বা বাজারে পালংশাক না পাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব যা আমাদের সবার জীবনেরই অংশ।
লেখকের কলমে সেই ঘটনাগুলো হয়ে উঠেছে পরিচিত অথচ নতুন, ব্যক্তিগত অথচ সর্বজনীন। বারী ভাইয়ের সহধর্মিণী জেসমীন ভাবী, এবং তাঁদের দুই ছেলে বুবান ও পাপান এই চার সদস্যের ঘরের ভেতরের হাস্যরসে পাঠক নিজের ঘরের প্রতিফলন খুঁজে পান। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ বা ‘বয়েস’ অধ্যায়গুলোর হালকা কৌতুক, আবার ‘টুথব্রাশ’ কিংবা ‘জন্মদিন’ পর্বের দাম্পত্য সংবেদন সবকিছু মিলিয়ে বইটি এক অনন্য পাঠ–অভিজ্ঞতা। ‘জেসমীন’ শুধু এক চরিত্র না তিনি যেন প্রতিটি সংসারের স্বর, অভিমান, প্রশ্ন আর ভালোবাসার প্রতিনিধি। বুবান আর পাপান যেন সেই দুই ছায়া, যাদের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের ছেলে–বেলার কিংবা পিতৃত্ব–মাতৃত্বের মুখ দেখি।
‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ বা ‘ফুলচার্জড’ পড়ে যেমন চোখে জল–হাসি মেশানো অনুভব হয়, তেমনি ‘জন্মদিন ভুলে যাওয়া’ বা ‘টুথব্রাশ’ অধ্যায় আমাদের শিখিয়ে দেয় সংসার মানেই শুধু হিসেবের খাতা নয়, এটা অনুভবের সাহিত্যে পরিণত হতে পারে, যদি তা হৃদয় দিয়ে দেখা যায়।
রিভিউকার হিসেবে নয়, একজন দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী ও বন্ধুবর হিসেবে আমি জানি, বারী ভাইয়ের পর্যবেক্ষণশক্তি এবং মমতার দৃষ্টি কত গভীর। তিনি যেভাবে প্রতিদিনের ‘খুনসুটি’কে সাহিত্যের ভাষায় রূপ দেন, তাতে পাঠক শুধু মুগ্ধ হন না তাঁদের নিজস্ব জীবনও নতুনভাবে ভাবতে শেখেন।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বইটির শেষ দুটি পরিশিষ্ট যেখানে প্রেম এবং সম্পর্কের অসমাপ্ত অধ্যায় উঠে এসেছে এক অনির্বচনীয় আবেগে। সেখানেই বোঝা যায়, বারী ভাই শুধু হাসাতে জানেন না কাঁদাতেও পারেন, এবং সেটা চিৎকারে নয়, নিঃশব্দে। সম্পর্কের জটিলতা, অতীতকে না ভুলতে পারা, স্মৃতি আর স্বপ্ন সব একসঙ্গে মিশে এক মানবিক পাঠ্য হয়ে ওঠে।
কেন এই বই পড়া উচিত?
এই বই যেমন একটি আত্মজৈবনিক রম্য সংকলন, তেমনি এটি হয়ে উঠতে পারে আমাদের ঘরের আয়না। বারী ভাইয়ের লেখার সহজতা, পর্যবেক্ষণের সূক্ষ্মতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি মিলে এই বই হয়ে উঠেছে চলমান সময়ের অন্যতম প্রাসঙ্গিক সাহিত্যকর্ম। সংসার নিয়ে যাঁরা হাসতে জানেন, কাঁদতেও জানেন তাঁদের জন্য এই বই এক আবশ্যিক পাঠ। কারণ আপনি হাসতে ভুলে গেছেন। কারণ আপনি সংসার নামক ‘নির্বান্ধব প্রতিষ্ঠান’ টিকে আবার মানবিক করে দেখতে চান। কারণ আপনি জানেন, কথায়–কথায় যে ভালোবাসা, তা–ই সবচেয়ে সত্য।
লেখক: প্রবান্ধিক ও কলামিস্ট।