কিছু মানুষ আছেন যারা তাঁর প্রতিভা ও কর্মক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করেন না, নতুবা এ ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। প্রচার–প্রচারনার আলোয় গা ভাসানোয় অনীহাও তাঁদের প্রবল। তেমনি একজন মাহবুব উল আজাদ চৌধুরী। প্রথম জীবনে এই নামে লেখালেখির জগতে সক্রিয় থাকলেও পরে ‘মাহবুব আজাদ‘ এই সংক্ষিপ্ত নামেই লিখে গেছেন। লিখেছেন তুলনামূলক কমই। কিন্তু যা লিখেছেন তা আমাদের সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার মতই। দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি ঋদ্ধ একজন লেখক, গবেষক। শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। ছিল সমাজবদলের বিপ্লবী অঙ্গীকার, ছিলেন সাম্যবাদী সমাজ গঠনের এক সিরিয়াস যোদ্ধা। এমন একজন সক্রিয় বহুমাত্রিক লেখক, গবেষক কী কারণে যেন শেষ সময়ে এসে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন সকল সামাজিকতার ঘেরাটোপ থেকে। কোথাও কোন অভিমান বা বিতৃষ্ণা হয়তোবা ছিল, কিন্তু তা প্রকাশ করেন নি কারো কাছে।
গত ৯ জানুয়ারি মাহবুব –উল–আজাদ চৌধুরী ৭৭ বছর বয়সে দোহাজারীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ–বাঁটোয়ারা হওয়ার পর মাহবুব আজাদ বেশকিছু জমিজমার মালিক হন। সেসব জমি যারা চাষাবাদ করতেন তাদের সাথে মাঝেমধ্যে তিনি যোগাযোগ করতেন, এসে খাজনাপাতি আদায় করে আবার ফিরে গিয়ে নিরুদ্দেশ হতেন। আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় জীবন যাপন করছিলেন। তবে নিজের ভাগের ভিটের চারপাশে বাউন্ডারি ওয়াল করে লোহার গ্রিলের গেটও দিয়েছিলেন একমাত্র কন্যাকে বাড়ি করে দেবেন বলে। তাঁর মেয়ে রুচিরা আজাদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বহুজাতিক একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কর্মরত আছেন।
মৃত্যুর ক‘দিন আগে তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসলে মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে চট্টগ্রাম শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুটা সুস্থতা বোধ করলে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়মিত পরিচর্যার জন্য বাড়ির কাছে দোহাজারীর একটি হাসপাতাল বেডে রাখা হলে সেখানেই তিনি মারা যান।
পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন অধ্যাপনা দিয়ে। নিজ গ্রামে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক ঘেঁষে উত্তর সাতকানিয়া জাফর আহমদ চৌধুরী কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। পরে তিনি চলে যান ঢাকায়। সেখানে যুক্ত হন সাংবাদিকতা পেশায়। শেষে বাংলা একাডেমীতে যোগ দিয়ে সেখান থেকেই উপপরিচালক পদ থেকে অবসরে আসেন। বাংলা একাডেমিতে দায়িত্ব পালনকালেও সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক একটুও ছিন্ন করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি, কবিতা চর্চা, সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও চলচ্চিত্র প্রকাশনাসহ একাধিক সৃজনশীল মাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। চবি ক্যাম্পাসে থাকাকালীন তাঁর সম্পাদিত ‘ক্যাম্পাস ককাস’ নামে জার্নালটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তখনকার সময়ে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সারাদেশে অসংখ্য সংকলন প্রকাশিত হত বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে। ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম থেকে ‘পদাতিক‘ নামে মানসম্পন্ন একটি সংকলন নিয়মিত প্রকাশ করত। ১৯৭৬-’৭৭ সালে মাহবুব–উল–আজাদ চৌধুরী সম্পাদিত ‘পদাতিক’, শ্রেষ্ঠ সম্পাদনার জন্য ‘মুক্তধারা’ পুরস্কার লাভ করে। এছাড়াও তাঁর সম্পাদিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-‘সিনেলোক’ (চলচ্চিত্র বিষয়ক জার্নাল), ‘স্মৃতিসত্তায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী’। