মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে তিন দিন ধরে পাহাড়ে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন জায়গায় গাছ উপড়ে পড়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ছেড়ে বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে মাইকিং করছে প্রশাসন, সতর্কতা জারি করা হয়েছে। প্লাবিত এলাকার জনগণ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল থেকে মেরুং ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠতে শুরু করেছে। এতে চিটাইগ্যাংয়া পাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ মেরুং বাজার লাগায়ো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়। দীঘিনালা–লংগদু সড়কের হেড কোয়াটার এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে মেরুং বাজার ডুবে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন ও রায়হানুল ইসলাম বলেন, এখানে তিন দিন ধরে টানা বর্ষণ হচ্ছে। মাইনী নদীর পানির প্রবাহ বেড়ে মেরুংয়ের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বৃষ্টির এখন যে পরিস্থিতি তাতে রাতের মধ্যে আরো কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হবে। অনেকগুলো পরিবার ছোট মেরুং বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
মেরুং ইউনিয়ন নারী ইউপি সদস্য ঝমিলা খাতুন বলেন, আমাদের নিচু এলাকা গত জুনের শুরুতেও ডুবেছে। এবারও একই অবস্থা। বৃষ্টি বাড়ছে। নদীতে পানি বাড়লে আমাদের মেরুং বাজারও ডুবে যাবে। ইতোমধ্যে ৫০টি পরিবার ছোট মেরুং বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে, আরো আসছে। তাদের জন্য সরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হবে। দীঘিনালা ২য় শ্রেণীর আবহওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের বেলুন মেকার সূভূতি চাকমা বলেন, বুধবার বিকেল পর্যন্ত ১০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে।
এদিকে খাগড়াছড়ি পৌর শহরের শালবন, কুমিল্লাটিলা, সবুজবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে স্থানীয়রা। পাহাড় ধসের শঙ্কায় রয়েছে সাড়ে তিন হাজার পরিবার। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা প্রশাসন। খাগড়াছড়ি জেলা সদরে তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রাণহানি এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ করেছে জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার। তিনি বলেন, পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে গেছে। কিন্ত বারবার অনুরোধ করার পরও তারা বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আসছে না। তারপরও আশ্রয় কেন্দ্রে আমরা গরম খাবার দিচ্ছি। খাবার নিয়ে তারা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। আমরা প্রচুর চেষ্টা করছি কিন্ত বাসিন্দারা আশ্রয় কেন্দ্রে আসছে না।
খাগড়াছড়ির সিন্দুকছড়ি–জালিয়াপাড়া সড়কের কয়েকটি এলাকায় মাটি ধসের ঘটনা ঘটেছে। খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, সিন্দুকছড়ি–জালিয়াপাড়া সড়কে কয়েকটি স্থানে সড়কের মাটি ধসে গেছে। সড়ক বিভাগের কর্মীরা গিয়ে মাটি সরিয়ে নেয়। এখন যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
বান্দরবান : বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বান্দরবানে বিভিন্নস্থানে পাহাড় ধসে পড়েছে। পাহাড় ধসে লামা মিরিঞ্জা এলাকায় সড়কে মাটি জমে যাওয়ায় লামা–আলীকদম, মিরিঞ্জা পর্যটন সড়ক যোগাযোগ সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্টদের তৎপরতায় কয়েকঘণ্টা পর যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। গতকাল বুধবার বিকেলে তিনটা পর্যন্ত সর্বশেষ ঘণ্টায় জেলায় ১০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির শঙ্কায় পাহাড়ের পাদদেশে ঢালুতে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো ছেড়ে স্থানীয়দের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। পাহাড়ি ঢল এবং টানা বৃষ্টিতে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানিও বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে।
প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টরা জানায়, পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলার সাতটি উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নে ২২০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এদিকে টানা ভারী বৃষ্টিতে লামা–আলীকদম, রুমা, থানচি, লামা–সূয়ালক, রোয়াংছড়ি–রুমা, থানচি–আলীকদম–সহ অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো পাহাড় ধসে সড়কে কাদা মাটি জমে সড়কগুলো পিচ্ছিল হয়ে বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। রুমা উপজেলার সদর ইউনিয়নের আশ্রমপাড়া এলাকায় একটি পাহাড় ধসে পড়েছে। গভীর রাতে টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে পাহাড় ধসে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বান্দরবান জেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সনাতন কুমার মন্ডল জানান, বৃষ্টিপাত আরও দু–একদিন অব্যাহত থাকবে। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি জানান, পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতোমধ্যে জেলার সাতটি উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী কর্মকর্তাদের নজরদারি বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কয়েকটি স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি হয়েছে, যা সংস্কারে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন।
রাঙামাটি : রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, পাহাড়ি জেলা রাঙামাটিতে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে ক্রমাগত বাড়ছে কাপ্তাই হ্রদের পানি। দেখা দিয়েছে পাহাড় ধসের আশঙ্কা। ইতোমধ্যে সতর্কতা জারি করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসতি স্থাপনকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। গতকাল বিকাল থেকে রাঙামাটি শহর এলাকায় মাইকিং করছে তথ্য অফিস।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ জানান, যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
কাপ্তাই : কাপ্তাই প্রতিনিধি জানান, টানা ভারী বর্ষণে কর্ণফুলী নদীর পানি প্রায় ১১ ফুট বেড়েছে। পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় লিচুবাগানে ফেরির পন্টুন প্রায় ৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। যার ফলে ডুবন্ত পন্টুনের উপর দিয়ে কোন ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারেনি। গতকাল সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। ফেরি বন্ধ থাকায় প্রায় ৭ ঘণ্টা যান চলাচল করতে পারেনি।
স্থানীয় দোকানি বজলুর রহমান জানান, টানা বৃষ্টির কারণে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অনেক রিকশাচালক যাত্রী না পেয়ে অলস বসে ছিলেন। মাঝি নৌকা নিয়ে ঘাটে বসে থেকেও যাত্রীর অভাবে বোট চালাতে পারেননি।
এদিকে গতকাল সকাল ১১টার সময় চন্দ্রঘোনায় কয়েকটি বড় গাছ উপড়ে বৈদ্যুতিক তারের উপর পড়ে। যার ফলে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চন্দ্রঘোনা শিল্প এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। কেপিএম স্কুলের সামনে গাছ উপড়ে পড়ে কিছু সময়ের জন্য যান চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়।