কবি রিজোয়ান মাহমুদ এর বেড়ে উঠা চট্টগ্রামের দক্ষিণ হালিশহর, সল্টগোলায় যা একসময় অজপাড়াগাঁ ছিলো। পাশে বহমান কর্ণফুলী ও বঙ্গোপসাগর। ঢেউয়ের শোঁ শোঁ শব্দ আর গাঙচিলের অবিরাম উড়াউড়ি। একজন কবির জন্য অঞ্চল, মাটি, পরিবেশ–প্রকৃতি ও পারিবারিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এবং এই অনুষঙ্গগুলো কবির অনুভূতি উপলব্ধিকে সমৃদ্ধ করেছে। পাশাপাশি বাবার পড়া পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় গল্প–উপন্যাস পড়া এবং মেঝো বোনের উপন্যাস ও গল্প পড়া তাকে ঋদ্ধ পাঠকে পরিণত করেছে। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় লেখালেখি শুরু করেন, তবে মধ্য আশির দশক থেকে সাহিত্যাঙ্গণে তাঁর সদর্প পদচারণা লক্ষণীয়। কবিতার পাশাপাশি তিনি গল্প ও প্রবন্ধ রচনায় সিদ্ধহস্ত। বলাবাহুল্য, কবি হওয়ার আগে মানুষ হওয়া জরুরি অর্থাৎ একজন সৎ–সাহসী, পরিচ্ছন্ন, উদার, নৈতিক এবং মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ। রিজোয়ান মাহমুদ চিন্তা, চেতনা, আচরণ ও বোধে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যে পরিণত একজন মানুষ ও কবি।
তাঁকে আলাদাভাবে চেনা যায় কাব্যস্বরের প্রকল্পে। কবিতা উপযোগী হয়ে ওঠে স্বর চিহ্নিত স্বকীয় কাব্যভাষার গুণে। উপরোক্ত সনেট কাব্যগ্রন্থ ‘মুদ্রিত কামনা থেকে’এর ফ্ল্যাপে অগ্রজ ধীমান কবি, অধ্যাপক ফাউজুল কবির যথার্থ বলেছেন; ‘রিজোয়ান মাহমুদ ষোলোআনা কবি। চয়নে বয়নে বোধে ছন্দে পারঙ্গম কবি’। আমি মনে করি, কৌতূহল মানুষের জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এবং তা একজন সংবেদনশীল ও সৃজন তৃষ্ণায় নিমগ্ন মানুষের মধ্যে আরও প্রবল। আলোচ্য কবি তারই দৃষ্টান্ত। তাড়িত জীবনবোধ মানুষকে সমাজ, সংস্কৃতি, জাতি, প্রকৃতি, প্রেম, দুঃখ–বেদনা, প্রভুর অস্তিত্ব ও বিদ্যমান অচলায়তনের প্রতি অনুসন্ধিৎসু করে তোলে;- কবিও উক্ত অনুসরণীকায় অভ্যস্ত অনুসন্ধিৎসু কাব্য মনীষা। কাব্যচর্চা বা কাব্যপ্রীতিতে ঘনিষ্ঠ জীবনবোধ ও সমাজ বীক্ষণ যাঁর কবিতায় খুব সুস্পষ্ট, তাঁকে মানুষের কবি বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। ‘মুদ্রিত কামনা থেকে’ একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের সনেট কাব্যগ্রন্থ যা ১৮ মাত্রার মহাপয়ারের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকাশিত হয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান: ‘খড়িমাটি’, প্রচ্ছদ করেছেন: মোস্তাফিজ কারিগর। গ্রন্থটিতে মোট ৩০ টি সনেট অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রীতিগত অষ্টাদশ পঙক্তির এই সনেট কাব্যগ্রন্থে বিষয়, বৈশিষ্ট্য, চিত্রকল্প, প্রতীকবাদ এবং নির্মাণশৈলী খুব যত্নসহকারে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
