বিতর্ক হলো যুক্তি আর কল্পনা দিয়ে নিজের মত প্রমাণ করার চেষ্টা

সাইফ চৌধুরী | সোমবার , ১৪ জুলাই, ২০২৫ at ৮:০০ পূর্বাহ্ণ

আমরা প্রতিদিনই অনেক বিষয়ে কথা বলি, মত দিই, অন্যের কথা শুনি। কিন্তু এসব কথার মধ্যে কিছু কথা থাকে খুব গুছানো, কিছু মত থাকে ভেবেচিন্তে বলা। এই ভেবেচিন্তে বলা, অন্যের যুক্তিকে খন্ডন করা, নিজের মতকে জোরালোভাবে তুলে ধরাএটাই হলো বিতর্ক। বিতর্ক কেবল মতের অমিলের প্রকাশ নয়; এটি একটি মননশীল চর্চা, যেখানে যুক্তির শৃঙ্খলা এবং কল্পনার বিস্তার সমন্বিত হয়ে সৃষ্টি করে চিন্তার নতুন দিগন্ত। বিতর্কের মঞ্চে একটি বক্তব্য শুধু তার তথ্যভিত্তিক শক্তির জন্যই মূল্যবান হয় না, বরং সেই বক্তব্য কীভাবে উপস্থাপন করা হয়, কীভাবে তা শ্রোতার চেতনাকে স্পর্শ করে, সেই সৃজনশীল প্রকাশভঙ্গিও তার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এ কারণেই বলা যায়, বিতর্ক হলো এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে যুক্তি ও কল্পনার এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটে।

বিতর্ক শুধু তর্ক নয়। বিতর্ক এমন একটি খেলা, যেখানে একদিকে থাকে শক্তিশালী যুক্তি, আর অন্যদিকে থাকে কল্পনা আর উপস্থাপনার সৌন্দর্য। তাই বলা হয়, বিতর্ক মানেই যুক্তি আর কল্পনার খেলা।

যুক্তির ভূমিকা:

বিতর্কের মূল শক্তি হলো যুক্তি। প্রতিটি দাবির পেছনে থাকতে হয় তথ্যপ্রমাণ, বিশ্লেষণ ও বিচারবোধ। যুক্তি মানুষকে আবেগের বাইরে এসে বাস্তবতা, কারণ ও ফলাফলের ভিত্তিতে চিন্তা করতে শেখায়। একজন বিতার্কিক যখন যুক্তিপূর্ণভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন, তখন শ্রোতারা শুধু তার বক্তব্যের পক্ষেবিপক্ষে যায় না, তারা নিজের চিন্তাকেও পুনর্গঠন করতে শুরু করে।

বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে পার্লামেন্টের বিতর্ক প্রক্রিয়া কেবল আইন পাশ করার মাধ্যম নয়, বরং তা যুক্তিভিত্তিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্র। শিক্ষাক্ষেত্রে বিতর্ক শিক্ষার্থীদের তথ্য খোঁজার দক্ষতা, বিশ্লেষণক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে। এইসব গুণাবলি শুধুমাত্র তর্ক জয়ের জন্য নয়, বরং জীবনের নানা জটিল প্রশ্নের উত্তরে যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তিখন্ডন পর্বে একজন বিতার্কিক যে সব বিষয় ভাবনায় আনে তা নিম্নে উদাহরণ স্বরূপ উপাস্থাপিত হল

) বিষয়: ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমাজে বেশি ক্ষতি করছে’

প্রতিপক্ষের যুক্তি: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে মানুষ একাকী হয়ে যাচ্ছে, সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে।

যুক্তি খন্ডন: কিছু মানুষ ভার্চুয়াল জগতে বেশি সময় কাটায়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই দূরত্ব ঘুচিয়ে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনেছে। গ্রামের কৃষক এখন তার ফসল অনলাইনে বিক্রি করতে পারছে, শিক্ষার্থী পাচ্ছে বিনামূল্যে শেখার সুযোগ, রেমিট্যান্সযোদ্ধারা রাখতে পারছে পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। অতএব, এটি বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং আধুনিক সংযোগের প্রতীক।

)বিষয়: “শিক্ষায় নারীর অগ্রগতি সমাজের জন্য হুমকিপক্ষে

বিরোধীপক্ষের যুক্তি: “নারীরা শিক্ষিত হলে তাদের পারিবারিক দায়িত্বে পরিবর্তন আসে।

যুক্তিখন্ডন: একজন শিক্ষিত নারী কেবল পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষনায় দেখা গেছে, শিক্ষিত মায়েরা সন্তানদের শিক্ষায় অধিক মনোযোগী হয়, ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মই উপকৃত হয়।”