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে কথাশিল্পী ‘সুচরিত চৌধুরী’ ও বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ‘খান আতাউর রহমান’ এবং ‘বুলবুল চৌধুরী ‘-এর জীবনীগ্রন্থ। এছাড়া বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শতবর্ষে জসীমউদ্দীন’ স্মারক গ্রন্থের এবং সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’–এর সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। বাংলা একাডেমি থেকে অবসরের আগ পর্যন্ত ছিলেন ‘ধানশালিকের দেশ’–এর নির্বাহী সম্পাদক। পাশাপাশি তিনি শিশু–কিশোরদের জন্যেও লিখেছেন। ‘জয়তী যখন মুক্তিযোদ্ধার বন্ধু ছিল’ কিশোরদের জন্য তাঁর প্রথম প্রয়াস। শিশু একাডেমি প্রকাশ করেছে তাঁর লেখা ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ’–এর জীবনী – জীবনীমূলক শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ‘অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার‘-এ ভূষিত হয়েছেন। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথের অভিভাষণ: পূর্ববঙ্গ ও অন্যত্র‘, ‘রবীন্দ্রনাথের কতিপয় চিঠি‘, আবু সাঈদ চৌধুরীর ‘স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি ও অন্যান্য‘, ‘বিজ্ঞানের বিচিত্রপাঠ‘, ‘বিজ্ঞানের আনন্দপাঠ‘, ‘চলচ্চিত্র নির্মাণের কলাকৌশল‘ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মাহবুব আজাদ চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তখন তিনি পটিয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সংগঠক ছিলেন। সে সময় ভারতের সীমান্ত পার হয়ে দেমাগ্রি সেনানিবাসে প্রশিক্ষণ শেষে ১নং সেক্টরে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন পটিয়া থানা কমিটির সভাপতি এবং পরে চট্টগ্রাম জেলা কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং সহসভাপতি হিসেবে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাতকানিয়া উপজেলার কালিয়াইশ ইউনিয়নের রসুলাবাদ গ্রামে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন,যে পরিবারটি সম্পূর্ণ অসামপ্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় সমৃদ্ধ। তাঁর পিতা আলী আহমদ চৌধুরী ছিলেন এলাকার একজন প্রভাবশালী সমাজ সংগঠক, যিনি রসুলাবাদ সিনিয়র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। মাহবুব আজাদরা চার ভাইয়ের তিনজনই এখন প্রয়াত।
এরমধ্যে বড়ভাই সৈয়দ–উল–আজাদ চৌধুরী একজন প্রখ্যাত বাম রাজনীতিবিদ। ১৯৭৩ সালে বর্তমান চন্দনাইশ– সাতকানিয়া আংশিক আসনে ন্যাপ (মোজাফফর) প্রার্থী হিসেবে প্রবল প্রতিদ্বন্ধী ছিলেন। তাঁর বয়স এখন ৯৪ বছর। দ্বিতীয় ভাই শামস–উল আজাদ চৌধুরী পারিবারিক এস্টেট সামলাতেন, তৃতীয়জন রফিক–উল–আজাদ চৌধুরী ছাত্র জীবনে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং পরে ব্যবসা–বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন। একই ইউনিয়নের কাটগড় গ্রামের সমাজপতি আমীর আলী চৌধুরী তাঁদের নানা এবং আমার বাবা এয়াকুব আলী চৌধুরী মামা। আমি মাহবুব দা’র মামাতো ভাই এবং বয়সে তাঁর অনেক ছোট হলেও রাজনৈতিক মতাদর্শগত ঐক্যের কারণে আমার সাথে ছিলো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
২০২৩ সালে গ্রামে সর্বশেষ দেখা ও আলাপ হয়। বলেছিলেন ঢাকায় গেলে ফোন করতে। কিন্তু এরপর তিনি ফোনে তাঁকে কখনোই পাইনি। হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় আমাকে দেখে তিনি অস্পষ্ট উচ্চারণে অনেক কথা বলতে চেয়েও বলতে পারেন নি। বলেছিলেন তাঁর জন্য একটা দামী স্মার্ট ফোন কিনে নিয়ে যেতে, টাকা তিনি দেবেন। কিন্তু তাঁর হাতে সেই ফোন আর তুলে দেওয়া হল না। জানা হল না তাঁর না বলা কথা।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।