চতুর্দশপদী (Sonnet) কবিতা প্রথম উদ্ভব হপ্র ইতালিতে পণ্ডিত ও দার্শনিক ফ্রাঞ্চেসকো পেত্রার্কের হাতে, যাকে ‘মানবতন্ত্রের পিতা’ বলা হপ্র। চতুর্দশপদী (Sonnet) কবিতা মূলত ১৪টি চরণে সংগঠিত এবং প্রতিটি চরণে সাধারণভাবে মোট ১৪টি করে অক্ষর থাকবে। এর প্রথম আট চরণের স্তবককে অষ্টক এবং পরবর্তী ছপ্র চরণের স্তবককে ষটক বলা হয়। বাংলা সাহিত্যে কবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত প্রথম বাংলা ‘চতুর্দশপদী‘ সনেটের দিগন্ত উন্মোচন করেন। পঞ্চাশের দুই দিকপাল কবি আল মাহমুদ ও শামসুর রাহমান এর হাতেও সনেট সমাদৃত হয়েছে। এর পূর্বে ১৮ (অষ্টাদশ) মাত্রায় সনেট লেখা হয় এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এর প্রবর্তক বলা হয়ে থাকে। রবীন্দ্র ধারাবাহিকতায় বোধ করি রিজোয়ান মাহমুদ ১৮ মাত্রায় সনেট কাব্যগ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হোন।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ অনুসরণ এবং অন্ত্যমিল বজায় রেখে রচিত সনেটের প্রথম ৮ চরণে (অষ্টক) উপলব্ধি ও অন্তর্গত কাব্যানুভূতির ভাব বিন্যাস ঘটে এবং পরের ৬ চরণে (ষটক) তার বিশ্লেষণ ও ভাবকল্পনার মর্মার্থ উদ্ভাসিত হয়। সনেট কাব্যগ্রন্থ ‘মুদ্রিত কামনা থেকে’ মুদ্রিত হয়েছে উপরোক্ত সৃজনী ধারায়, বলা যেতে পারে। তিরিশটির মতো সনেট তার সুদীর্ঘ সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে অনন্য সংযুক্তি। বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ এই গ্রন্থে উদ্ভাসিত। যেমন; চিত্রকল্প, সৌন্দর্যবোধ, সমাজবাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, দর্শন, জীবনবোধ, প্রেম–বিরহ, প্রবহমানতা, পরিমিত কাব্যালঙ্কার, রূপক, উপমা, অনুপ্রাস, উৎপ্রেক্ষা, ছন্দ ইত্যাদি। এসব অনুষঙ্গ ব্যবহারে কবিকে অবশ্যই নির্মাণশৈলী, কাঠামোগত বিন্যাস, শাব্দিক দ্যোতনা অর্থাৎ এককথায় ছান্দসিক পুরকৌশলে সাবধানী হতে হয়। তবে প্রবহমানতা ছাড়া কবিতার শরীর ঋদ্ধ পরিপুষ্ট হয় না। শব্দের গাঁথুনি মজবুত হয় না। এক্ষেত্রে কবি অত্যন্ত সচেতন, প্রথাগত রীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন।
প্রেম–বেদনায় আবর্তিত মানব জীবন। মানুষ প্রেমে আশ্রয় খোঁজে এবং বেদনায় নেমে আসে ধূসর বিষণ্নতা। রিজোয়ানের কবিতায় প্রেম অমৃত আশ্রয়, আর বেদনা জেগে উঠার সংকল্প। মানবিক ও ঐশ্বরিক প্রেম দু‘টোকে তার গ্রন্থে খুব সূক্ষ্ম ও বিস্ময়করভাবে অঙ্কিত করতে দেখি নিখুঁত পরম্পরায়।
‘আমি কোন ঘাটের কানাই’ কবিতায় কবি বেদনা এবং কামনাকে খুব সুন্দরভাবে সংহতি দিয়েছেন–
‘অন্ধকার ঘনীভূত জোড়ারোদ পোহায় কামনা
আমি যা দেখি না সখি, দেখি রেখা নধর বেদনা’
–বেদনা ও কামনার অপূর্ব সৌরভ কবিতার অন্তর্গূঢ় অবয়বে যথাযথভাবে বিবৃত ।
‘দেহের কি আঁশ’ কবিতায় রূপক ও উপমা চমৎকারভাবে প্রতিবিম্বিত;-
‘মানুষ প্রভাত জেনে এগিয়েছি, হৃদয়ে মিরাট
ছড়ানো নগ্নতা বুঝি প্রতিকূলে আমিই সম্রাট’
–গভীর মানবিক প্রেমের ঋদ্ধ বয়ান।
মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ব হচ্ছে মানুষ এবং মানব শূন্য পৃথিবী অর্থহীন। সুতরাং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে মানুষের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো দেশে বা রাষ্ট্রে মানুষের সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার বিনষ্ট হলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংগতি ও নৈরাজ্য দানাবাঁধে। এমন অসংগতি ও নৈরাজ্য প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্নভাবে সাহিত্য ও শিল্পের অনুষঙ্গ হয়েছে। কবির কাব্যে তার ব্যত্যয় ঘটেনি। সনেট গ্রন্থের আরও কিছু কবিতা উদ্ধৃত করছি, যেখানে সমাজ, রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থাপনা, সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রত্যক্ষ চিত্র খুব সূক্ষ্মভাবে অঙ্কিত হয়েছে।
‘রাষ্ট্র কোথায়’ কবিতায় রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থাপনার রুগ্ন চিত্র প্রতীয়মান ;-
‘এক ভৌগোলিক রাষ্ট্র আমরা তার–ই জনগণ
ভাঙতে ভাঙতে নিয়ে গেছি বহুদূর দিব্যমন।
প্রার্থনায় যত নত হয়েছি ঠেলেছি বহুদূর
আমার বাবার পাশে আটকে রয়েছে মূকরাষ্ট্র
সে আকাশ দীর্ণ রুগ্ন, ঘুম ভেঙেছে আসার স্বর
আমি কোন সে ধীহারা লুপ্ত উজবুক ধৃতরাষ্ট্র।’
এখানে গণতন্ত্র ও অধিকার বঞ্চিত জাতির মানচিত্র নিখুঁত বিন্যাসে ফুটে উঠেছে।
‘বিষাদকাল‘ কবিতার অন্তর অবয়বে বিবৃত হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নৈরাজ্য ও দুর্বৃত্তায়নের চিত্র।
‘মানুষ ও মানবের রং বেচে নিকট জনেরা
কেনে, সভ্য সমাজের একঝাঁক চণ্ডালেরা বাদী
স্নান–জলে রক্তবৃষ্টি নাইতে নেমেছে অসুরেরা
পুড়ছে—মানুষবন, জ্বলছে হাওয়া নিরবধি
এ শহরে কেউ ভালো নেই আজ যাকে ডাকি, আয়
কতদূর যাবে সেও দুঃখের বোরাকে নেবে ঠাঁই ……জাতি আজ অসংগতি ও অব্যবস্থাপনার গহীন অন্ধকারে নিমজ্জিত।
‘রক্তের দুধভাত‘ কবিতায় উঠে এসেছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বিপন্ন ও ভঙ্গুর রাষ্ট্রকাঠামোর অনন্য চিত্র;-
‘রাষ্ট্র কেন চায় রক্ত ছাত্ররা কেন যে দেয় বুক
এসবে মিলে না কথা বুঝি না তো রাষ্ট্রের অসুখ’।…. একটা জাতি আর কত রক্ত দেবে সুস্থ সুন্দর রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষায়? বিদ্যমান নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার শ্লোগান।
উল্লেখিত বিষয় ও ভাবনা নিয়ে আরও বেশকিছু কবিতা উদ্ধৃত ও আলোচনা করা যেতো। অনেকসময় আলোচনা প্রলম্বিত হলে পাঠকের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তাই আলোচনার মোহকে নিয়ন্ত্রিত করা শ্রেয় মনে করেছি। অনেক উত্তীর্ণ সনেট আছে এই গ্রন্থে। আশা করি, আগামীতে কবি চিরায়ত অভ্যাসে আরও কিছু সনেট আমাদের উপহার দেবে যা হতে পারে মানব সংহিতা। এটি হতে পারে আশা, দুরূহ কিছু নয়! আমার বিশ্বাস, আলোচ্য সনেট গ্রন্থের দুই–তৃতীয়াংশ সনেট নিঃসন্দেহে পাঠককে আকৃষ্ট করবে। কবির জন্য শুভ কামনা ও ভালোবাসা রইলো।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।