অরুণদা

জ্যোতির্ময় নন্দী | শুক্রবার , ১৮ জুলাই, ২০২৫ at ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ

অরুণদা, মানে অরুণ দাশগুপ্তকে নিয়ে লিখতে বসার আগে আন্তর্জালে অনুসন্ধান চালিয়ে তাঁকে নিয়ে লেখা কিছু লেখা পড়ে নিলাম, নতুন কোনো তথ্যতত্ত্ব পাওয়ার আশায়। দেখলাম, সব লেখাই তাঁর মৃত্যুর পরে লেখা, এবং সেকারণেই কিনা কে জানে, লেখাগুলোতে তাঁকে মহামানব বানানোর একটা জোরালো প্রয়াস চালানো হয়েছে। লেখাগুলোতে মিথ্যে কিছু লেখা হয়েছে তা আমি বলছি না, কিন্তু সবই ‘সুগার কোটেড ট্রুথ’। অথবা আমি এও বলতে চাইছি না যে, অরুণ দাশগুপ্ত আদৌ কোনো মহামানব বা মহান মানুষ ছিলেন না। কিন্তু লেখাগুলোতে আমি সেই মানুষটার খোঁজ পাইনি, যাঁকে আমি দীর্ঘকাল ধরে খুব কাছ থেকে দেখেছি; যাঁকে দেখে রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতা পংক্তি দুটি অনায়াসে বলা যেতো:

তোমারে পাছে সহজে বুঝি

তাই কি এত লীলার ছল?

বাহিরে যার হাসির ছটা

ভিতরে তার চোখের জল।

অরুণ দাশগুপ্তের একটা জনপ্রিয় পরিচিতি ছিল ‘দাদামণি’ হিসাবে। যদিও আমার সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য বিচারে তাঁকে হয়তো আমি ‘কাকা’ বলতে পারতাম, কিন্তু আমি তাঁকে ‘অরুণদা’ই বলতাম। সেটা আবার সাহিত্যসংস্কৃতি জগতের প্রচলিত রীতিতে যেকোনো বয়সের মানুষকে যে ‘দাদা’ বা ‘ভাই’ সম্বোধন করা যায়, সেদিক থেকেও নয়। আমি তাঁকে ‘অরুণদা’ বলতাম অন্য সুবাদে। তাঁর মামা প্রয়াত পরিমল সেন (সেনগুপ্ত) ছিলেন আমার পিতা প্রয়াত নীরদ বরণ নন্দী’র অগ্রজতুল্য সুহৃদ, এবং তাঁর উদ্যানচর্চা ও পায়রা পালনের পথপ্রদর্শক ও পরামর্শদাতা। পরিমল জ্যাঠা ১৯৭১এ স্বাধীনতা যুদ্ধের আগপর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরের কাজেম আলি রোডে টিলার ওপরে আমাদের বাগান ও পশুপক্ষীরালয় শোভিত বাংলো ধরনের বাসাটায় প্রায় নিত্যদিন এসে দেখে যেতেন বাবার পোষ্য প্রাণী ও উদ্ভিদদের অবস্থা ও ব্যবস্থা। কোনো ভুলত্রুটি দেখলে সংশ্লিষ্ট পরিচারককে, এমনকি খোদ বাবাকে আর মাকেও বকাবকি করতে ছাড়তেন না। ঘটনাচক্রে আমার গরম মেজাজের ঠাকুমাও দুএকবার পরিমল জ্যাঠার বকুনি খাওয়ার পর থেকে ওনার উপর চটা ছিলেন। এদিকে আবার ঠাকুমার নামও ছিল পরিমল, মানে পরিমল সুধা, তাঁর কবি বাবার রাখা কাব্যিক নাম। পরিমল জ্যাঠা এলে আমরা ঠাকুমাকে খ্যাপাতাম– ‘ঠাকুমা, ঠাকুমা, দেখবে চলো, তোমার মিতা এসেছেন।’ ঠাকুমা তখন আরো চটে যেতেন।

পরিমল জ্যাঠা রাউজানের সুলতানপুর নন্দীপাড়ায় আমাদের গাঁয়ের বাড়িতেও একাধিকবার বেড়াতে এসেছেন। আমার ১২১৩ বছর বয়সের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। একবার উনি এসেই বাবাকে জানিয়ে দিলেন, “নীরদ, এবার মাংসটা আমিই রাঁধব। গতবার তোমার রাঁধুনির রান্না তেমন যূতের হয়নি।”

অসাধারণ জুলজিক্যাল আর বোটানিক্যাল গার্ডেনিংএর পাশাপাশি রান্নাটাও চমৎকার করতেন পরিমল জ্যাঠা। সেবারের খাসির মাংসটায় যদিও কড়াইয়ের তলার দিকে একটু পোড়া লেগে গিয়েছিল, তবুও খুব সুস্বাদু হয়েছিল। আসলে রান্নাটা হয়েছিল ঠিক যেন পরিমল জ্যাঠার মেজাজের মতোইএকটু মেজাজে পোড়া ঘ্রাণ থাকলেও সুস্বাদু।

