কয়েক বছর ধরে দেশের অনেক এলাকায় চলছে গ্যাসের তীব্র সংকট। গ্যাস সংকটের জন্য সেসব এলাকায় দিনের বেলায় রান্নাও করা যায় না। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকট চলছে ঢাকাসহ আশেপাশের জেলাগুলোতে। ফলে এসব এলাকার রান্নাসহ কলকারখানায় উৎপাদন চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে। এদিকে দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে গ্যাস ভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রি। গ্যাসের সংযোগের জন্য তাদেরকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বছরের পর বছর।
দেশে গ্যাস সরবরাহে সবসময়ই ঘাটতি ছিলো। উৎপাদন কমে আসায় এ ঘাটতি আরো বাড়ছে। আমদানি করেও চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। যে কোন গ্যাসক্ষেত্র রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু করলেই সরবরাহ আরো কমে যায়। এতে গ্যাসের তীব্র সংকটে ভুগে শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকেরা।
দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩৮০ কোটি ঘনফুট হলেও সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের চেষ্টা করে পরিস্থিতি সামলানো হয়। ফলে সরবরাহ এক খাতে কমিয়ে আরেক খাতে বাড়াতে হয়। সরবরাহ আরো কমে গেলে চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। তবে এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৫০ কোটি ঘনফুট। শীতকালে বিদ্যুৎ খাতে চাহিদা কম থাকায় সার কারখানায় সরবরাহ বাড়ানো হয় ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেছে নেওয়া হয়। দেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র। আর মজুতের দিক থেকে সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র হলো তিতাস। কয়েক দিন আগে দুটি গ্যাসক্ষেত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উৎপাদন আরো কমে গিয়েছিলো।
এদিকে দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোর শিল্পকারখানাগুলোতেও চলছে গ্যাসের সংকট। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা, স্পিনিং, টেক্সটাইল, রি–রোলিং মিলসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে দুই থেকে আড়াই গুণ। জানা যায়, গত কয়েক মাসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। অনেক কারখানায় গ্যাসের অভাবে ডিজেল, ফার্নেস তেলের পাশাপাশি লাকড়ি ও ঝুট বয়লার ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে নিট পোশাক খাতে যতগুলো সংকট আছে, এর মধ্যে প্রধান সংকট হলো গ্যাস। অন্যদিকে পোশাকশিল্পেও গ্যাসের চাপ কম থাকায় অধিকাংশ কারখানায় সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন টানা কমছে। আগামী পাঁচ বছর এখানে একই পরিমাণ উৎপাদন ধরে রাখা কঠিন হবে। তবে গ্যাস সংকট থেকে উত্তরণের একটাই উপায়, দেশের গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো। কিন্তু দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন টানা কমছে। ফলে শীতেও গ্যাস সংকট ভুগিয়েছে গ্রাহকদের। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, সামনে এটি আরো ভোগাবে।
সাধারণত ১০ থেকে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে গ্যাস সরবরাহ হয় শিল্পে। কিন্তু কোনো কোনো কারখানা গ্যাস পাচ্ছে ১ থেকে ২ পিএসআই চাপে। এতে কারখানা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। রপ্তানি শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিতি নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে ধুঁকছে অধিকাংশ কারখানা। বিগত সরকার গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর নামে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছিল। এখন আবারো সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে দাম বাড়ানোর তৎপরতা চলছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। নতুন শিল্পের জন্য প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে তারা।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। এরমধ্যে উৎপাদনের শীর্ষে থাকা বিবিয়ানার মজুত শেষের দিকে। দুই বছর আগে এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুটও উৎপাদন করা হয়েছে। এখন এটি নেমে এসেছে ৯৮ কোটি ঘনফুটে। আগামী দিনে আরো কমতে থাকবে। অন্য বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকেও সক্ষমতা অনুসারে গ্যাস উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য বলছে, গত নভেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট মজুত আছে সাড়ে ৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) এবং বছরে গড়ে পৌনে ১ টিসিএফ গ্যাস উৎপাদন করা হয়। এতে অবশিষ্ট মজুত দিয়ে ৮ বছর উৎপাদন ধরে রাখা যেতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মজুতে কত বছর চলবে তা এভাবে বলা যাবে না। কেননা গ্যাসের মজুত কমতে থাকায় একই হারে উৎপাদন অব্যাহত রাখা যাবে না। এটি প্রতিবছর কমতে পারে। আবার এরমধ্যে নতুন মজুতও আবিষ্কৃত হতে পারে।
দেশে একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হতো। ২০১৮ সালের পর থেকে উৎপাদন কমতে থাকে। ঘাটতি পূরণে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকে সরকার। তখন নতুন গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোয় তেমন জোর দেওয়া হয়নি। ফলে উৎপাদন কমে এখন ১৯৩ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। গত বছরও এটি ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতা এর জন্য দায়ী। সর্বোচ্চ মজুত থাকার পরও কারিগরি পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির অভাবে তিতাস ও কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। অথচ কম মজুত থাকা বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে কয়েক গুণ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে।
সমুদ্রে তেল–গ্যাস অনুসন্ধানে এখনো তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। সর্বশেষ উন্মুক্ত দরপত্রে কোন কোম্পানি সাড়া দেয়নি। এখন নতুন করে আবার দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। আগামী কয়েক বছরেও সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কারের সুযোগ নেই। স্থলভাগে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে তেমন গতি নেই। আবার পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রে নতুন কূপ খনন করে উৎপাদন বাড়ানোর কাজ চলছে ধীরগতিতে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০টি কূপ খননের কথা থাকলেও গত তিন বছরে হয়েছে মাত্র ১৬টি।
এদিকে উৎপাদনের পাশাপাশি কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান দুটি টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু কোনো টার্মিনাল বন্ধ থাকলেই গ্যাসের সরবরাহ সংকট বেড়ে যায়। বর্তমানে চাহিদার ২৫% আসে এলএনজি থেকে। দিনে আমদানি সক্ষমতা ১১০ কোটি ঘনফুট। নতুন করে কোনো টার্মিনাল নির্মাণ হচ্ছে না। তাই দেশে উৎপাদন কমলেও এলএনজি আমদানি খুব বেশি বাড়ানো যাবে না। যদিও ২০২৬ সাল থেকে এলএনজি সরবরাহ বাড়ানোর একাধিক চুক্তি করে গেছে বিগত সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো সরকারই গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেয় না। আমদানি নির্ভরতা থেকেই এ খাতে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। এলএনজি নির্ভরতা কোনো সমাধান নয়। বাজারে থাকলেও চড়া দামে এলএনজি কেনা কঠিন। গ্যাস সমস্যার সমাধান চাইলে অনুসন্ধান বাড়াতে হবে। তবে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়াতে কূপ খননে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও এতে শিগগিরই উৎপাদন বৃদ্ধির তেমন সম্ভাবনা নেই। তবে নতুন তিনটি কূপ থেকে কিছু উৎপাদন বেড়েছে।
বাংলাদেশে মোট ৪৮টি তেল–গ্যাস অনুসন্ধান ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে স্থলভাগে রয়েছে ২২টি এবং সমুদ্রে রয়েছে ২৬টি। যার মধ্যে ১৫টি গভীর সমুদ্রে ও ১১টি অগভীর সমুদ্রে। স্থলভাগের ২২টি ব্লকের মধ্যে কিছু ব্লকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে এবং কিছু ব্লকে অনুসন্ধান কাজ চলছে। সমুদ্রের ২৬টি ব্লকের মধ্যে কিছু ব্লকে অনুসন্ধান কাজ চলছে এবং কিছু ব্লক এখনো অনাবিষ্কৃত রয়েছে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। যার মধ্যে ২০টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। অর্থাৎ দেশে তীব্র গ্যাস সংকট চললেও এখনো আমরা সবগুলো ব্লকে অনুসন্ধান সম্পন্ন করতে পারিনি। অথচ আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান কোম্পানিগুলোর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ব্লক বিশেষ করে সমুদ্র বক্ষে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস রয়েছে। কিন্তু আমাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সেটি আমরা উত্তোলন করতে পারছি না। তাই সরকারের উচিত ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে সমুদ্র বক্ষসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যবস্থা করা। কারণ সীমান্তবর্তী এলাকায় আমরা গ্যাস না তুললেও প্রতিবেশী দেশগুলো গ্যাস উত্তোলন করে ব্লকগুলো খালি করে ফেলতে পারে। যাতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও এদেশের মানুষ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট