হল্যান্ডে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলন যেন ট্রাম্পকে ঘিরে : অবশেষে তার ইচ্ছেপূরণ
‘ভেনি, ভিডি, ভিসি!’ ল্যাটিন এই শব্দগুচ্ছের বাংলা অর্থ হলো, ‘আমি এসেছি, দেখেছি, জয় করেছি।’ একটি দ্রুত, চূড়ান্ত বিজয় বুঝাতে এই ল্যাটিন শব্দগুলি ব্যবহার করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭ সালে রোমান সমরনায়ক ও স্টেটসম্যান, জুলিয়াস সিজার। পন্টাসের ফার্নাসেস–২য় এর বিরুদ্ধে ‘জেলার–যুদ্ধে’ (বর্তমানে তুরস্কে) জয়ী হবার পর রোমান সিনেটে লেখা এক চিঠিতে এই শব্দগুলি ব্যবহার করেছিলেন জুলিয়াস সিজার। গেল সপ্তাহে হল্যান্ড আসা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই শব্দাবলী উচ্চারণ না করলেও, তার বডি–ল্যাঙ্গুয়েজ, কথাবার্তায় মনে হয়েছিল তিনি (ট্রাম্প) তেমনটিই বলতে চেয়েছেন। চব্বিশ ঘন্টারও কম সময়ের জন্যে তিনি এসেছিলেন উত্তর সাগর পাড়ের দেশ হল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ‘ন্যাটো শীর্ষ’ বৈঠকে যোগ দিতে। তার সকল বিদেশ–ভ্রমণের মত এটিও ছিল বিশাল এক যজ্ঞ। নিজস্ব প্লেন, পৃথক আর একটি প্লেনে আনা তার বিখ্যাত মিসাইল, বুলেট প্রুফ গাড়ি ‘দি বিস্ট’। ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের চাইতে প্রেসিডেন্টের এই বহর, হলিউড–ফিল্ম স্টাইলে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের দৌড়াদৌড়ি দেখার আগ্রহ অনেকের ছিল অনেক বেশি। আটলান্টিক সাগরের এপারে ইউরোপ এবং ওপারে উত্তর আমেরিকার মোট ৩২টি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মিলিত সামরিক শক্তি, ন্যাটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানইজেশন) মূল চালিকা শক্তি যে যুক্তরাষ্ট্র, সে কথা নূতন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। কেননা ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর ১৯৪৭ সালে এই সামরিক জোটের জন্মলগ্ন থেকে এর আর্থিক ও সামরিক শক্তির সিংহভাগ যোগান দিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এই কারণে জোটের নীতিমালায় মোড়লের ভূমিকায় আমেরিকা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এইভাবে চলে আসছিলো এই জোট। তবে বেশ কয়েক বছর থেকে জোটের সদস্যদের বার্ষিক চাঁদা বাড়ানোর প্রস্তাব উঠে আসে। কিন্তু তাতে তেমন সাড়া মেলেনি সদস্য দেশগুলির কাছ থেকে। জোটের মধ্যে বন্ধুত্ব নষ্ট হবে এই ভেবে কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই নিয়ে আর তেমন জোরাজুরি করেননি। কিন্তু সবকিছু উলট–পালট করে দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে। প্রথমবার যখন তিনি ক্ষমতায় এলেন তখন দাবি করলেন, ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে তাদের সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। তিনি হুমকি দিয়ে বললেন, জোটের সদস্যরা যদি তাদের সামরিক ব্যয় না বাড়ায় তাহলে তিনি আমেরিকাকে ন্যাটো থেকে বের করে নেবেন। তার প্রথম চার বছর মেয়াদের শাসনামলে এ নিয়ে তেমন ফলাফল দেখা দেয়নি। ট্রাম্প দাবি করেছিলেন জিডিপি–র ২% ভাগ থেকে বাড়িয়ে তা মিনিমাম ৫% উন্নীত করতে হবে। ট্রাম্পের প্রথম ৪–বছর শাসনামল শেষে এলেন ডেমোক্র্যাক্ট দলীয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার আমলে এই নিয়ে আর তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। হোয়াইট হাউসে বাইডেন এঙিট, ইন হলেন ট্রাম্প। ক্ষমতায় বসেই তিনি তার পুরোনো দাবিতে সোচ্চার হলেন। ন্যাটোর বড় প্রতিপক্ষ, বলা চলে শত্রুদেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্ক কেমন সে কারো অজানা নয়। ইউক্রেনে যুদ্ধ–বিরতির জন্য ক্রেমলিনের প্রতি ট্রাম্প মাঝে মধ্যে হতাশা প্রকাশ করেছেন বটে, কিন্তু রাশিয়ার উপর বাড়তি কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং এমনকি রাশিয়াকে এক সময় ‘জি–এইট’ বা ‘গ্রুপ অফ ৮’–এ ফিরিয়ে নেবার পক্ষে কথা বলেছেন।
