জওশন আরা রহমান :ও আলোর পথ যাত্রী!

অভীক ওসমান | শুক্রবার , ১১ জুলাই, ২০২৫ at ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ

২০০২ সালে আমি ও আমার বন্ধু জাকিয়া হোসেন (সেবা চৌধুরী) যৌথভাবে ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরীর অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’ সম্পাদনা করতে গেলে মাহবুবউল আলম চৌধুরীর একটা লেখা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। চৌধুরী তখন অসুস্থ। এই প্রেক্ষাপটে জওশন আরা রহমানের সাথে আমার পরিচয় ও ফোনালাপ হয়। তিনি অত্যন্ত যত্ন সহকারে মাহবুবউল আলম চৌধুরীর একটা লেখা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। জওশন যাঁর নামের অর্থ আলোকিত করে যাওয়া। সূচনালগ্নেই তিনি একটা মুগ্ধতার ছাপ রেখে যান।

জওশন আরা রহমানের ‘স্মৃতিকথা একটি অজানা মেয়ে’ গ্রন্থের ভূমিকায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস লিখেছেন, ‘কোন মহাকবি কিংবা কালজয়ী ঔপন্যাসিক যদি বৃটিশ ভারত, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলমান নবজাগরণ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, হিন্দুমুসলমান সংঘাত, বাঙ্গালীঅবাঙ্গালী সম্পর্ক, সামাজিক বিপ্লব, মুক্তিযুদ্ধ, নারী আন্দোলন, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার ভূমিকাকে ঘিরে একটি সুদীর্ঘ মহাকাব্য কিংবা উপন্যাস রচনা করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র খুঁজতেন, তাহলে জওশন আরাকে বাছাই করলে তিনি মোটেই ভুল করতেন না।’ (মে ২০০৫)

মৃত্যুর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রদত্ত শোকবার্তায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘হঠাৎ জওশান আরার মৃত্যু সংবাদ শুনে মনটা দুঃখে ভরে গেলো। অনেক দিন যোগাযোগ নেই সেটা একরকম কথা। কিন্তু একেবারে আমাদের চিরতরে ছেড়ে চলে যাবে সে কেমন কথা! কলেজে পড়ার সময় জওশন আরার সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিনি কলেজে আমার দুই বছরের সিনিয়র। বিবাহিতা। একটি কন্যা সন্তানের জননী। তার সাতআট বছরের মেয়ে মুন্নির সঙ্গে আমার খুব ভাব। তাঁর স্বামী মাহবুবউল আলম চৌধুরী নামকরা কবি ও ব্যবসায়ী। গ্রামীণ ব্যাংক যখন শুরু করি তখন তিনি একাজে খুবই উৎসাহিত হয়ে পড়লেন।

জওশন আরা আমাদের কাজকর্ম যতই দেখলেন ততই উৎসাহিত হয়ে পড়লেন। আমাদের কাজের সঙ্গে ইউনিসেফকে যুক্ত করতে চাইলেন। তিনি আমাদের কাজগুলোকে এগিয়ে নেবার জন্য উৎসাহী হলেন। গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের নারী উন্নয়ন কর্মসূচি গঠনে অনেক সাহায্য করলেন। আমাদের মহিলা কর্মশালাগুলি ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালনা করার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর সহযোগিতা এবং উৎসাহে গ্রামীণ ব্যাংকের মহিলাদের জীবনী নিয়ে একটা সংকলন তৈরি করলাম। নাম দিলাম ‘বেলতৈল গ্রামের জরিমন’। বইটি খুবই জনপ্রিয় হলো। মানুষের মনকে খুবই নাড়া দিলো। অনেকে ইংরেজি অনুবাদ চাইলো। ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলো। বইটি এখনো পৃথিবীর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপারিশকৃত পাঠ্যদের তালিকায় থাকে।

গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক বাড়ি বাড়ি নলকূপ স্থাপনের যে কর্মসূচি নিয়েছিলাম তার জন্য কারিগরি সাহায্যের ব্যবস্থাও জওশন আরা করে দিয়েছিলেন। জওশন আরা আমাদের শাখাগুলি পরিদর্শনের জন্য অনেক আন্তর্জাতিক পরিদর্শক নিয়ে আসতেন। কলেজ জীবনে তাঁর বাড়ি ছিল আমার আড্ডার একটা প্রিয় স্থান। এখানে আমি প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যা তাঁর পরিবারের সাথে কাটাতাম এবং আমাদের প্রিয় বিষয়গুলি নিয়ে তর্ক করতাম। পরবর্তীতে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব শীর্ষ মহিলা সেসময় নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথম সারির। কলেজ জীবনে আমাদের আলাপের একটা বড় বিষয় থাকতো মহিলাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