যেহেতু পরিমল জ্যাঠাকে বাবা ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করতেন, তাই অরুণদা আমার বাবাকেও ‘মামা’ আর মাকে ‘মামি’ বলে ডাকতেন। আর সেই সম্পর্কের সুতো ধরেই আমি তাঁকে ‘অরুণদা’ বলতাম। আমার মা প্রয়াতা স্মৃতিকণা নন্দী আর অরুণদা ছিলেন সমবয়সী। ১৯৩৬এ মায়ের জন্ম কলকাতায় তাঁর বাবার বাসায়, আর অরুণদার জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়ায় সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী ধলঘাট গ্রামে নিজের পৈতৃক বাড়িতে। অরুণদা আমাদের গ্রামের বাড়িতে আসার সুযোগ কখনো পাননি নানা কারণে, তবে ১৯৭১এর পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটার ব্রিক ফিল্ড রোডে আমাদের নতুন বাসায় অনেকবার এসেছেন।

অরুণ দাশগুপ্তকে নিয়ে লিখতে বসে তাঁর মামা পরিমল সেন বা সেনগুপ্তকে নিয়ে এত কথা যে বলছি, তার কারণ আছে। আমার দিক থেকে অরুণদার দিকে তাকাতে গেলে পরিমল জ্যাঠার কথা অবধারিতভাবে মনে আসবেই। মামাভাগ্নে দুজনের জীবনে আর মৃত্যুতে এত মিল যে, তা রীতিমতো অবাক করে দেয়। ভাগ্নে অরুণের মতো মামা পরিমলবাবুও ছিলেন অকৃতদার। চিরকাল আত্মীয়স্বজনের আশ্রয়েই তাঁদের জীবন কেটেছে। তাঁদের দুজনের চেহারা, শরীরের গঠন আর বর্ণেও ছিল প্রচুর সাদৃশ্য। দুজনের শেষ পরিণতিও প্রায় একই রকমের। সারা জীবন চট্টগ্রামে ফুলপাখি আর বন্ধুসুহৃদদের নিয়ে কাটিয়ে শেষজীবনে রুগ্নাবস্থায় কলকাতার উপকণ্ঠে কোন্‌ এক জায়গায় এক আত্মীয়ের বাসায় নিঃসঙ্গ একাকিত্বে কাটাতে বাধ্য হলেন এবং সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। প্রায় একইভাবে অরুণদাও শেষজীবনে চলে যেতে বাধ্য হলেন তাঁর কর্মক্ষেত্র, যৌবনের লীলাভূমি চট্টগ্রাম শহরকে ছেড়ে স্বগ্রামের বাস্তুভিটায়, এবং সেখানে প্রায় জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন। এক্ষেত্রে ‘নরানাং মাতুলক্রম’ কথাটির সত্যতা প্রমাণিত করতেই যেন মামার ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ভাগ্নেতেও বর্তিয়েছে।

চট্টগ্রাম শহরে পরিমল জ্যাঠা থাকতেন পাথরঘাটায় তাঁর কাকা যোগেশ চন্দ্র সেনের সুরম্য বাসভবনে। এই বাড়িটিতে পরিমল জ্যাঠা এক অসম্ভব সুন্দর বাগান গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে দেশিবিদেশি নানা ফুলের পাশাপাশি জলভরা বিশাল বিশাল গামলার মতো টবে লাল আর শাদা পদ্মফুল ফুটে থাকতে দেখতাম। বাগানটা এত সুন্দর ছিল, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যেত। এ উদ্যানের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল সূক্ষ্ম, সুন্দর এক রুচির বহিঃপ্রকাশ। জ্যাঠার পায়রার সংগ্রহটাও ছিল দারুণ বৈচিত্র্যময়। দেশি, ময়ূরপঙ্খি, নোটন, সেরাজু, গলাফুলা, গেরোবাজ, পেশোয়ারিকত জাতের, কত চেহারার পায়রা ছিল ওখানে তার ইয়ত্তা ছিল না। তার স্নেহের অনুজ আর অনুগামী নীরদের, মানে আমার বাবার, সংগ্রহেও যাতে সেসব পায়রা পৌঁছে যায়, সেদিকেও তাঁর ছিল তীক্ষ্মদৃষ্টি।

পরিমল জ্যাঠার কাকা যোগেশ সেনের সুন্দরী বিদূষী কন্যার নাম ছিল প্রণতি সেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম প্রধান মেয়েদের স্কুল অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, লোকমুখে যার প্রচলিত নাম ছিল নন্দনকানন স্কুল, তার প্রধান শিক্ষিকা। তিনি প্রেমে পড়েছিলেন চট্টগ্রাম শহরের সরকারি চট্টগ্রাম কলেজের বাইরের তৎকালীন একমাত্র মহাবিদ্যালয় বোয়ালখালির কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের তরুণ সুপুরুষ অধ্যাপক শান্তিময় খাস্তগীরের।

