ডা. পি. সি. পাল (ডা. পরেশ চন্দ্র পাল) বাঁশখালীবাসীর জন্য চিকিৎসা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এক অনন্য দিকপাল। প্রায় ছয় দশক ধরে তিনি প্রত্যন্ত বাঁশখালীর জনগণকে নিরলসভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বসতঘর সংলগ্ন চেম্বার হওয়ার দরুণ তাঁর চেম্বার সারাক্ষণ রোগীতে ভরপুর থাকে। এতে ডাক্তার ও রোগী উভয়ের ভোগান্তি কম হয় এবং নিত্য সেবা নিশ্চিত হয়। বাঁশখালীতে অনেক গুনধর ডাক্তার থাকলেও কোন এম.বি.বি.এস পাশ করা ডাক্তারের এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন অবস্থান ছিল না বলা যায়। তাই পাল বাবুকে যেমন নিয়মিত চিকিৎসা দানে নিমগ্ন থাকতে হয়েছে, তেমনি চলৎশক্তিহীন রোগী দেখার জন্য দূর দূরান্তের দুর্গম প্রান্তরে বিশেষ ‘ভিজিট বা ক–লে’ যেতে হয়েছে। আলস্য বা শ্রান্তি তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারেনি। বলা যায় – এটা সম্ভব হয়েছে তাঁর দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যবোধের প্রবলতার কারণে।
পাল বাবুর নিজের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। জগন্নাত কলেজ থেকে আই.এস.সি পাশ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস. পাশ করার পর তিনি চিকিৎসা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ষাটের দশকের শেষ ভাগে তাঁর স্ত্রীর সুবাদে তিনি বাঁশখালীতে আগমন করেন। প্রথমে কিছুদিন চেচুরিয়ায় চেম্বার করেন। তৎপরবর্তীতে ’৭১ সাল থেকে সারা জীবন বৈলছড়িতেই তাঁর স্থায়ী অবস্থান এবং আবাস।
উত্তর দক্ষিণ ২২ মাইলের বাঁশখালী থানায় বৈলছড়ি ইউনিয়নটি প্রায় মধ্যবর্তী অবস্থানে হলেও ডা. পালের অবস্থান বার্তা সহসা সারা বাঁশখালীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমার ধারণা – এর অন্যতম কারণ রোগীর প্রতি তাঁর সংবেদনশীল আন্তরিক ও যারপরনাই কোমল ব্যবহার। শত ব্যস্ততা ও প্রতিকুলতার মধ্যেও তিনি সারাজীবন তাঁর অসীম ধৈর্য ও বিনয় ধরে রেখেছেন। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখাতেই তাঁকে একজন দায়িত্বশীল চিকিৎসক হিসেবে তো বটেই, ততোধিক একজন পরিশীল শুদ্ধ মানুষ বলেও মনে হয়েছে। এরপর অনেকবার দেখা হলেও, এমনকি আমার শ্বশুর প্রয়াত ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর সুবাদে ডা. পাল বাবুর আন্তরিক আতিথ্য গ্রহণের সুযোগ হলেও আমার কাছে তাঁকে সেই প্রথম দেখার ঋষি–সদৃশ্য চেহারাটাই দৃশ্যপটে চলে আসে। আমি দেখা–অদেখায় তাঁকে সেই থেকে হৃদয় দিয়ে শ্রদ্ধা করে আসছি। তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করার সময় বার বার মনে হতো তাঁর সাথে বসে একটু সামাজিক বা লৌকিক আলাপ করি, হয়তো কিছু জ্ঞানগর্ভ অভিজ্ঞতার কথা শূনতে পাবো। কিন্তু সেই সুযোগ আমার অদ্যাবধি হয়ে উঠেনি। এর প্রধান কারণ অর্ধশতাধিক বছর ধরে এই বাঁশখালী বাসে তিনি কোন সময় সামনে রুগি ছাড়া যে থাকতে পারেন; তা কল্পনা করা আমার জন্য দুঃসাধ্য ছিল। ৮০ দশকে একবার শহর থেকে বাঁশখালী যাতায়াতের সর্বোচ্চমান যানবাহন চাঁদের গাড়ি খ্যাত সবেধন জীপের সামনের সিটে তাঁকে বসা আছেন দেখে দৃশ্যটা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। অর্থাৎ সারাক্ষণ রোগী পরিবেষ্টিত এই ডাক্তারের আবার শহরে আসার সুযোগ হলো বুঝি। ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে আমার নানা ১৩ দিনের জন্য রোগশয্যায় ছিলেন। নানার চিকিৎসার জন্য পাল বাবু আসছেন জেনে আমি বাড়ির বাইরে এসে এগিয়ে নিতে যাই। পথিমধ্যেই তিনি আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে কিছু অবস্থা জেনে নেন। নানার পাশে তিনি কিছুক্ষণ ছিলেন। যাওয়ার পথে আমার জিজ্ঞাসায় তিনি আমাকে বললেন, “তাঁর (রোগীর) নিজের অবস্থা তিনি নিজেই উপলব্ধি করতে পারছেন।” কথাটার মর্ম আমি তখন বুঝি নাই। উল্লেখ্য, সেদিন পাল বাবু কোন ভিজিট নেন নাই। এর ৫/৬ দিন পর নানা ইহজগত ত্যাগ করেন। ডাক্তার সাহেব জানতেন এক সময় (’৪০ থেকে ’৬০ এর দশক পর্যন্ত) আমার নানা নিজেদের এলাকায় একমাত্র কোয়াক ডাক্তার ছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর ছেলে প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক মৌ. রশীদ আহমদ সাহেব প্রায় ৫০ বৎসরাধিককাল এ পেশা দক্ষতার সহিত করে গিয়েছেন। ১৯৭৯ সালের ৫ মার্চ আমার মা ব্রেইন স্ট্রোক করলে ডা. পাল বাবু এসে বলেছিলেন মৌ. রশীদ সাহেব (আমার মামা) ঠিক চিকিৎসাই চালাচ্ছেন, শহরে নিলেও একই চিকিৎসা চলবে। পরবর্তীতে আমার মাকে চমেক হাসপাতালে আনলে ডাক্তাররা ঠিক একই চিকিৎসাই প্রদান করেছিলেন। এতে একজন কোয়াক ডাক্তারের চিকিৎসাকে এভাবে সরল স্বীকৃতি প্রদান তাঁর নিরহংকারী মহৎ মনোবৃত্তির প্রকাশ পায়। উল্লেখ্য, একই রোগে একই সপ্তাহে তৎকালীন সিনিয়র মন্ত্রী মসিউর রহমান যাদু মিয়া ও আমার মা মারা যান। ১৯৮৩ সালে আমার নানী (শীলকুপ হযরত মৌ. মনসুর আলী সাহেবের নাতনী) র্রেইন স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যান। ডা. পাল বাবুকে ডাকা হলে তিনি চরম পর্দানসীন এই মহিলার গায়ে হাত না লাগিয়ে রোগীর সন্তানের মাধ্যমে পরীক্ষা করে বলেন – “ওনাকে শহরে নিয়া টানাটানি করার দরকার নাই। সবাই মিলে সারাক্ষণ হাত, পা ও মুখ নাড়া চড়া করতে থাকেন। কিন্তু ভূলেও মাসেজ করবেন না। সেরে উঠবেন।” সবাই মিলে তাঁর নির্দেশ পালন করলে ঠিকই আমার নানী মৃত্যু শয্যা থেকে উঠে হাঁটাচলা করার মতো আরোগ্য লাভ করেছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ৭০/৮০/৯০ এর দশকে বাঁশখালীর আবাল বৃদ্ধ বনিতার মুখে মুখে চিকিৎসার জন্য একমাত্র নাম ‘ডা. পি.সি. পাল’।
ডা. পি.সি পাল সম্পর্কে আরো অনেক ঘটনাবলী লিখা যায়। কিন্তু এখানে পরিসর স্বল্প। চিকিৎসা জগতে আরো বেশ কয়জন ডাক্তার বাঁশখালীবাসীকে ঋণী করে রেখেছেন। তাঁদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁদের অনেকে যখনই সুযোগ হয়েছে বাঁশখালীতে এসেছেন, জনগনকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, আবার পেশার কারণে বা জীবনমান উন্নয়নের জন্য চলে গিয়েছেন, কিন্তু সার্বক্ষণিক নয়। তাঁদের মধ্যে ডা. আবদুল মান্নান চৌধুরী, ডা. নজরুল ইসলাম চৌধুরী, ডা. এম. কে. সরকার প্রমুখ। আমার জানামতে আরো দু’জনের কথা বলতে হয়। তাঁরা বৈলছড়ি সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার – একজন নন্দী ডাক্তার, অন্যজন ডা. আওরঙ্গজেব চৌধুরী। নন্দী ডাক্তার শুধু একজন চিকিৎসক ছিলেন না, ভিন্ন জেলার লোক হলেও তিনি এখানকার সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সবিশেষ জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। আমার বাবা মরহুম ছাবের আহমদ মাস্টার আমাকে ছোটকালে কয়েকবার ডা. নন্দী বাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রত্যেকবারই তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ হতো দেখেছি। এই আলাপ শিক্ষা, সংস্কৃতি, নীতি নৈতিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে।
সম্প্রতি বাঁশখালীতে অনেক ডাক্তার বিভিন্নভাবে চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে সেবা দিয়ে চলেছেন। তাঁদের সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। সবার নাম নিতে গিয়ে কারো নাম বাদ পড়লে আমি নিজেই দুঃখ পাবো। সেই জন্য এই রিস্ক নিতে চাই না। কিন্তু একজন ডাক্তারের কথা না বললে আমার কৃপণতা প্রকাশ পাবে। তিনি হলেন ডাক্তার ফররুখ আহমদ চৌধুরী – এক অসাধারণ সেবা ব্রতী মানুষ। ৮০ দশকের গোড়ায় ডাক্তারি পাশ করে সেই থেকে তিনি বাঁশখালীর প্রায় প্রতিটি বাড়ি এমনকি প্রতিটি পরিবারের চিকিৎসক হয়ে উঠেন। তাঁর একটা ৫০ সিসির মোটর সাইকেল সম্ভবত বাঁশখালীর প্রতিটি বাড়ির প্রবেশ পথ চিনে নিয়েছিল। আমার অন্তত এমন ১৫টি ঘটনা জানা আছে যে, প্রয়োজনবশতঃ গাড়িতে করে রোগী কোলে নিয়ে তিনি নিজেই শহরে হাসপাতালে চলে এসেছেন। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নিজের পরিচিতি ও প্রভাব খাটিয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। এ রকম ঘটনা হয়তো শতাধিক হতে পারে। এক সময়ে উপজেলা অফিসে চাকুরীরত রত্নপুরের আবুল হোসেন গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হলে তাকে মাউথ পাম্পিং করতে গিয়ে ডাক্তার ফররুখ সাহেবের পেটে রোগীর রক্ত ঢুকে গিয়েছিল বলে শুনেছিলাম।
আজ আমার এই ক্ষীণ বর্ণনায় সবিনয়ে উল্লেখ করছি – ডা. মো. আবু ইউসুফ চৌধুরী, ডা. মেজবাহুল হক, ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া, ডা. আবদুল আজিম, ডা. রশিদ আহমদ চৌধুরী, ডা. আমজাদ সাহেব, ডা. মুস্তাফিজ সাহেবসহ যারা বাঁশখালীবাসীকে যথাসম্ভব চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের অবদানের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করতে না পারার অনুতাপটা আমার রয়ে গেলো।
ঠিক এই মুহূর্তে অনুভব করছি বাঁশখালীতে চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী পুর্বাপর সব ডাক্তার সাহেবদের একটা ইনডেক্স তৈরী করা প্রয়োজন। কেউ সেই কাজটা হাতে নিলে তাঁর প্রতি আমার আগাম ধন্যবাদ।
লিখা শেষ করছি – আবারও বাঁশখালীর প্রবাদ প্রতীম চিকিৎসক ডা. পি. সি. পাল সাহেবকে দিয়ে। সম্প্রতি ‘বাঁশখালী সচেতন নাগরিক ফোরাম’ কর্তৃক তাঁকে এক সংবর্ধনা দেয়ার আয়োজন চলছে। আনন্দের সাথে এই মহৎ উদ্যোগের প্রতি সাধুবাদ ও শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু বাঁশখালীতে ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, নির্বিশেষে তাঁকে বাঁশখালীর আপামর জনগণের উপস্থিতিতে বাঁশখালীতেই অনুষ্ঠানের আয়োজন না করে শহরের চার দেয়ালের ঘেরায় সংকীর্ণ আয়োজনে সংবর্ধনার আয়োজন করলে আমাদের প্রকট সীমাবদ্ধতার প্রমান বা ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে থাকবে বলে আমার ধারণা। হয়তো যুক্তি আসবে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো’। আমার যুক্তি– ‘চোখওয়ালা মামার’ সন্ধান থাকলে ‘কানা মামার’ প্রতি অধিক আকর্ষণ কেন? তবুও সম্মানিত আয়োজকদের পুনরায় আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সর্বশেষে, চিকিৎসা জগতে বাঁশখালীবাসীর ‘নিদানের বীজধান’ অর্থাৎ দুঃসময়ের পুজি। ডা. পি. সি. পাল মহোদয়কে আমার নিরন্তর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। সেই সাথে লাখ রোগীর চিকিৎসক পাল বাবুর নিরোগ দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষা–সংগঠক, পরিচালক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লেখক পরিষদ।