মৃত্যুর আগে ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তাঁকে সমাজ, শিশু, নারী মানবাধিকার কর্মী, সংগঠক, ভাষা সংগ্রামী হিসেবে আখ্যায়িত করে একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করা হয়। মূলত উপর্যুক্ত বর্ণনায় জওশন আরা রহমানের নিখিল জীবন ও কর্মের পরিচয় পাওয়া যায়।

এই প্রেক্ষাপটে একজন রক্ষণশীল চট্টগ্রামের মুসলিম নারী মানবসেবা, সাহিত্যসংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অগ্রপথিক হওয়া বিস্ময়ের ব্যাপার। তাঁর স্মৃতিকথায় ‘পুকুর পাড়ের কালো মেয়ে’ সূচনা অধ্যায় দিয়ে অত্যন্ত কাব্যিক ভাষায় তাঁর চুনতী গ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন। একটা বংশলতিকায় দেখা যায় হযরত ওমর ফারুকের রাজত্বকালে তাঁদের পূর্বতন পুরুষ শাহ আবদুর রহমান প্রথম আগমন তবলিগি মিশন নিয়ে আসেন। তাঁদের সপ্তম অধস্তন পুরুষ শুকুর আলী মুন্সেফের কথা বলেছেন। যার নামে বর্তমানে রুমঘাটা গলি খ্যাত হয়েছে। তাঁর পিতা সাবরেজিষ্ট্রার মাহবুবুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধির মানুষ। তাঁর মা সাদীদা খানম আট সন্তান, বাবার ভাষায় ‘আট অট্টালিকাকে’ কড়া শাসনে মানুষ করেছেন। বাবা ও মা গ্রামের বাড়িতে শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁদের বারান্দায় সংগীতচর্চা হতোরবীন্দ্রগীত ও নজরুলগীতির প্রাধান্য ছিল বেশি। নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ছিল তাঁদের সাংস্কৃতিক প্রেরণার উৎস।

ভাইবোনদের মধ্যে বড় ভাই প্রফেসর হাবিবুর রহমান ১৯৫৩ সালে চীফ ইকোনেমিস্ট হিসাবে যোগ দেন। ১৪ এপ্রিল ১৯৬২ তে তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। মেজ ভাই লুৎফুর রহমান ব্রিটিশ কোম্পানিতে চাকরি, পরে ব্যবসা শুরু করেন। আবু মোহম্মদ শাহাবুদ্দিন বাম ঘরানার রাজনীতি করতেন, ডাকসু সদস্য ছিলেন (১৯৪৯৫১)। শহীদ সাবের তাঁর বন্ধু ছিল। ফরিদ ভাই সিএসপি হিসেবে সচিব ও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তার ভাবীরাও মহিয়সী রমণী ছিলেন। বড় বোন হুসনুন নাহার চৌধুরীর স্বামী মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। মেজ দুলাভাই প্রফেসর আবদুল ওয়ালী ৭১এ শহীদ হন। ছোট বোন জাহানারা ইসলাম জুবলির স্বামী প্রফেসর জাতীয় অধ্যাপক ও নজরুল গবেষক ড. রফিকুল ইসলাম।

জওশন আরা রহমান গুলএজার বেগম, কুসুমকুমারী, সর্বশেষ খাস্তগীর স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। এইসব স্কুলে পড়ার সময় তাঁর অনেক মহীয়সী শিক্ষিকা ও সহপাঠীদের সঙ্গে পরিচয় হয়। এমনকি বিয়ের পর হরিখোলার মাঠের বিপরীতে বাসায় থাকার সময় আরতি দত্ত তার সাথে দেখা করতে আসেন। তাঁর স্বামী সুধাংশু বিমল দত্ত একজন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ও মাহবুবউল আলম চৌধুরীর বন্ধু। খাস্তগীর স্কুলে পড়ার সময় শনিবার ও রোববার কলিম শরাফীর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতেন।