জাতপাত, শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুর পুরোপুরি মিল সত্ত্বেও শান্তিময়প্রণতির প্রেম কিন্তু পরিণয়ে পরিণতি পেল না, কন্যাপক্ষের অভিভাবকদের অসম্মতির কারণে। দুঃখে অভিমানে প্রণতি দেবী পিতৃগৃহ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে উঠলেন তাঁর সহশিক্ষয়িত্রী ও স্বজাতের ঘনিষ্ট বান্ধবী কল্যাণী গুপ্তের বাড়িতে। ওটা ছিল মূলত কল্যাণী দেবীর প্রয়াত পিতা, চট্টগ্রামের একসময়কার সিভিল সার্জন ডা. কেশব চন্দ্রগুপ্তের বাসা। কেশব বাবুরা ছিলেন টাঙ্গাইলের লোক, এবং কর্মসূত্রে তিনি চট্টগ্রামে থিতু হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর চিরকুমারী কন্যা কল্যাণী এ বাড়ির মালিকানা পান। কল্যাণীর মতো প্রণতিও আজীবন কুমারী থেকে এ বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শান্তিময় খাস্তগীরও চিরকুমার থেকে যান। কানুনগোপাড়া কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালে ১৯৭১এ হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে তিনি কলেজ ক্যাম্পাসেই শহিদ হন।

চট্টগ্রামের নন্দনকানন বৌদ্ধমন্দিরের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ডা. কেশব গুপ্তের প্রাচীন বাড়িটিতে প্রণতি সেনের সূত্রে আশ্রয় পান তাঁর কয়েকজন আত্মীয়স্বজন, যাঁদের একজন হলেন তাঁর জ্যাঠতুতো দিদির ছেলে অরুণ দাশগুপ্ত।

চিরকুমারী প্রণতি ও কল্যাণীর মৃত্যুর পর ওই আত্মীয়দের মধ্যেই কেউ বাড়িটির মালিকানা পেলেও, অরুণদার ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। অবশ্য তিনি যে তার খুব পরোয়াও করেছেন তাও নয়। ওসব সাংসারিক ব্যাপার স্যাপার নিয়ে তিনি আদৌ ভাবতেন বলে মনে হয় না। তবে বাড়িটির মালিকানা যিনি পান, তিনি পরে বাড়িটি ডেভেলপারদের দিয়ে বহুতল ভবন করানোর উদ্যোগ নিয়ে অরুণদাকে আশ্রয়চ্যুত করেন। শোনা যায়, ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হলে সেখান থেকে অরুণদাকে একটা ফ্ল্যাট দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত যেকোনো কারণে সেটা তাঁকে দেওয়া হয়নি।

বলতে গেলে, বৌদ্ধমন্দিরের পাশের বাড়িটা থেকে উৎখাত হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় অরুণদার উদ্বাস্তু জীবনের পালা। কিছুদিনের জন্য তিনি আশ্রয় নেন চট্টগ্রাম শহরের রহমতগঞ্জ এলাকার আরেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের বাড়িতে, কিন্তু একপর্যায়ে সেটাও ডেভেলপারের হাতে দিয়ে দেওয়ায় তাঁর ঠাঁই হয় পাশেই আরেক প্রখ্যাতজনের বাড়ি ভেঙে নবনির্মিত ভবনের একটি ফ্ল্যাটে। শেষপর্যন্ত সেখানেও থাকা সম্ভব না হওয়ায় তাঁকে চলে যেতে হয় ধলঘাটে গ্রামের বাড়িতে। এই হল আমাদের প্রখ্যাত কবি, প্রবন্ধকার, দার্শনিক, সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্তের জীবনের শেষদিককার কয়েকটি বছরের যাযাবর জীবনের চিত্র।

এটা ঠিক যে, চিরকুমার কবি অরুণ দাশগুপ্তকে পথেঘাটে বা কোনো দাতব্য চিকিৎসালয়ে নিরাশ্রয়ের মতো মরতে হয়নি, নিজ ভিটেবাড়িতেই দেহত্যাগ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, প্রায় আজীবনই নগরবাসী, নাগরিক হাওয়ায় লালিত, নাগরিক জীবনযাত্রায় চিরাভ্যস্ত মানুষটাকে জীবনের শেষলগ্নে পল্লীগ্রামে নির্বাসিত হতে হল কেন? এত ভক্ত অনুরাগী শুভানুধ্যায়ীতে পরিপূর্ণ এই শহরের এককোণে এই চিরকুমার পরিবারপরিজনহীন মানুষটার একটা ছোট্ট ঠাঁই হতে পারত না? কেন তাঁকে এভাবে বঞ্চিত করা হল? আর অরুণদাও এতটাই ভদ্রলোক, এতটাই সুশীল তাঁর আচরণ যে, তিনি কখনো মুখ ফুটে কারো কাছে কিছু চাননি, শুধু দিয়েই গেছেন। কোনো নেপোয় দই মেরে দিয়ে গেছে, আর অরুণদা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছেন আর মুচকি মুচকি হেসেছেন।

(চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরিম রেজা
পরবর্তী নিবন্ধআত্মত্যাগ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাই কারবালার শিক্ষা