ইতিমধ্যে ভূ–রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেক ঝড়–ঝাপ্টা বইতে শুরু করেছে। রাশিয়া আরো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। ইউরোপ উদ্বিগ্ন এবং আশংকা করছে ইউক্রেনের পর রাশিয়া হয়তো এগুবে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, লিথুনিয়া ইত্যাদি দেশগুলির দিকে। অতএব, ন্যাটোকে আরো শক্তিশালী করা চাই এবং সে–ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যদি তার সক্রিয় সমর্থন না দেয় তাহলে গোটা ইউরোপ কোনভাবেই নিরাপদ থাকতে পারবেনা এবং মার্কিন সমর্থন ছাড়া গোটা ইউরোপ এক হয়েও রাশিয়াকে ঠেকাতে পারবেনা। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের দুর্বলতা ও ভয় কোথায় খুব ভালোভাবে জানেন। আর জানেন বলেই তিনি নতুন করে হুমকি দিয়ে বলেন, আর কোন কথা নয়, তোমাদের নিজেদের বাঁচাতে নিজ গাঁটের পয়সা বের কর। আর কতকাল যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর জন্য সিংহভাগ খরচ বহন করবে। যদি তা না হয়, তাহলে ন্যাটো থেকে আমরা সরে আসবো, ট্রাম্পের হুমকি।
অবশেষে এলো যেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। হল্যান্ডে আয়োজন করা হলো ন্যাটো শীর্ষ বৈঠক। মোট ৩২টি ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকার দেশকে নিয়ে ন্যাটোর এই সম্মেলন হলেও সবার দৃষ্টি যেন কেবল একটি দেশের সরকার প্রধানের উপর। সেটি বলা বাহুল্য, অতি ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট, ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্মেলনে যদিও বা বার্নিং ইস্যু হিসাবে ইসরায়েল–ইরান যুদ্ধ, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন উঠে আসার কথা ছিল, কিন্তু সব ছাড়িয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি ‘সামরিক খাতে সদস্য রাষ্ট্রগুলির জিডিপি–র ২% থেকে ৫% উন্নীতকরণ ইস্যুটি’ প্রাধান্য পায়। সবার মাঝে এক ধরনের আশংকা যদি এই ইস্যুতে সদস্য রাষ্ট্রগুলি রাজি না হয়, তাহলে না জানি ট্রাম্প কী করেন। কী ঘোষণা দিয়ে বসেন। আর এই ব্যাপারে এক ধরনের ঐকমত্য তৈরিতে গত কয়েক মাস ধরে ন্যাটোর নুতন সেক্রেটারি জেনারেল, মার্ক রুতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। অকৃতদার মার্ক রুতে সেক্রেটারি জেনারেল পদে নির্বাচিত হবার আগে হল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দীর্ঘ ১২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সুদর্শন ও সাধারণ জীবন–যাপনে অভ্যস্ত মার্ক রুতেকে সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, রুশ–আগ্রাসন থেকে বাঁচতে হলে ইউরোপকে সামরিকভাবে আরো শক্তিশালী করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। ইউরোপকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, আর এর জন্য সামরিক ব্যয় বাড়ানো ছাড়া ভিন্ন কোন পথ নাই। জার্মানি ঘোষণা দেয় ,তারা ২০২৬ সাল নাগার তাদের জিডিপির ৩,৫% ভাগ বাড়াবে। ২০১৪ সালের ন্যাটো দেশগুলি সম্মত হয়েছিল যে তারা তাদের জিডিপির ২% ব্যয় করবেন। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে দেখা গেলো নয়টি সদস্য রাষ্ট্র এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেনি। এর মধ্যে রয়েছে কানাডা, পর্তুগাল, ইতালি, স্লোভেনিয়া, বেলজিয়াম ও লুঙ্মেবুর্গ। রাশিয়ার সাথে লাগোয়া পোল্যান্ড সেই অর্থে সবচাইতে বেশি ব্যয় করে। সামরিক খাতে তাদের ব্যয়ের পরিমাণ ছিল মোট জিডিপির ৪,১% ভাগ। অন্যদিকে এস্তোনিয়া ও ল্যাটভিয়া প্রায় ৩,৪%, বোধকরি স্পেন সবচাইতে কম, জিডিপির ১,২%। এবারের ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলন শুরুর প্রাক্কালে স্পেনের প্রধান মন্ত্রি পেড্রো সানচেজ বলেন, তার দেশ কিছুতেই ৫% সামরিক খাতে ব্যয় করতে পারবে না। তার মতে ২% যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তা ‘যথেষ্ট’ ও ‘বাস্তবসম্মত’। সানসেজের এই কথায় ক্ষেপেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খুব খারাপ, খুব খারাপ। তারা ‘ফ্রি রাইড’ (ফ্রি গাড়ি চড়া) চাইছে।’
ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলি পড়েছে সমস্যায়। তাদের দশা ‘কুল রাখি না শ্যাম রাখি’। তারা খুব ভালো করেই জানে যে তাদের জন্যে ঘরের পাশেই আগ্রাসী রাশিয়া। ইউক্রেনের মত যে–কোন সময় তারা অন্যের দিকে হাত বাড়াতে পারে। এমতোবস্থায়, ন্যাটোকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলি এও খুব ভালো করে জানে যে ন্যাটো থেকে বেরিয়ে আসার যে হুমকি ট্রাম্প দিচ্ছেন তা উড়িয়ে দেবার নয়। তার কথা কিছুই বলা যায়না। নিন্দুকেরা বলেন, তার ‘মতিগতির’ কোন ঠিক–ঠিকানা নেই। তিনি বেরিয়েও আসতে পারেন। সে–সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা তার প্রথম টার্মে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন ইউনিসেফ, জলবায়ু চুক্তি থেকে। যদিওবা জো বাইডেন এসে যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় ফিরিয়ে এনেছেন। ট্রাম্পের পক্ষে সবই সম্ভব। আর সে–ভয়কে মাথায় রেখে ইউরোপীয় রাষ্ট্র প্রধানরা ট্রাম্পের ‘তিতা বড়ি’ গিলতে বাধ্য হন। এ ছাড়া যে তাদের আর কোন বিকল্প ছিলনা, ছিলনা প্ল্যান–বি। ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্র প্রধানরা ট্রাম্প হল্যান্ড এসে পৌঁছার আগেই সম্মত হলেন ২০৩৫ সাল নাগাদ তারা তাদের বার্ষিক জিডিপির শতকরা ৫% ব্যয় করবেন সামরিক খাতে। বাইরে রইলো কেবল স্পেন।
অবশেষে দন্ত বিকশিত হাসি দেখা গেলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে। ফুরফুরে মেজাজে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বললেন, প্রতিরক্ষা ব্যয় ৫% উন্নীত হবার ব্যাপারে ঐকমত্য হওয়াটা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও পশ্চিম সভ্যতার জন্যে ‘বড় বিজয়’। ন্যাটোর পাশে তিনি ও যুক্তরাষ্ট্র থাকবেন এই আশ্বাস দিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের নিয়ে ন্যাটো আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে।’ এই কথার মধ্যে দিয়ে ট্রাম্প বুঝিয়ে দিলেন, আমেরিকাকেই নিয়ে ন্যাটো শক্তিশালী। সুযোগ পেলেই ‘আমেরিকা গ্রেট‘ এই বিষয়টি ট্রাম্প মনে করিয়ে দিতে ভুলেননি। ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে বোমা হামলার সফলতা দাবি করে তিনি বলেন, ‘এটি সম্ভব হয়েছে একমাত্র আমেরিকার কারণে, আমেরিকার রয়েছে পৃথিবীর সব চাইতে ক্ষমতাশালী বোমারু বিমান, সব চাইতে দক্ষ পাইলট ও টেকনোলজি। আর কোন দেশের পক্ষে এটি সম্ভব হতোনা।’
ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন ন্যাটো প্রধান, সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুতেও। তার মুখেও দেখা গেছে ট্রাম্পের মত বিজয়ের হাসি। বলা চলে একটু বেশিই দেখা গেছে। ন্যাটোর দায়িত্ব নিয়েছেন খুব বেশি দেরি হয়নি। মাস কয়েক আগে। ন্যাটোর এই প্রধান পদটিতে কোন ব্যক্তি বসবেন তার অলিখিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমেরিকার, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের। তবে মার্ক রুতে সবদিক থেকে যোগ্য ব্যক্তি। এক নাগাড়ে ১২ বছর হল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী থাকার কারণে ভূ–রাজনীতিতে তার একটা পরিচিতি রয়েছে। রাজনীতিতে ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথেও তার উষ্ণ সম্পর্ক। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সাংবাদিকদের সামনে মুখোমুখি হলে ট্রাম্পকে রুতে ‘ডোনাল্ড’ বলে সম্বোধন করেন। দু–দিন ব্যাপী এই যে বিশাল যজ্ঞ তার গোটা অনুষ্ঠানে মার্ক রুতেকে দেখা গেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তুষ্ট রাখতে। ট্রাম্পকে নিয়ে যে উচ্ছসিত প্রশংসা তিনি সাংবাদিকদের সামনে করেছেন তা অনেকের কাছে মনে হয়েছে বেশ বাড়াবাড়ি। ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধ থামানো প্রসঙ্গে তিনি ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘খেলার মাঠে ঝগড়া–করা শিশুদের ড্যাডি যেমন কলহ থামিয়ে দেন, আপনিও ঠিক তেমনি ড্যাডির মত তাদের কলহ থামিয়ে দিয়েছেন। এটি কেবল আপনার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে।’ এরপর থেকে রুতে পড়েছেন হল্যান্ড সহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সমালোচনার মুখে। তবে তিনি বলেন, তিনি সেভাবে বুঝাতে চাননি। এ–নিয়ে পরবর্তী সংখ্যায় বিস্তারিত লিখবো।
(২–৭–২০২৫)
লেখক : সাংংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট