জুলাই আন্দোলনের প্রথম অংশ অবশ্যই মেটিকুলাসলি ডিজাইনড : মাহফুজ

| শনিবার , ৫ জুলাই, ২০২৫ at ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ

জুলাই আন্দোলনের ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ নিয়ে মুখ খুলেছেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। যাকে প্রধান উপদেষ্টা আওয়ামী লীগ সরকার পতন আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করে দিয়েছিলেন তার ভাষ্য, ‘প্রথম অংশ অবশ্যই মেটিকুলাসলি (সূক্ষ্মভাবে) ডিজাইনড। পরের অংশের কৃতিত্ব বিপ্লবী ছাত্রজনতার।’

বহুল আলোচিত জুলাই অভ্যুত্থানের মেটিকুলাস ডিজাইন নিয়ে গতকাল শুক্রবার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এ বিষয়ে চলমান রাজনৈতিক আলাপে অংশ নিয়েছেন তথ্য উপদেষ্টা। তার আগে বৃহস্পতিবার আরেকটি পোস্টে তিনি দাবি করেন, মব ভায়োলেন্স বা সংঘবদ্ধ আক্রমণের সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কোনো সম্পর্ক নেই। এটিকে সামাজিক ফ্যাসিবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করে মাহফুজ বলেছেন, শেখ হাসিনার গত ১৬ বছরের রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদেরই প্রতিক্রিয়া এই সামাজিক ফ্যাসিবাদ। খবর বিডিনিউজের।

গত বছরের জুলাই মাসে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দেওয়া এক বক্তব্যে মেটিকুলাস ডিজাইন হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেই আন্দোলনের সূত্র ধরেই আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। জুলাই আন্দোলনকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বর্ণনা করতে ইউনূসের সেই মেটিকুলাস ডিজাইন শব্দ দুটি ব্যবহার করে থাকেন দেশের বাইরে অবস্থানরত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতারা। এ বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টা লিখেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দুটি অংশ। ৫ জুন থেকে ১৮ জুলাই। এ অংশে অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট এবং নেতৃত্ব তৈরি হয়েছিল। আর ১৯ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সকল স্তরের ছাত্রজনতার অংশগ্রহণে এবং আত্মদানে অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। প্রথম অংশ অবশ্যই মেটিকুলাসলি ডিজাইনড। পরের অংশের কৃতিত্ব বিপ্লবী ছাত্রজনতার।

অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা এবং সুনির্দিষ্ট বক্তব্য না থাকলে এ বিপ্লবী জনতা পরের অংশে লক্ষ্যে পৌছাতে পারত না মন্তব্য করে তিনি লিখেছেন, শুক্রবার দিবাগত রাত, ২ আগস্টে এ অভ্যুত্থান বেহাত হয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের দিকে মোড় নেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তা ঠেকাতে পেরেছিল অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব। অতীতে বাংলাদেশের অনেক গৌরবময় আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামে মেটিকুলাস ডিজাইন কাজ করেছিল বলে দাবি করেন মাহফুজ। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে মেটিকুলাস ডিজাইন করে আগরতলা ষড়যন্ত্র, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান আর ৭১ এর মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন ও বাঙালিবিহারি দাঙা সঠিক হইতে পারলে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান মেটিকুলাস ডিজাইন হইলে সমস্যা কোথায়? দুনিয়ার কোনো অভ্যুত্থান বা বিপ্লব পরিকল্পনা না করে হয়েছে? জনগণের চৈতন্যকে ঐক্যবদ্ধ ও লক্ষ্যাভিমুখী রাখতে মেটিকুলাস ডিজাইনের বিকল্প নেই। যখন জনগণ নেতৃত্ব ও বক্তব্য পেয়ে যাবে এবং বিপ্লবের অবজেক্টিভ কন্ডিশন প্রস্তুত, তখন আর প্ল্যানের দরকার পড়ে না। কিন্তু, তার আগে রাজনৈতিকভাবে জনগণকে প্রস্তুত এবং বিপ্লবী করে তোলা মেটিকুলাস ডিজাইন হলে সমস্যা কোথায়?

এই ধরনের ডিজাইন বা পরিকল্পিত আন্দোলনের জন্য গর্ব বোধ করার কথা তুলে ধরে মাহফুজ লিখেছেন, সিরাজুল আলম খান, তাজউদ্দিন, সিরাজ শিকদার আর ভাসানী, এমনকি খোদ শেখ মুজিব যদি পাকিস্তানকে পরাজিত করতে মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ হয়ে পাপবোধ না করেন এবং আমরা তাদের নিয়ে (তাদের ভুলসহই, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য) গর্বিত হতে পারি, তাহলে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে মেটিকুলাস ডিজাইন করে হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করলে কেন এ প্রজন্ম গর্বিত বোধ করবে না?

আন্দোলনের সঙ্গে বিদেশি শক্তির সম্পৃক্ততা ছিল না বলেও দাবি করেন তিনি। মাহফুজ লিখেছেন, ৩ তারিখের ১ দফা ঘোষণার আগে জাতিসংঘের বক্তব্য ছাড়া বিদেশি শক্তি বা সামরিক বাহিনী কারোরই বিন্দুমাত্র অংশগ্রহণ ছিল না এ গণঅভ্যুত্থানে। ভারতের সাথে ষড়যন্ত্র করে (যা ন্যায্য বলেই আমরা মনে করি) আগরতলা বৈঠক থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য শেখ মুজিব ও অন্যান্য জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি যদি আমাদের শ্রদ্ধা থাকে, তাহলে কোনো বিদেশি শক্তি বা তৃতীয় শক্তির সাথে ষড়যন্ত্র কিংবা সলাপরামর্শ ছাড়াই জনগণের অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলার জন্য অভ্যুত্থানের নেতৃবৃন্দ এবং অংশীজনকে কেন গালি শুনতে হবে? মওলানা ভাসানীর ৬৮ সালের ঘেরাও আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ মিলিয়ে দেখেন, অথবা ৭১ এর মার্চ। আপনারা মেটিকুলাস ডিজাইনও বুঝতে পারবেন এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ, প্রতিরোধ আর বিপ্লবী তৎপরতারও হদিস পাবেন, লিখেছেন তিনি। এ বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে আরও কথা বলার জন্য ফোন করা হলেও তিনি ফোন কেটে দেন।

মব তৈরি করে হামলার বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টা লিখেছেন, মব মানে বিপ্লবী উদ্দেশ্যহীন, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা লালন করা সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী। জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্রজনতার উদ্দেশ্য পরিষ্কার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা অতুল এবং তারাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। মবকে সামাজিক ফ্যাসিবাদ আখ্যায়িত করার পাশাপাশি তার দাবি, শেখ হাসিনার গত ১৬ বছরের রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদেরই প্রতিক্রিয়া এই সামাজিক ফ্যাসিবাদ। সামাজিক ফ্যাসিবাদ যে হাসিনার ১৬ বছরের রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদেরই প্রতিক্রিয়া এবং বিকার, তা না বুঝে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও মব মানসিকতা মোকাবেলা অসম্ভব।

ইসলামোফ্যাসিস্ট’ বলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না মন্তব্য করে তথ্য উপদেষ্টা লিখেছেন, জুলাই যে বিভিন্ন মতাদর্শ ও মতে বিশ্বাসীদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ তৈরি করেছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে এ সামাজিক ফ্যাসিবাদ দূর করতে হবে। এছাড়া, গত ১৬ বছরের গণতন্ত্রহীনতা এবং আইনের শাসনের অবক্ষয় যে মব মানসিকতার জননী, সে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে। কিন্তু, গত কয়েকমাসে রাজনৈতিক ও সামাজিক ফ্যাসিবাদের অংশীদার না হয়েও হরে দরে মব ভায়োলেন্সের দায় নিতে হচ্ছে জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্রজনতাকে। জুলাইয়ের পরে মব হইলে বা সে সুযোগ তৈরি করা হইলে এত সুশীলতা আর অ্যাপলোজেটিক আলাপ আসতো না।

বিশৃঙ্খলার ইতিহাস টেনে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে প্রথম মব ভায়োলেন্স হইছিল বিহারি জনগোষ্ঠীর উপর। তারপরে মব হইছে ছাত্র ও তরুণ মুক্তিযোদ্ধা অথচ মুজিববাদবিরোধীদের উপর। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি ইন্ধনে গত ৫৩ বছর মব হইসে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর। মবের ডেফিনিশন স্ট্রেইচ করলে তথাকথিত জনতার আদালত, জনতার মঞ্চ ’৯৬, ২৮ শে অক্টোবর, শাহবাগসবই মব জাস্টিস, মব ভায়োলেন্স।

তথ্য উপদেষ্টার মতে, রাষ্ট্রের দায়িত্বে থেকে তাদের কাজ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। সে জন্য মব নিয়ে কয়েকবার বলেছেন তিনি। সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনায়, মাজারে হামলা নিয়ে, বইমেলা নিয়ে কথা বলেছেন, লিখেছেন মাহফুজ।

অনেক রাজনীতিক জুলাই বিপ্লবকে মব হিসেবে আখ্যায়িত করছেন দাবি করে তিনি এর সমালোচনা করেন। মাহফুজ লিখেছেন, উদ্বেগের বিষয় হল, জুলাই বিপ্লবকে এখন মুজিববাদী বাম এবং লীগের কালচারাল গুন্ডারা জুলাই পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সাথে মিলিয়ে এমনভাবে পোট্রে করসে, যেন জুলাই বিপ্লব শেখ মুজিবের নাতি জয়ের কথামত মবোক্রেসি ছিল। মবোক্রেসি হইলে জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্রজনতা পুলিশআনসার বিহীন দেশকে একদেড় মাস নিরাপদ রাখতো না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাল্টি ডেস্টিনেশন এডুকেশন এক্সপো কাল
পরবর্তী নিবন্ধআ. লীগ নেতার ছেলের বিয়ে, চিটাগং ক্লাবে বৈষম্যবিরোধীদের অবস্থান