সমপ্রতি দেশে খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সকলকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব খুনের বেশির ভাগই ঘটেছে সামাজিক ও পারিবারিক কারণে। সাধারণত পারিবারিক কলহ, অর্থ লেনদেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হাতে এঁরা খুন হয়েছেন। আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, প্রতিদিন ব্যক্তিগত শত্রুতা, পারিবারিক বিরোধ, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক বিভেদ, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য–কত কারণেই মানুষ খুন হয়। মানুষকে খুন করায় মানুষের মধ্যে কোনো দ্বিধাও কাজ করে না! তাই বলে এভাবে একজন মানুষকে মারতে হবে? এভাবে হত্যার শিকার হতে হবে একটা তরতাজা প্রাণকে? রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় চাঁদা দাবি, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার দিকের ঘটনা। সংবাদমাধ্যমে খবরও হয়। মানুষ নিত্যদিনের ঘটনা হিসেবে এড়িয়েও গিয়েছে হয়তো। কিন্তু ঘটনার প্রায় দুই দিন পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই হত্যাকাণ্ডের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে। আর আমরা দেখলাম, এক ভয়ংকর মৃত্যু কিংবা বর্বরোচিত এক হত্যাকাণ্ডের বীভৎস দৃশ্য।
প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী রাফসান গালিব লিখেছেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে যেভাবে মানুষ বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বৈরাচারের সশস্ত্র গুন্ডা বাহিনীর বিরুদ্ধে, গুলির মুখে দাঁড়িয়ে যেতে ভয় করেনি; এক বছর পর সেই মানুষই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ‘উপভোগ’ করল! জুলাই নাকি মানুষকে সাহসী করেছে, মানুষকে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে, অপশক্তির সামনে মাথা নত না করতে শিখিয়েছে– এটিই কি তার নমুনা!’
পুলিশ সদর দপ্তরের এক হিসাবে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে শুধু রাজধানীতেই খুন হয়েছে ১৩৬ জন। সারা দেশে এই সংখ্যা ১ হাজার ২৪৪ জন। যা বিগত বছরগুলোর একই সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ঢাকায় এই সংখ্যা ছিল ৫৫ জন, ২০২২ সালে ৫৪ জন, ২০২৩ সালে ৫১ জন এবং ২০২৪ সালে ছিল ৪৭ জন। গত জানুয়ারিতে ঢাকায় খুন হয়েছেন ৩৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে খুন হয়েছেন ৩৮ জন, মার্চে ৩৩ জন এবং এপ্রিলে ২৯ জন। সারা দেশের হিসাবে জানুয়ারিতে ২৯৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩০৮ জন, মার্চে ৩১৬ জন এবং এপ্রিলে খুন হয়েছেন ৩৩৬ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দীর্ঘদিন বিদেশে পলাতক আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়ারা তৎপরতা বাড়িয়ে দেওয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করা এসব সন্ত্রাসী তাদের সহযোগীদের দিয়ে একের পর এক অপরাধ সংঘটিত করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিচ্ছে। আবার আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে জড়াচ্ছে খুনোখুনিতেও। এমন পরিস্থিতিতে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৫ আগস্টের পরে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার কারণে অন্য অপরাধীরাও উৎসাহিত হয়। তারাই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, খুন ও আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব অপরাধীর বিষয়ে পুলিশের কোনো নজরদারি নেই। কারণ পুলিশকে বহুমুখী কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। প্রতিদিন আন্দোলন–সংগ্রাম, আসামি গ্রেফতার ও মামলা তদন্ত রয়েছে পুলিশের।
বর্তমানে যে সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থা তাতে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অশান্তি বাড়ছে। ফলে মানুষের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছে। আর এ হতাশা থেকে তার মধ্যে এক ধরনের আগ্রাসী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তির মধ্যে নেতিবাচক দিকগুলো ফুটে ওঠে। সে আত্মবিশ্বাসী হয় না। তার মধ্যে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি কাজ করে। নৃশংস হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্যক্তি নিজে যেমন অন্যকে ধ্বংস করতে চায়, অন্যদিকে সে নিজেও এর শিকার হয়। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারসহ আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। এ নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। সর্বোপরি বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।