দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়কে নতুন সম্ভাবনা

বাড়বে বাণিজ্য, নিশ্চিত হবে নিরাপত্তা

আলাউদ্দীন শাহরিয়ার, বান্দরবান | শনিবার , ১৯ জুলাই, ২০২৫ at ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ

পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্ত সড়কের পথে পথেই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে। আঁকাবাঁকা সড়কটি জুড়েই চারিদিকে সবুজের সমারোহে কখনো উঁচুনিচু পাহাড়ের সারি, কখনো মেঘে ঢাকা সড়ক পথটি গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামকেই যুক্ত করেছে সড়ক নেটওয়ার্কে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্বতচূড়া বান্দরবানের কেওক্রাডং পাহাড়ের ওপর দিয়ে একে বেঁকে চলে যাওয়া পিচঢালা সড়কটিই বাংলাদেশে সবচেয়ে উঁচু সড়ক হিসেবে স্থান পেতে যাচ্ছে। কেওক্রাডং পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় সড়কটির উচ্চতা দাঁড়াচ্ছে ৯৬৫ মিটার। এত উঁচুতে দেশে আর কোনো সড়ক নির্মাণ হয়নি এখনো পর্যন্ত। এর আগে থানচি উপজেলার বাকলাইলিক্রে সড়কের সাদ্রাহাফং পাহাড়ের রেমংপাড়া স্থানটি ছিল সবচেয়ে উঁচু সড়ক। যার উচ্চতা ৯২২ মিটার। এই স্থানটিকে ছাড়িয়ে এখন কেওক্রাডং সড়কটি দেশের সর্বোচ্চ উচু সড়কপথ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সেনাবাহিনীর ২৬ কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ানের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু নোমান মো. মইনুল ইসলাম।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়কের অনুমোদনের পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেনাবাহিনীর ২৬ কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ান বান্দরবানের রুমা উপজেলার বগালেক থেকে কেওক্রাডং হয়ে ধুপানিছড়া পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার এই সড়কটির নির্মাণ কাজ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়কের প্রথম পর্যায়ের ৩১৭ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে একটি অংশ বান্দরবানের এই সড়কটি। এটি শুধু দেশের সর্বোচ্চ সড়কই নয়, এলাকার পর্যটন, শিক্ষা চিকিৎসা, কৃষিসহ দুর্গম এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়কটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে শুরু হয়ে রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদর, বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ও জুরাইছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা হয়ে মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে পৌঁছাবে। সড়কটি বরকল ও বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙা হয়ে রামগড় উপজেলা সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে আঁকাবাঁকা এ সড়ক। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সড়কে সংযুক্ত হবে বাংলাদেশের পার্বত্য তিন জেলা।

আগামী ২০৩৬ সালের মধ্যে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি তিন পার্বত্য জেলার ১২টি উপজেলার ওপর দিয়ে পুরো ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রথম ধাপের ৩১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে গত ৩০ জুন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় তিন হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। পুরো কাজ শেষ হলে এটি হবে বাংলাদেশের দীর্ঘ সড়ক নেটওয়ার্ক। এ সড়ক ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্য এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, সীমান্ত সড়কটির বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র ও অবকাঠামোগত নানা স্থাপনা। সেই সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্প। স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের গড়ে তোলা কাজুবাদাম, আম, লিচু, কফি, আনারসসহ নানা জাতের ফলের বাগান। এদিকে সারাবছর জুড়েই পাহাড়ের দুর্গম এলাকার মানুষকে জিম্মি করে চলে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নির্যাতন। দুর্গমতার কারণে সেখানকার সাধারণ মানুষ এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সাহস করে না। সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হলে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহল ও যাতায়াতের ফলে স্থানীয়দের সাহস ও আস্থা বাড়বে। তারা সহজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহলের ফলে চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম কমে আসবে। এতে স্থানীয় জনগণের জীবনের নিরাপত্তাও বহুগুণে বেড়ে যাবে।

জেলা হোটেল ওনার্স এসোসিয়েশন সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, সীমান্ত সড়কটির যুক্ত হবে রুমা উপজেলায় অবস্থিত দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন সাজানো গোছানো সুন্দর গ্রাম মুনলাই পাড়া, পাহাড়ের চূড়ায় রহস্যময় বগালেক, দার্জিলিংপাড়া, দেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম পাসিং পাড়া, দেশের দ্বিতীয় পর্বতচূড়া কেওক্রাডং পাহাড়, মিয়ানমার ভারত সীমান্ত ঘেঁষা সুংসং পাড়া, রোমানা পাড়া, ধুপানিছড়া আর ভারতমিয়ানমারবাংলাদেশের যৌথ ত্রিসীমানা (তিন মুখ) পিলার। যাওয়া যাবে আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক লেক রাইংক্ষ্যং পুকুর। অপার সৌন্দর্যের দর্শনীয় স্থানটিতে পর্যটকদের যাতায়াতও প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

স্থানীয় কেওক্রাডং এলাকার ব্যবসায়ী লালা বম ও বাগানচাষি জুয়াল থাং বম বলেন, সীমান্ত সড়কটি ভ্রমণে দূরদূরান্ত থেকে ইতিমধ্যে দর্শনার্থীরা দেখতে ছুটে আসছেন। আগেও পাহাড় চূড়া ভ্রমণে আসতেন পর্যটকরা। তবে এখন মনোরম পরিবেশে পিচঢালা সড়কপথে পর্যটকরা সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারছেন। গোটা কেওক্রাডং পাহাড় এলাকায় উৎপাদিত নানা জাতের ফল সহজেই পরিবহন করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। ভ্রমণকারীদের কাছেও বিক্রি করতে পারছি। সড়কটির কারণে দূরদূরান্তের পাড়াবাসীরাও লাভবান হচ্ছে।

সেনাবাহিনীর ২৬ কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু নোমান মো. মইনুল ইসলাম জানান, দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গের উপর দিয়ে সড়কটি নির্মাণকাজ ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। এটি নির্মাণের সময় সন্ত্রাসী তৎপরতা, বিরূপ আবহাওয়া, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নানা পারিপার্শ্বিক অবস্থায় খুবই বেগ পেতে হয়েছিল সেনা সদস্যদের। তবে সব চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এই সড়কটি এখন স্থান করে নিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ উচু সড়কে। এটি আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। এছাড়াও সীমান্তে পুলিশ, বিজিবির পেট্রোলিং সহজ হওয়ার মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসীদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে এ পার্বত্য সড়ক নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এরই মধ্যে স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সীমান্ত সড়কের বিরোধিতা থেকে বোঝা যায়, এ সড়ক নেটওয়ার্ক তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সড়কের ফলে রামগড়সাবরুম, থেগামুখ স্থলবন্দর, ঘুমধুমমংডু ও মিয়ানমারের চিন রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও বাণিজ্য সুযোগ বাড়বে। সীমান্ত হাটগুলো কার্যকর হতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাবারের সন্ধানে লোকালয়ে বন্যপ্রাণী, আতঙ্ক
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজার সৈকতের অর্ধেক ঝাউগাছ বিলীন