) বিষয়: ‘পরীক্ষাই শিক্ষার একমাত্র মানদন্ড’

প্রতিপক্ষের যুক্তি: পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা কঠিন।

যুক্তিখন্ডন: পরীক্ষা শিক্ষার্থীর জ্ঞান যাচাইয়ের একটি পদ্ধতি হতে পারে, তবে তা কখনোই শিক্ষার একমাত্র মানদণ্ড হতে পারে না। কারণ একটি পরীক্ষা কেবল নির্দিষ্ট সময়ের প্রস্তুতি ও মুখস্থ শক্তি যাচাই করে, কিন্তু একজন শিক্ষার্থী কতটা বুঝেছে, প্রয়োগ করতে পারছে বা সৃজনশীল চিন্তা করতে পারছেতা বোঝা যায় না। প্রকৃত শিক্ষা মানে হলো বিশ্লেষণী ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ও সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ। তাই প্রকল্পভিত্তিক কাজ, প্রেজেন্টেশন, দলগত কার্যক্রম ও ধারাবাহিক মূল্যায়নএসবই শিক্ষার প্রকৃত মান যাচাইয়ের কার্যকর মাধ্যম। পরীক্ষার পাশাপাশি এই বিকল্প পদ্ধতিগুলোই শিক্ষার পূর্ণতা আনে।

বিতর্কে যুক্তিখন্ডনের সহজ কৌশল:

)প্রতিপক্ষ যে তথ্য বা পরিসংখ্যান দিচ্ছেন তা কতটা নির্ভরযোগ্য?

)বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরে দেখানো যে প্রতিপক্ষের যুক্তি সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

)প্রতিপক্ষের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে কী কী সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে তা ব্যাখ্যা করা।

)প্রতিপক্ষ কোনো ‘জেনারালাইজেশন’ বা ভুল ব্যাখ্যার আশ্রয় নিচ্ছে কি না তা তুলে ধরা।

) বিতর্কে যুক্তিখন্ডন হচ্ছে বিরোধীপক্ষের উপস্থাপিত যুক্তির ভুল, অসম্পূর্ণতা বা দুর্বলতা তুলে ধরে তা খণ্ডন করা। একজন দক্ষ বিতার্কিক কেবল নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন না, বরং প্রতিপক্ষের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে যুক্তি ভিত্তিকভাবে তা খন্ডনও করেন।

কল্পনার ভূমিকা:

যদিও বিতর্ক একটি যুক্তিনির্ভর কার্যকলাপ, তবুও এর সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে বক্তার উপস্থাপনা কৌশল, উদাহরণ বেছে নেওয়া, ভাষার শৈলী ও কল্পনাশক্তির উপর। কেবল তথ্য বললেই কথা প্রভাব ফেলে নাএকটি সঠিক রূপক, একটি নাটকীয় তুলনা বা একটি ভাবনাপ্রসূত দৃষ্টান্ত শ্রোতার মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে।

কল্পনাশক্তির মাধ্যমে বিতার্কিক এমন এমন প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পারেন যা অন্যকে ভাবতে বাধ্য করে। বিতার্কিক সমাজের বাস্তবতা থেকে শুরু করে কাল্পনিক পরিস্থিতি ব্যবহার করে বক্তব্যকে জীবন্ত করে তোলেন। বিতর্কে কল্পনার ব্যবহারে বক্তা তথ্য ও আবেগের ভারসাম্য রক্ষা করেন, যাতে বক্তব্য হয়ে ওঠে মনন ও হৃদয়ের সমন্বয়।

বিতর্কের দ্বৈত ভূমিকা: জ্ঞান ও মানবিকতা

বিতর্ক একদিকে জ্ঞানের গভীরতায় উন্নীত করে, অন্যদিকে মানবিক অনুভব জাগায়। কারণ বিতর্কের মাধ্যমে একজন মানুষ শুধু বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করেন না, বরং তিনি নিজেকে অপরের অবস্থান বুঝতেও বাধ্য হন। এটাই সমালোচনামূলক সহানুভূতিযেখানে আমি হয়তো আপনার সঙ্গে একমত না, কিন্তু আমি আপনার যুক্তির গঠন বুঝি, এবং সেটিকে সম্মান জানাই।

এই দ্বৈত মনোভাবই একজন বিতার্কিককে পরিণত করে সমঝোতাপূর্ণ, সহনশীল এবং চিন্তাশীল নাগরিকে। আজকের সমাজে যেখানে মতবিরোধ সহিংসতার রূপ নেয়, সেখানে বিতর্ক শেখায় মতবিরোধকে যুক্তির মাধ্যমে মোকাবিলা করা, ব্যক্তি নয়মতবাদকে আক্রমণ করা। এটি শুধুমাত্র মতবিরোধ নয় বরং আলোচনার মাধ্যমে নতুন ধারনা তৈরি এবং সমস্যা সমাধানের একটি প্রক্রিয়া।

যুক্তি ও কল্পনার মিলন: যখন যুক্তি আর কল্পনা একসাথে মিশে যায়, তখন বিতর্ক হয়ে ওঠে সুন্দর, প্রাণবন্ত এবং প্রভাবশালী। শুধু তথ্য দিলে তা হতে পারে কঠিন আর বিরক্তিকর। আবার কেবল কল্পনা দিলে তা হতে পারে আবেগনির্ভর আর দুর্বল।তাই একজন ভালো বিতার্কিক যে সব বিষয় চিন্তা বা প্রকাশ করেন যেমন:

)তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বক্তব্য শক্তিশালী বলয়ে আবদ্ধ করেন।

)কল্পনা দিয়ে তা আকর্ষণীয় করে তোলে ।

)আর উপস্থাপনায় রাখে ছন্দ ও আত্মবিশ্বাস।

) বিতর্কে মত গঠনের জন্য ভাবতে হয়।

) তথ্য খুঁজে নিতে হয় বই, ইন্টারনেট বা বাস্তব জীবন থেকে।

) অন্যের মতকে শুনে উত্তর দিতে হয়, যা ধৈর্য ধারণে সাহায্য করে।

শিক্ষা ও সমাজে বিতর্কের কার্যকারিতা:

বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের মৌখিক দক্ষতা, বিশ্লেষণক্ষমতা, নেতৃত্বগুণ ও দলবদ্ধভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দিনে দিনে বাড়ছে। বিতর্ক এসব দক্ষতা অর্জনের একটি বাস্তব ও কার্যকর মাধ্যম। একজন বিতার্কিক শুধু তর্ক করতে শেখে না, বরং শেখে কীভাবে কথা বললে তা প্রভাব ফেলবে, কীভাবে শ্রোতার মানসিকতা বুঝে তার সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া যায়।

অনেক দেশেই স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিতর্ককে পাঠ্য কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন বিতর্ক সংগঠন যেমন দৃষ্টি চট্টগ্রাম, চিটাগাং ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি,বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশন, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’ প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি প্রমুখ তরুণ প্রজন্মকে যুক্তিবাদী ও মানবিক নেতৃত্বে প্রস্তুত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

একজন ভালো বিতার্কিক তথ্য দেয়, কিন্তু একইসঙ্গে শ্রোতার মনে দৃশ্য তৈরি করে, যা শুধুমাত্র তথ্যের মাধ্যমে সম্ভব নয়, বরং কল্পনার প্রকাশেই সম্ভব। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিতর্ক শুধুই তর্কের বিষয় নয়, বরং চিন্তার নান্দনিক প্রকাশ।

বিতর্ক এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে যুক্তি ও কল্পনার সম্মিলন ঘটেএটি কেবল একটি বাক্য নয়, বরং একটি দর্শন। একটি সমাজে যুক্তির প্রসার ঘটাতে হলে কেবল তথ্যপ্রমাণ যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন এমন চর্চা, যেখানে যুক্তি ও কল্পনা হাত ধরাধরি করে চলে। বিতর্ক সেই চর্চার ক্ষেত্র, যেখানে একজন মানুষ নিজ চিন্তাকে গড়েন, ভিন্নমতকে বোঝেন এবং সমালোচনা ও সৃজনশীলতাদুইয়ের মধ্য দিয়ে প্রকৃত মননচর্চায় প্রবেশ করেন।

এই কারণেই বিতর্কের প্রয়োজন শুধু মঞ্চে নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে। পরিবারে, শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে ্ত সব জায়গায় যুক্তিনির্ভর ও কল্পনাশীল সংলাপ গড়ে তুলতে পারলে গড়ে উঠবে এক মানবিক, যুক্তিবাদী ও ন্যায়ের পথে চলা আলোকিত সমাজ।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআত্মিক উন্নয়ন
পরবর্তী নিবন্ধবিজ্ঞান আর নতুন ধর্ম