মৃত্যুবার্ষিকীতে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি অতল শ্রদ্ধা

ওয়াফি বিনতে এমদাদ | শনিবার , ১৯ জুলাই, ২০২৫ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

১৯ জুলাই ২০২৫ বাংলা কথা সাহিত্যে অন্যতম জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদএর ১৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী। সত্যিকথা বলতে ছোটবেলায় পাঠ্যবই ছাড়া গল্পের বই পড়ার প্রতি আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। আমার গল্পের বইপড়া শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর। যখন আমি গুটি বসন্তে আক্রান্ত হই, ২০১৩ সালে। অন্যদের মাঝে এ ছোঁয়াচে রোগ না ছড়াতে আমি কনফাইন্ড তথা এক রুমে আবদ্ধ হয়ে দিন কাটানো শুরু করি। পরিবারের সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করা, টিভি দেখলেও সেখানে আমি আমার রুমে একদম একা। এ একাকিত্বের কালে আমার হুমায়ূনের মোহন ভুবনে প্রবেশ। আমার রুমে টেবিলে পড়ে থাকা হুমায়ূনের ‘বল পয়েন্ট’ বইটি দিয়ে আমার হুমায়ূন জগতে প্রবেশ। এরপর কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেন পেন।

আমি সাহিত্যের ছাত্রী হিসাবে আমার আশেপাশের অনেককে সাহিত্য চর্চার ফাঁকে আলাপ করতে শুনেছি ‘হুমায়ূনের লেখা অতি হালকা’। আমি এটি বিচার করার যোগ্যতা রাখি না। তবে একজন পাঠক হিসেবে আমাকে পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়ায় টেনে এনেছেন হুমায়ূন। পাঠক অবাক হবেন হয়ত আমি মেয়ে হয়ে জন্মিয়েও হুমায়ূন পড়তে পড়তে আমি হিমু হতে চেয়েছি। হিমালয়ের মত বিস্তার বিশাল বিপুল হবে আমার জীবন। সমাজ হবে অতি তুচ্ছ আমার কাছে। আমি প্রায়ই হলুদ জামা পরি হুমায়ুনের হিমু হব বলে। শুভ্র আমার সব চেয়ে প্রিয় হুমায়ূন সৃষ্ট চরিত্র।

গুটি বসন্তের সেই একাকিত্বের কালে শুভ পড়ে আমি শুভ্র’র প্রেমে পড়ি। সবাই জানে শুভ্র’র প্রেমে পড়ার কারণ তার হাই পাওয়ার চশমা তবে সে প্রেমের আসল কারণ তার জন্মসূত্র। এতগুলো বছর হয়ে গিয়েছে আমার সন্দেহ শুভ্র’ কতজন পড়েছেন। ‘দারুচিনি দ্বীপ’ যতটা জনপ্রিয় হয়েছে, বিশেষ করে সেটি সিনেমায় আসার কারণে। শুভ্র বইটি তেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে মনে হয় না। শুভ্র পড়ার পর আমি শুভ্র’কে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছি যে, শুভ্র বইটি রাতে ঘুমানোর সময় আমার পাশে গুটি বসন্ত থাকা অবস্থায় ঘুমিয়েছি। এই কারণে আমার বাবা আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেশ কয়েকবার বইটি উল্টিয়ে কে এই শুভ্র জানার চেষ্টা করেছেন।

এখন আসি আমার পড়া হুমায়ূন আহামেদ সবচেয়ে স্পর্শকাতর উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। এমন নয় যে হুমায়ূন শুধু উপন্যাস রচনা করেছেন। তিনি নাটক, টেলিফিল্ম, ছায়াছবিও পরিচালনা করেছেন। ‘নন্দিত নরক’ এসবের মধ্যে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সিনেমা। সাহিত্যে একটি ধারণা প্রবল, সিনেমা, টেলিফিল্ম বা নাটক যেগুলি সাহিত্যাশ্রিত সেগুলি কখনই মূল গল্পের মত মনোমুগ্ধকর হয় না। তবে নন্দিত নরকের ক্ষেত্রে আমাকে সাহিত্যের চেয়ে চলচ্চিত্রটিই বেশি স্পর্শ এবং আবিষ্ট করেছে। ‘নন্দিত নরক’ এর প্রধান চরিত্র রাবেয়ার এ ডায়লগটি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি ‘বলুনতো আমার শাড়িতে কতগুলো সেফটি পিন আছে? ছত্রিশটা’। সেফটি পিন খুলে গেলে মা খুব রাগ করে।

বলুনতো এতগুলো সেফটি পিন কেন? সেফটি পিন না লাগালে আমার শাড়ি খুলে যায়, সেটা খুবই লজ্জার!

হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় ভুবন নুহাশ পল্লীতে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। নুহাশ পল্লীতে আধশোয়া মূর্তির পুতুলের মত মেয়েটিকে দেখে সত্যি বলতে কি আমার নন্দিত নরকের সেই অবুঝ মেয়েটির কথা মনে পড়েছে কেবলি। আমি ইট পাথরের নির্মিত সেই রাবেয়ার হাতে ‘নন্দিত নরকে’ বইটি ধরিয়ে দিয়ে একখানা ছবিও তুলেছি। নুহাশ পল্লীর মূর্তির সেই মেয়েটিকে অনেকে হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে বলে পরিচয় দেয়, আমার কাছে সে ‘নন্দিত নরকে’র অবুঝ রাবেয়াই মনে হয়েছে।

মিসির আলী চরিত্রের ‘দেবী’ বইটি আমার কাছে ধরা পড়েছে ‘নন্দিত নরকে’র ঠিক উল্টোভাবে। ‘দেবী’ বইটি একা রাতের বেলা পড়ে আমি ঘুমিয়েছিলাম। সেই রাতে আমি স্বপ্নে দেখি পুকুরে গোসল করতে গেলে কেউ একজন আমার পেটিকোট ধরে টানছে। সে রাতে আমি অসম্ভব ভয় পেয়েছিলাম।

এই প্রেক্ষাপটে হলে দেবী ছবিটি দেখে আমার প্রতিক্রিয়া হয় পুরা উল্টো। সাহিত্যের ছাত্রী হিসাবে শ্রেণিকক্ষে বহুবার শুনেছি ‘চলচ্চিত্র কখনই মূল উপন্যাস বা বইটির মত হবে না, বই এর কোনো বিকল্প নাই। আমার মতে দেবী বইটির ক্ষেত্রে এটি সর্বাংশে সত্য প্রমাণিত। ‘হুমায়ূন আহমেদ’এর সাজঘর উপন্যাসটিও আমার পছন্দের তালিকায় রয়েছে।

শেক্সপিয়ারের জীবন সম্পর্কে আমি কিছুটা অবগত আছি। শেক্সপিয়ার বিখ্যাত হবার জন্য নাটক লিখেননি বরং প্রতিদিনের প্রয়োজন মিটাতে অর্থ উপার্জনের জন্য নাটক লিখেছেন। শেক্সপিয়ারের লেখা সেইসব নাটক লন্ডনের গ্লোব থিয়েটারে নিয়মিত মঞ্চস্থ হত।

গল্পকার উপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদও বিখ্যাত হবার জন্য তাঁর প্রথম নাটকটি লিখেননি। তিনি নাটকটি লিখেছিলেন তার সন্তানদের ইচ্ছা পূরণ করতে। সে ইচ্ছা বাসায় বসে টিভি দেখার। ‘নন্দিত নরকে’ লিখে হুমায়ূন আহমেদ যে অর্থ উর্পাজন করেন তা দিয়ে তিনি তার সন্তানদের জন্য ঘরে বসে দেখার জন্য টিভি কিনেন। ‘নন্দিত নরকে’ থেকে সেই যে শুরু হুমায়ূনকে আর থামায় কে! পাঠকরা বিশেষ করে তরুণদের বই মেলায় হুমায়ূনের বই চাইই চাই।

হুমায়ূনের এই খ্যাতি যশের কারণে অনেকে তাকে বাংলাদেশের শেক্সপিয়ার হিসাবে আখ্যায়িত করেন। হুমায়ূন আহমেদ যে শুধু গল্প লিখেছেন তা নয়। তিনি প্রচুর জনপ্রিয় গানেরও স্রষ্টা। একটা ছিল সোনার কন্যা ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির গানের অসম্ভব জনপ্রিয় এই গানের স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির নির্মাতাও হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর নির্মিত ছবি ‘আমার আছে জল’ ছবির আমার আছে জল গানটি’র রচিয়তাও তিনি।

হুমায়ূন আহমেদ’এর লেখা গল্প সমগ্রের মধ্যে আমার প্রিয় গল্প ‘নয়া রিক্সা’। বর্ষা হুমায়ূনের প্রিয় ঋতু। বর্ষাকাল আমারও প্রিয় ঋতু। হুমায়ূন আহমেদ প্রয়াত, আমাদের মাঝে নাই। তার অনুপস্থিতিতে তার লেখা ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এস এক বরষায়’ এ গানটি আমাকে খুব ভাবায়কাঁদায়ও। মনে মনে ভাবি যদি আর ক টা দিন এ গুনি মানুষটা আমাদের মাঝে বেঁচে থাকতেন তাহলে আমাদের সাহিত্য আরো কতই না সমৃদ্ধ হত।

হুমায়ূন আহমেদ’ এর দেশপ্রেম ছিল অতুলনীয়। তাঁর লেখা ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ এর প্রকৃষ্ঠ প্রমাণ। এ উপন্যাসে তিনি পাকিস্তানিদের অবর্ণনীয় নির্মমতা তুলে ধরেছেন অপূর্ব এক মননশীলতায়। এই উপন্যাস থেকে কিছু উদ্বৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। ‘ভাইবোনকে নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালাচ্ছি। জীবন বাঁচানোর জন্য মাদ্রাসার ছাত্র হিসাবে ভর্তি হতে গেছি শর্ষিনার পীর সাহেবের মাদ্রাসায়। পাকিস্তানি মিলিটারি মাথায় গুলির বাক্স তুলে দিয়েছে। অকল্পনীয় ওজনের গুলির বাক্স মাথায় নিয়ে সৈন্যদের সঙ্গে বারহাট্টা থেকে হেঁটে হেঁটে গেছি নেত্রকোণা পর্যন্ত।

মিলিটারিদের বন্দিশিবিরে কাটল কিছু সময়। কী ভয়ংকর অত্যাচার। এক সকালে মিলিটারিদের একজন এসে আমার হাতে বিশাল সাইজের একটা সাগর কলা ধরিয়ে দিয়ে বলল, তোমাকে কাল সকালে গুলি করে মারা হবে এটা তোমার জন্য ভাল। তুমি যদি নিরপরাধ হও, সরাসরি বেহেস্তে চলে যাবে আর যদি অপরাধী হও তবে মৃত্যু তোমার প্রাপ্য শাস্তি।’

আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসটি লেখার কারণ ছিল মানুষকে যেমন পিতৃঋণমাতৃঋণ শোধ করতে হয়, তেমন দেশমাতার ঋণও শোধ করতে হয়। একজন লেখক সেই ঋণ শোধ করেন তার লেখার মাধ্যমে।

জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে একটি কাগজে ছাপা হত। লেখাটি অসমাপ্ত থাকা অবস্থায় তিনি মনে করেছিলেন, ব্যস্ততা কমলে তিনি লেখাটি শেষ করবেন, তিনি ভেবেছিলেন লেখার অনেক সময় তো আছে, অনেক সময়!

এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ’এর কিছু কথা উল্লেখ না করলে নয়। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসটির পূর্ব কথায় তিনি লিখেছেন একদিন হঠাৎ টের পেলাম সময় আর হাতে নাই। সময় শেষ হয়ে আসছে। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ আর লেখা হবে না। তখন আমি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের একটি ট্রলিতে। দুজন নার্স ট্রলি ঠেলে আমাকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাচ্ছেন। ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। আমাকে একটা ঘুমের ইনজেকশান দেওয়া হয়েছে। চোখের পাতা ভারী হওয়া শুরু হয়েছে, হাসপাতালের আলোর তীব্রতা দ্রুত বিলীন হচ্ছে।

যখন অচেতন হতে শুরু করেছি, তখন মনে হল ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ তো লেখা হল না। আমাকে যদি আরেকবার পৃথিবীতে আসার সুযোগ দেওয়া হয় আমি এই লেখাটি অবশ্যই শেষ করব। অচেতন হওয়ার আগ মুহূর্তে হঠাৎ আনন্দে অভিভূত হলাম কারণ তখনই প্রথম টের পেলাম আমি আসলেই একজন লেখক। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি যাবার আগ মুহূর্তে অসমাপ্ত লেখার চিন্তাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা।

সত্যিই তিনি একজন লেখক। একজন নির্মাতা। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিকও বটে। কারণ দেশে ফিরেই তিনি ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লেখায় হাত দেন দুর্বল শরীর নিয়ে। দিনে দুই তিন পাতার বেশি লিখতে পারতেন না। এভাবেই ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লেখা শেষ করেছেন।

লেখা শেষ হওয়ার পর তার অনুভূতি ‘এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমি দেশ মাতার ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছি, এই আনন্দের কোন শেষ নাই’। সবশেষে বলতে চাই হুমায়ূন আহমেদের অতুলনীয় সব কাজের প্রতি রইল আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাদা কালো থেকে স্মার্টফোন আর শিশুর হারানো শৈশব
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে