টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে কক্সবাজারের ৬ উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পাহাড়ি ঢল ও নদ–নদীর পানি উপচে এবং বৃষ্টির পানি জমাট হয়ে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয়রা জনপ্রতিনিধিরা জানান, মাতামুহুরী নদীর পানি উপচে চকরিয়া, পেকুয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। একইভাবে বাঁকখালী নদীর পানি প্রবেশ করে রামু ও কঙবাজার সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে এই চার উপজেলার অন্তত দুই হাজার ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে এবং পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ। অন্যদিকে টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং, সদর, পৌরসভা ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে বৃষ্টির পানি জমাটবদ্ধ হয়েছে অর্ধশতাধিক গ্রাম জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় পানিবন্দী আছে প্রায় অর্ধলাখ মানুষ। উখিয়ার ২০টি গ্রাম ও তিনটি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে পানিবন্দী অন্তত ১৩ হাজার স্থানীয় বাসিন্দা ও ৭ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। এছাড়া কুতুবদিয়ায় অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন জনপ্রতিনিধিদের বরাত দিয়ে জানান, টানা বর্ষণে টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং, বাহারছড়া, সাবরাং ও সদর ইউনিয়নের ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। এছাড়া সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিম পাড়া, উত্তর পাড়া ও দক্ষিণ পাড়ার কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে জলোচ্ছ্বাসে। হ্নীলা ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী বলেন, তার ইউনিয়নের অন্তত ১২টি গ্রামের চার হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। বহু পরিবারে রান্নাবান্না বন্ধ, দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট।
টেকনাফ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আবদুল্লাহ মনির জানান, পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ডে হাজারো মানুষ পানিবন্দী। ডুবে আছে টেকনাফ কলেজসহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিছু এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান জানান, নতুন পাল্লানপাড়া, লেঙ্গুরবিল, খোনকারপাড়া, মাঠপাড়া, রাজারছড়া, জাহালিয়া পাড়া এলাকায় মানুষ পানিবন্দী। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, পানিবন্দী লোকজন বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তবে প্রশাসন এ ব্যাপারে সজাগ আছে। সংকটাপন্ন পানিবন্দী লোকজনকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পাহাড় ধ্বসের ঝুঁকিতে থাকা বাসিন্দাদেরও সরিয়ে আনা হবে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হোসেন চৌধুরী জানান, উখিয়ার তিনটি ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রাম ও ৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে পানিবন্দী প্রায় ২০ হাজার মানুষ। শতাধিক সবজি খেত, বীজতলা ও পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি নিষ্কাশনের নালা পরিষ্কার করা হচ্ছে।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাশেদুল ইসলাম ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন জানান, টানা ভারী বৃষ্টিতে বাঁকখালী নদীর পানি প্রবলভাবে বেড়েছে। বাঁধ উপচে ও বহু স্থানে নদীর পানি ঢুকে রামুর ফতেখাঁরকুল, রাজারকুল, শ্রীকুল এবং সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের বাংলাবাজার, খরুলিয়াসহ অন্তত ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এছাড়া কঙবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, মোস্তাইক্যাপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের অন্তত দুই হাজার ঘরবাড়ি সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে গেছে। পৌরসভার প্রধান সড়ক ও অভ্যন্তরীণ ১২–১৪টি উপসড়ক পানির নিচে রয়েছে। পানিতে ডুবে আছে শহরের কলাতলী সৈকত সড়ক ও হোটেল–মোটেল জোনের অন্তত চারটি সড়ক। এতে পর্যটকদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
মাতামুহুরী নদীর পানি উপচে প্লাবিত হয়েছে চকরিয়া ও পেকুয়ার দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি। কুতুবদিয়াসহ এই তিন উপজেলায় পানিবন্দী আছে অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বলে জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যথোয়াইপ্রু মারমা জানিয়েছেন, কুতুবদিয়ায় ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
কঙবাজার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান জানান, গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কঙবাজারে ১৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টিপাত আরও কয়েক দিন থাকতে পারে বলে জানান তিনি। এতে ভূমিধ্বসের ঝুঁকিও রয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, পানিবন্দী মানুষের জন্য টেকনাফে ১৫ মেট্রিক টন চাল ও ১ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার পাঠানো হয়েছে। এছাড়া উখিয়া, রামু ও কঙবাজার সদরে আরও দেড় হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।