১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সময় খাস্তগীর স্কুল থেকে মিছিলে জওশন অংশগ্রহণ করেন, তখন তালেয়া রহমান, প্রতিভা মুৎসুদ্দির নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে একদল ছাত্রী মিছিলে যোগ দেন। কথাসাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরী ভাষাসৈনিক ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র লেখক মাহবুবউল আলম চৌধুরীর সাথে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব দেন। প্রথমে জওশন তার প্রতিবাদ করেন, পরে প্রথম দেখা, প্রথম প্রেম ইত্যাদির মাধ্যমে ১০ অক্টোবর ১৯৫২ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ে উপলক্ষে দেশবিদেশ থেকে অনেক শুভেচ্ছা বাণী আসে। সুচরিত চৌধুরী এবং মাসিক উদয়ন পত্রিকার সম্পাদক রুহুল আমীন নিজামীর সম্পাদনায় পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী বিজন চৌধুরীর প্রচ্ছদ দিয়ে একটি সংকলন বের করেন। সবচেয়ে মজার বিষয় বিয়ের পরের দিন জওশনের দামী নেকলেসটি মাহবুবউল আলম চৌধুরী নিয়ে রাজনৈতিক দলের ফান্ডে জমা দেন।

মুক্তিযুদ্ধ :

মুক্তিযুদ্ধ : রুদ্ধশ্বাস নয় মাস’ স্মৃতিকথায় জওশন আরা রহমান লিখেছেন, মাহবুবকে আশ্রয় দিতে ভয়, গ্রামে গ্রামান্তরে ছুটে বেরিয়েছেন। পরবর্তীতে অবশ্য জওশন আরা রহমান নিজ কর্মস্থলেও যোগ দিয়েছেন। তার জীবনের স্ক্যাচটা পেশ করা গেল

১৯ অক্টোবর ১৯৩৬, চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন সাতকানিয়া থানার চুনতী গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুন্সেফ পরিবারে তার জন্ম। ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম শহরের বিখ্যাত ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৫৫১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে বি.এ পাস করেন। সমাজকল্যাণ বিভাগে চাকরিতে থাকাকালীন ১৯৬৪১৯৬৫ সালে কলম্বোপ্ল্যান স্কলারশীপ নিয়ে দু’বছরের জন্য নিউজিল্যান্ডে যান। ওয়েলিংটনে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সোস্যাল সায়েন্সএ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে চাকরিরত অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তৎকালীন ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে এম. . পাস করেন।

বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ জওশন আরা রহমানের কর্মময় জীবন। প্রথমে নারীউন্নয়ন কর্মসূচি প্রধান এবং পরবর্তীতে প্রোগ্রামপ্ল্যানিং সেকশনের প্রধান হিসেবে ইউনিসেফে সাড়ে সতেরো বছর কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেন। এসব কর্মসূচিতে নারীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে তাঁর অবদান সর্বজন স্বীকৃত। এই সুদীর্ঘ সময়ে নারী উন্নয়ন এবং শিশু অধিকার বিষয়ে তার বিভিন্ন লেখা দেশবিদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপানো হয়। এর আগে তৎকালীন সমাজকল্যাণ বিভাগে সাড়ে আঠারো বছর বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামে শহর সমাজকল্যাণ অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে ১৯৭৫ সালে গ্রামীণ সমাজকল্যাণ ‘মাদার্স ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৯ সালে ইউনিসেফে যোগদান করেন। তিনি লেখাপড়া, প্রশিক্ষণ, কনফারেন্স ইত্যাদিতে যোগদানের জন্য আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার প্রায় ত্রিশটি দেশ ভ্রমণ করেন।

জওশন আরা রহমানের পেশার বিষয়ে আমি আলোকপাত করিনি। তাঁর নারীর ক্ষমতায়ন, সাহিত্যসংস্কৃতির প্রতি নিবেদন সর্বোপরি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর গৃহিনী, সচিব, সখা হিসেবে তাঁর নিরন্তর সংগ্রামকে আমরা কুর্নিশ জানাই। তাঁকে মাদার তেরেসা, সিস্টার নিবেদিতা বা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর সাথে তুলনা করছি না। তবে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর জয়িতা হিসেবে তিনি দুই শতাব্দীর কালের কেন্দ্রীয় চরিত্র।

লেখক: কবি, নাট্যকার ও উন্নয়ন গবেষক, সাবেক সচিব, সিসিসিএনআই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভিশপ্ত ইহুদি জাতির করুণ ইতিহাস
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা