সাদা কালো থেকে স্মার্টফোন আর শিশুর হারানো শৈশব

ফারহানা ইসলাম রুহী | শনিবার , ১৯ জুলাই, ২০২৫ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

একটা সময় ছিল, যখন সাদাকালো টেলিভিশনের আলোয় সন্ধ্যা নামত। পরিবার মানে ছিল নির্ভেজাল সম্পর্ক, ভালোবাসার বন্ধন। একান্নবর্তী পরিবারে কিংবা ছোট ছিমছাম বাসায় দিন যেত ছন্দে। কর্মব্যস্ত দিন শেষে পরিবারের সবাই একসাথে বসে গল্প করত, হাসত, নাটক দেখত, আর ভাগ করে নিত একেকটা জীবনের ছোট ছোট আনন্দ। সেই সময়ে বিকেল মানেই উঠোনে দৌড়ঝাঁপ, মাঠে হাডুডু, বৃষ্টিতে ভেজা ফুটবল ম্যাচ। মেয়েরা শিখত সুইসুতোর কাজ, উল বোনা কিংবা নিজের হাতে আঁকা ছবি দিয়ে রঙিন করে তুলত তাদের ছোট্ট জগৎ। পড়ালেখার সময়ে টিভি বন্ধ থাকত, এমনকি তালা পর্যন্ত লাগানো হত কোনো কোনো বাড়েতে! কারণ তখন অভিভাবকদের মধ্যে ছিল শৃঙ্খলার প্রতি এক দায়িত্ববোধ। রাতে নয়টার ভাত খাওয়া, তারপর পরিবারের সবাই মিলে নাটক দেখা ছিল এক অলিখিত নিয়ম। নাটক, গান, কবিতাসবকিছুতেই ছিল সমাজ গঠনের বার্তা, প্রাণের ছোঁয়া। দশটায় ঘুম, আর ভোরে ঘুম ভাঙত পাড়াজুড়ে ছেলেমেয়েদের পড়ার শব্দে। সবচেয়ে দুষ্ট ছেলেটিও মাবাবার রাগে থেমে যেত। সে যুগে শ্রদ্ধা ছিল, ভয় ছিল, আবার প্রশান্তিও ছিল। প্রতিবেশী মানে ছিল পরিবারের বাড়তি হাত। ঈদে একসাথে সেমাই খাওয়া, অসুখেবিপদে পাশে দাঁড়ানো, সুখদুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়াএই ছিল সমাজ। কিন্তু সময় বদলেছে।

পৃথিবী এগিয়েছে, প্রযুক্তি বিস্ময়করভাবে উন্নতি করেছে। আমরা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি, কিন্তু হারিয়েছি হৃদয়ের ছোঁয়া, সম্পর্কের উষ্ণতা। আজকের সমাজে বিরাজ করছে এক অস্থিরতাঅসুস্থ প্রতিযোগিতা, কুটিলতা, আর স্বার্থপরতার ছাপ পড়েছে প্রতিটি সম্পর্কে। মানুষ মুখোশ পরে চলছে, কে আসলে কার আপন তা বোঝা মুশকিল। শিশুরা আজ চার দেয়ালের ফ্ল্যাটে বন্দি। খেলার মাঠ যেন বিলুপ্তপ্রায়। শরীরচর্চার সুযোগ নেই, দৌড়ঝাঁপ নেইশুধুই মোবাইল, ট্যাব আর টিভি স্ক্রিন। প্রযুক্তি একদিকে তাদের বিশ্বকে খুলে দিলেও, অন্যদিকে কেড়ে নিয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য, সৃষ্টিশীলতা আর শিশুসুলভ আনন্দ।

সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই চোখে পড়ে ভয়ংকর সব খবরঅনৈতিকতা, সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, সাইবার ক্রাইম। সবকিছুই যেন সহজলভ্যতার মোহে ঢেকে যাচ্ছে। এই প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে প্রযুক্তি, কিন্তু তারা পাচ্ছে না মূল্যবোধের শিক্ষা। আজকের শিশুকিশোরদের একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যেন এক দুঃসাধ্য কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বেড়ে উঠছে যান্ত্রিক জীবনে, সম্পর্কের গভীরতা না শিখেই বড় হচ্ছে এক নিষ্প্রাণ বাস্তবতার মধ্যে। জাতি যেন পথ হারাচ্ছেচিন্তা, চেতনা, নৈতিকতা সবকিছুই এখন এক অন্ধ দৌড়ে, যেখানে গন্তব্য নেই। তবুও, থামতে হবে আমাদের! ভালোবাসা, সহানুভূতি আর মূল্যবোধের সেই সমাজ ফিরিয়ে আনতেই হবে। প্রয়োজন ঘরে ঘরে সচেতনতার আলোকবর্তিকা জ্বালানো। প্রয়োজন শিশুদের হাতে প্রযুক্তির পাশাপাশি বই তুলে দেওয়া, মাঠে ফেরানো, সম্পর্কের মানবিকতা শেখানো। আমরা যদি আবার একসাথে নাটক দেখি, গল্প বলি, সন্তানদের সময় দেইতবে হয়তো ভবিষ্যতের সমাজ হবে একটু কম যান্ত্রিক, একটু বেশি মানবিক। আজকের এই কথামালা শুধু স্মৃতিচারণ নয়, এ শুধু অতীত স্মরণও নয়এ এক অনুভবপত্র, এক নতুন পথচলার আহ্বান; বরং এটি এক জাগরণের ডাক, এক নবচেতনার অঙ্গীকার। ফিরে যাওয়া নয়, বরং সামনে এগিয়ে গিয়ে সেই হারিয়ে যাওয়া সুন্দরতাকে নতুন করে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা।

লেখক : কবি, শিক্ষক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনষ্ট সমাজ
পরবর্তী নিবন্ধমৃত্যুবার্ষিকীতে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি অতল শ্রদ্ধা