গত বছর (২০২৪ সাল) ঈদ উল আযহার সময় আমি অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড এর রকহ্যাম্পটন (ব্রীজবেন থেকে ৬৩০ কিঃ মিঃ উত্তরে) শহরে ছিলাম। অস্ট্রেলিয়াতে সাধারণত কোরবানীর দিন ২/৩ জন গিয়ে অথবা অন–লাইনে কোরবানী বুকিং করা হয় এবং মাংস ২/৩ দিন পর কুরিয়ার এর মাধ্যমে অথবা কাছে হলে প্রতিনিধি গিয়ে নিয়ে আসে। সে বার রকহ্যাম্পটন থেকে কাছে ২০ কিঃ মিঃ দূরে গ্রেইসমেয়ার (ছোট উপ শহর) এ গরুর খামার থাকায় রকহ্যাম্পটন এ বসবাসরত বাংলাদেশ কমিউনিটি ঈদের দিন কয়েক জন মিলে ৩ টা গরু কোরবানী দিয়ে আসে। গরুর খামার কর্তৃপক্ষ কোরবানীর পর মাংসগুলো কাটার জন্য (যেহেতু আমাদের দেশের মত ওদের সাহায্য করার জন্য এত মানুষ নেই) প্রথমে ফ্রোজেন করে পরে বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী সাইজ করে ক্রেতা বা কোরবানী দানকারীদের ডেলিভারী দেয়।
যাই হোক কোরবানীর পর এ সপ্তাহের শুক্রবার (২১ শে জুন, ২০২৪) বাংলাদেশ কমিউনিটি আমি সহ আরও দুজন কে গরুর খামার থেকে মাংস আনার জন্য দায়িত্ব দেয়। শুক্রবার বিকাল ২.৪৫ এ আমরা ৩টা কার নিয়ে আমাদের মিটিং পয়েন্ট রকহ্যাম্পউন মসজিদ থেকে গ্রেইসমেয়ার এর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। রকহ্যাম্পটন থেকে গ্রেইসমেয়ার গরুর খামার পর্যন্ত দূরত্ব আনুমানিক ২২ কি. মি.। এর মধ্যে ১২ কি. মি. রাস্তা হাইওয়ে যেখানে গাড়ির গতিসীমা ঘণ্টায় ১০০ কি. মি.। শুরু এবং শেষের ১০ কি. মি. ঘণ্টায় ৬০ কি. মি.। এখানে উল্লেখ্য শুক্রবার সকাল থেকে জুমার নামাজের আগে পর্যন্ত নানাবিধ কাজে ব্যস্ত ছিলাম এবং নামাজের পর দুপুরের খাওয়ার পরপরই মাংস আনার জন্য রওনা দিতে হয়। তাই গাড়ি চালানো শুরু করার পর একটু ঘুম আসছে বলে মনে হচ্ছিল। তারপরেও হাইওয়ের ১২ কি. মি. অংশ ঘণ্টায় ১০০ কি. মি. বেগে চালিয়ে আনুমানিক ৮ মিনিট পর গ্রেইসমেয়ার রাউন্ড এবাউট পৌঁছায় এবং সেখান থেকে গরুর খামার এর দূরত্ব আনুমানিক ৬ কি. মি. রাস্তার কিছু অংশ গ্রাভেল রোড এবং গতিসীমা ঘণ্টায় ৬০ কি. মি.। এই রোডে প্রবেশ করে ২ কি. মি. মত পথ অতিক্রম করার পর দেখলাম আমার ঘুম চলে আসছে এবং মনে হচ্ছে একটু ঘুমাতে পারলে ভাল হতো। আর একবার ভাবলাম খামার তো মাত্র ৪ কি. মি. দূরে, ওখানে পৌঁছাতে ৪/৫ মিনিট হয়ত লাগবে। শাখা রাস্তা হওয়ায় রাস্তাটি তুলনামূলকভাবে নির্জন। ঘুম চোখে ৫০ মিটার মতো যাওয়ার পর হঠাৎ করে চোখের পলকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায় (পরবর্তীতে জানতে পারি এটা কে মাইক্রো স্লিপ বলে) এবং মাথা কাথ হয়ে কাঁধের সাথে ধাক্কা খায় (বসা অবস্থায় ঘুম আসলে যে রকম হয়)। সাথে সাথে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল ঘুরে গিয়ে গাড়ি সহ জঙ্গলের মতো জায়গায় পড়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য জঙ্গল (বনাঞ্চল) রোড এর সাথে একই লেভেলে কিন্তু ছোট খাট গর্ত আছে তাই গাড়ি রাস্তা থেকে জঙ্গলে প্রবেশ করার সাথে সাথে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খায় (জঙ্গলের খানা খন্দকের কারণে) এবং সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙে যায় কিন্তু তখনো আমার মাথায় পুরোপুরি আসছে না আমি জঙ্গলের ভিতর কেন? গাড়ি তখনো চলমান এবং লক্ষ্য করলাম গাড়ি সামনের ঘাসগুলো মাড়িয়ে একই বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার স্টিয়ারিং এ তখনো কন্ট্রোলে আসেনি এবং অবাক হয়ে দেখলাম ঘুরানো স্টিয়ারিং এ কার, বৃত্তের পরিধির মতো পথে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় বড় বড় দু’পাশের দুটি গাছ কে মাঝ বরাবর রেখে চলে যায়। এরপর আমার স্টিয়ারিং এ কন্ট্রোলে আসে, মানে আমার ঘুম পুরোটা কেটে যায় এবং তৎক্ষণাৎ ব্রেক ধরি এর ফলে একটু দূর গিয়ে গাড়ি থেমে যায়। গাড়ি থামার আগে আরো দুটি গাছ ক্রস করি। দুটো গাছের মাঝখানের দূরত্ব কম থাকায় ডান পাশের লুকিং গ্লাসে ধাক্কা লাগে এবং লুকিং গ্লাস ভেঙে যায়। থামার পর লক্ষ্য করলাম চারিপাশে লম্বা ঘাস (কাশ ফুলের মতো লম্বা) এর মাঝে গাড়ির ভিতর আমি একা। পুরো ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে (চোখের পলকেই ঘটেছে) তখনো পুরাপুরি বুঝছি না কী হলো। শেষে দরজা খুলে বের হলাম এবং নিজেকে গাড়িসহ জঙ্গলের মাঝে আবিস্কার করলাম। পুরো ঘটনায় এখন মনে হয় একটা সিনেমার মত।
পর মুহূর্তে দেখলাম, মেইন রাস্তা থেকে আমি বনের মধ্যে প্রায় ৫০ মিটার মতো দূরত্ব চলে আসি এবং তাকিয়ে দেখি আমার সাথে যে দুটো গাড়ি আগে গিয়েছিল, তাদের একটি গাড়ি ব্যাক দিয়ে মেইন সড়কে আসলো আমার খোঁজে। উনি নাকি বেশ কিছুক্ষণ পিছনে আমাকে না দেখে ভাবল আমি ভুল রাস্তায় চলে গেছি কি না। আমি হাত উপড়ে তোলার পর উনি বলল, আমি ঠিক আছি কি না। আমি বললাম ভাই, ঠিক আছি।
এরপর গাড়িটা ড্রাইভ করে রাস্তায় আনলাম এবং গরুর খামারে যাই। গরুর খামারওয়ালা ঘটনা শুনে আমাকে একটা কোক খেতে দেয় এবং বললো, ঘুম আসছে মনে হলে কখনো গাড়ি ড্রাইভ যেন না করি। বাসায় এসে তখনো আমার শরীর কাঁপছে। আমার কাছে পুরো ঘটনা টা মিরাকল মনে হল এবং মহান আল্লাহ্ হয়তো আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। বাংলাদেশে এ যে রাতের শেষ প্রহরে, ভোরে কিংবা দিনের বেলায় অনেক গুলো সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ এই মাইক্রো স্লিপ বা হঠাৎ ঘুম পাওয়া। এই ঘুম বা ঝিমুনি ৫/১০ মিনিট স্থায়ী হয় কিন্তু ড্রাইভার/প্যাসেঞ্জারদের অমূল্য জীবন কেড়ে নেয়। এখানে বলে রাখা ভালো মাইক্রো স্লিপ, টায়ার্ডনেস কিংবা দীর্ঘক্ষণ বিরতিহীন গাড়ি চালালে অথবা খাওয়া–দাওয়া করার পরপর গাড়ি চালালে অথবা রাতে ঘুম কম হলে কিংবা মানসিক অবসাদ থেকেও আসতে পারে।
তাই পাঠকবৃন্দ আমরা যারা সব সময় যাতায়াত করি, নিজে ড্রাইভ করবেন তারা যেন মাইক্রো স্লিপ সম্পর্কে সচেতন থাকি এবং ড্রাইভারদের এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরী করি। ড্রাইভিং এ মাইক্রো স্লিপ একটা মারাত্মক ঝুঁকি তৈরী করে এবং মানুষের অমূল্য সম্পদ প্রাণ বিপন্ন হয়।
লেখক: অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, চুয়েট এবং বিভাগীয় প্রধান, পেট্রোলিয়াম এন্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চুয়েট।