নির্বাচন বাধাগ্রস্তকারীদের ভূমিকা রাজনৈতিক দল নয়, প্রেসার গ্রুপের মতো : খসরু

আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন মাঠের রাজনীতিবিদ

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৪ জুলাই, ২০২৫ at ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ

নির্বাচন ও গণতন্ত্র বাধাগ্রস্তকারীদের ভূমিকা রাজনৈতিক দল নয়, বরং প্রেসার গ্রুপের মতো বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে যারা বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে, অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে একটা অশান্ত রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক দল বলা যায় না। তাদের রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন। গতকাল রোববার বিকালে নগরের মুরাদপুরে এলজিইডি ভবনে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি আয়োজিত দলটির প্রয়াত ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান স্মরণসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। খসরু বলেন, আপনি রাজনৈতিক দল হয়েও নির্বাচনে যেতে চাইবেন না, নির্বাচন করতে দিবেন না, নির্বাচনে যেতে দিবেন না, তাহলে তো আপনি প্রেসার গ্রুপের কাজ করেন, রাজনীতি করার কী দরকার? প্রেসার গ্রুপেরও একটা দায়িত্ব আছে তো। আপনি প্রেসার গ্রুপের কাজ করেন, আর যারা রাজনীতি করতে চায় তারা রাজনীতি করুক।

তিনি বলেন, লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে বৈঠক হয়েছে সেখানে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের নির্বাচিত সংসদ গঠন করে মানুষের যে আশাআকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণ তা আলোচনায় উঠে এসেছে। এই প্রত্যাশা পূরণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই।

আমীর খসরু বলেন, এই কমিশন, সেই কমিশন, কোনো কমিশন দেশের মানুষের মনের ভাষা বুঝবে না। মানুষের মনের ভাষা, প্রত্যাশা ধারণ করবে রাজনীতিবিদরা। ঢাকা শহরে দশজন বিজ্ঞ ব্যক্তি চেয়ারটেবিলে বসে দেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারবে না। তাদেরকে সেই দায়িত্ব কেউ দেয়নি। এই পরিবর্তন আসতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, নির্বাচনের মাধ্যমে, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে; যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। এই পরিবর্তন হবে টেকসই।

নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর সভাপতিত্বে স্মরণসভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, সহসাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, সিডিএ বোর্ড মেম্বার জাহিদুল করিম কচি, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এড. আবদুস সাত্তার ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য ইসরাফিল খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন নগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান।

আমীর খসরু বলেন, এরা বলছে ইলেকশনেরই দরকার নেই। শেখ হাসিনা তো তাও আমিডামি করে দেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এরা তো বলছে ইলেকশনেরই দরকার নেই, ইলেকশনের দিকে যাবারও দরকার নেই, ইলেকশনের প্রক্রিয়াও হতে পারবে না। তাহলে এদের কি রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য করা উচিত? এরা কি গণতন্ত্রের বিপক্ষের শক্তি নয়? এরা কি জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিপক্ষের শক্তি নয়? এরা কি জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার বিপক্ষের শক্তি নয়?

দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে খসরু বলেন, আমাদের কী করতে হবে? সহনশীলতার মাধ্যমে, পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ রেখে বিএনপির রাজনীতিকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এটাই হবে বিএনপির রাজনীতি। যে নতুন স্বপ্ন দেশের মানুষ দেখছে সেই স্বপ্ন বিএনপিকে দেখাতে হবে। যেটা তারেক রহমান দেখাচ্ছেন, উনার কথাগুলো খেয়াল করবেন। তারেক রহমান কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন না। তিনি বিএনপির কথাগুলো বলছেন, উনার কথাগুলো বলছেন।

তিনি বলেন, যাদের বক্তব্যের মধ্যে অশ্লীলতা আছে, সম্মানবোধ ও সহনশীলতা নেই, তার বিপরীতে বিএনপির রাজনীতি হচ্ছে সহনশীলতা, সম্মান, শান্তিপূর্ণ অবস্থান, দেশ গড়ার এবং মানুষের নতুন স্বপ্ন গড়ার প্রত্যয়ের রাজনীতি। যারা দেশের রাজনীতিকে আবার কলুষিত করতে চাচ্ছে তাদের দেশের জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে।

আমীর খসরু বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর মানুষের মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। সেটা ধারণ করতে না পারলে কোনো দল রাজনীতি করতে পারবে না। আমরাও যদি ধারণ করতে না পারি তাহলে সামনে পথ চলা কঠিন হবে। তিনি বলেন, অনেকেই জিয়াউর রহমানের ছবি পদদলিত করেছে। এটি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুঃখজনক। এখন আমাদের সহনশীল রাজনীতি করতে হবে। কারো বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করলেও সম্মান দেখাতে হবে।

নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, রাজনীতিতে মাথা গরম করলে হেরে যাবেন। মাথা গরম করা যাবে না। তারা যে কাজগুলো করছে, দেশের মানুষ জবাব দিবে। আমাদের কাজ হচ্ছে যার জন্য আমরা লড়েছি, ত্যাগ স্বীকার করেছি, গুম, খুন হয়েছি, পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুবরণ, চিকিৎসা ছাড়া মৃত্যুবরণ, লাখ লাখ মানুষ মিথ্যা মামলার শিকার; কী জন্য? একটা গণতান্ত্রিক দেশ দেখতে চাই বলে, একটা স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ দেখতে চাই বলে। যে দেশে আমার ভোটাধিকার হবে, প্রতিনিধি নির্বাচন করব, আমার প্রতিনিধির আমার কাছে জবাবদিহি থাকবে, সেই দেশ গড়ার জন্য আমরা ত্যাগ স্বীকার করেছি।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করার জন্য আমরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছি, এর মূল কারণ ছিল আমরা যাতে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি। তাই সে দল, তারেক রহমান, আমার বিরুদ্ধে বা যার বিরুদ্ধেই বলুক, আমার মত হচ্ছে, তার সেই স্বাধীনতা আছে বিরুদ্ধে বলার। বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতি হবে সে রকম। আমাদের নতুন আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে দেশের নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবর্তন করতে হবে। দেশের রাজনীতিতে যদি রাজনৈতিক চরিত্র, সংস্কৃতি না বদলায় তাহলে কোনো সংস্কারে কাজ হবে না। সুতরাং বিএনপি সেই রাস্তায় করছে। তারেক রহমান সেই রাস্তায় করছেন। আমাদের সকলকেই সেই রাস্তায় করতে হবে।

আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন মাঠের রাজনীতিবিদ : আবদুল্লাহ আল নোমানের রাজনৈতিক জীবনের প্রশংসা করে আমীর খসরু বলেন, নোমান ভাই ছিলেন মাঠের রাজনীতিবিদ। পর্যায়ক্রমে উঠে আসা নেতা। নেতাকর্মীদের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে তাদেরকে নেতৃত্ব দিয়ে, সুসময়েদুঃসময়ে তাদের পাশে থেকে দেশজাতির খেদমত করা, দলকে সমুন্নত রাখা, আন্দোলনে সংগ্রামে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে নেতৃত্ব দেওয়া, দেশের উন্নয়নে কাজ করা; যেটা একজন রাজনীতিবিদের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আবদুল্লাহ আল নোমানের সেই গুণাবলী ছিল। বাংলাদেশে এখন নোমান ভাইয়ের মতো নেতা খুবই কম।

তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে চট্টগ্রাম মহানগরে নির্বাচন থেকে শুরু করে রাজনীতিতে নোমান ভাইয়ের সাথে গভীরভাবে একসাথে কাজ করেছি। বিশেষ করে চট্টগ্রাম মহানগরীতে আমরা যারা এমপি হয়েছি, একসাথে রাজনীতি করেছি, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ১৯৯৬ পরবর্তী যে আন্দোলন সেটা কিন্তু কঠিন আন্দোলন ছিল। এরশাদের সময়ে আন্দোলনটা এক ধরনের ছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনে গতবার যে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে আর ততবার টিয়ার গ্যাস এবং পুলিশের নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের সকলকে মিলে। এর পরবর্তী শেখ হাসিনার স্বৈরাচার হয়ে ওঠা, ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা; তার বিপক্ষে প্রতিপক্ষ হয়ে রাজনীতি করা আরো কঠিন ছিল। সেখানেও নোমান ভাইসহ আমরা একসাথে মাঠে থেকে দুঃসাহসের সঙ্গে রাজনীতি করেছি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসলে দুঃসাহসের সঙ্গে রাজনীতি করতে হয়। এই দুঃসাহস নোমান ভাইসহ আমরা সবাই মিলে দেখিয়ে দিয়েছি। সেটা পরবর্তীতে অব্যাহত থেকে গত আগস্টে পতন হয়েছে।

মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমানের হাত ধরেই আমরা রাজনীতি শুরু করেছি। বিএনপির রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অনন্য এক নেতা। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে দলকে সুসংগঠিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে গিয়ে তিনি কমিটি করে দিতেন। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আজকে বাংলাদেশের নির্বাচনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। একটি দল তারেক রহমানকে নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। যারা নির্বাচনে পরাজিত হবে জানে তারাই এই নির্বাচন চায় না। তবে ওদের উসকানিতে আমাদের সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।

ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি ছিলেন এক অবিচল যোদ্ধা। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং আজীবন জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকা অবিস্মরণীয়। চট্টগ্রামের উন্নয়নে আবদুল্লাহ আল নোমানের অবদান চিরস্মরণীয়। চট্টগ্রামের ব্যবসাবাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, স্বৈরাচার বিরোধী ৯০এর গণ আন্দোলনে শহীদের স্মৃতি রক্ষায় প্রতিষ্ঠা করেন এন এম জে মহাবিদ্যালয়। জনগণের কল্যাণে তাঁর নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ আজও চট্টগ্রামের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।

এরশাদ উল্লাহ বলেন, বিএনপির রাজনীতিতে আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন একজন কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অনন্য এক নেতা। তিনি কেবল চট্টগ্রাম নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে এক কিংবদন্তি পুরুষ। তিনি ছিলেন নেতাদের নেতা, আমাদের সবার অভিভাবক। চট্টগ্রামে আশির দশকে শহীদ জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পরে বিএনপি অনেকটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। তখন বিএনপিকে পুনর্জাগরণ করেছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। ৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পরে বিএনপিকে ক্ষমতায় নিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আবুল হাশেম বক্কর বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন এক আপসহীন নেতা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সম্মুখ সারির যোদ্ধা। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তার অবদান জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। নোমান ভাই শুধু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা। তার সাহস, সততা এবং দেশপ্রেম আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয়।

নাজিমুর রহমান বলেন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নোমান ভাইয়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার এক দফার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি শুধু নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। বিএনপির রাজনীতিতে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজরুরি অবস্থা ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য : আলী রীয়াজ
পরবর্তী নিবন্ধচিহ্নিত অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের ধরতে চিরুনি অভিযান : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা