চবির ঝিরিপথে গাছ পাচার

৪৯টি গুঁড়ি জব্দ, বর্ষার পানিতে ভাসিয়ে নেওয়া হচ্ছিল পুষ্পা সিনেমা স্টাইলে

ইমাম ইমু | রবিবার , ২২ জুন, ২০২৫ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

ভারতের দক্ষিণী সিনেমা পুষ্পার মধ্যে দেখা যায় লালচন্দন গাছ পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে। সড়ক পথের কষ্ট কিংবা ঝামেলা ছাড়াই ভাসতে ভাসতে গাছ চলে যায় নির্দিষ্ট স্থানে। সিনেমার সেই স্টাইল অনুসরণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) প্রতিবছর পাচার হয় হাজার হাজার গাছ। বন বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে করা হয় এ কাজ। নেওয়া হয় না বন বিভাগের অনুমতি। বছরের বিভিন্ন সময় এসব গাছ কেটে টুকরা টুকরা করে রাখা হয় ছড়ার ধারে, লুকিয়ে রাখা হয় বনের ভিতরে। এরপর বর্ষা এলে শুরু হয় গাছ পাচার। ভারী বৃষ্টি হলেই বেড়ে যায় গাছ পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য। পানি যত বাড়তে থাকে গাছ ভেসে আসে ততই তাড়াতাড়ি। ভারী বর্ষণের সুবিধা নিয়ে পাহাড়ি ছড়া ব্যবহার করে গাছ পাচারে মেতে উঠে চক্রটি। গহীন বন থেকে এসব গাছ ছেড়ে দেওয়া হয় ঝিরির পানিতে। এরপর এগুলো ভাসতে ভাসতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ঝুপড়ির পার্শ্ববর্তী স্থান, শহীদ আবদুর রব হলের পিছনের জায়গা, স্লুইচ গেইট বা সুবিধাজনক জায়গায় আসলে সেগুলো গাড়িতে তুলে নেওয়া হয় নিজ গন্তব্যে। এজন্য ঝিরির বিভিন্ন পয়েন্টে থাকে গাছ পাচার চক্রের লোকবল। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে গাছ পাচারের এমন দৃশ্য দেখা গেলেও এখন পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে পাচারকারীরা। তবে এর পেছনে মূল কারিগর কে বা কারা সে বিষয়ে সঠিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া না গেলেও গাছ আনয়নকারীরা জানান এসব গাছ তারা কিনে নেন, আবার অনেকে লিজ নেওয়া জায়গা থেকে গাছ কাটেন। বর্ষা মৌসুমে সহজ পথ হিসেবে ঝিরিপথ ব্যবহার করেন।

জানা গেছে, গত বুধবার দুপুরে চবি ক্যাম্পাসের স্লুইচ গেইটে কাটা গাছের গুঁড়ি ভেসে আসার সময় শিক্ষার্থীরা বিষয়টি লক্ষ করে প্রশাসনকে অবহিত করে। পরে প্রশাসন নিরাপত্তা কর্মী পাঠিয়ে গাছগুলো আটক করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ঝুপড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে কাটা গাছগুলো অভিনব কায়দায় ঝিরিপথ ব্যবহার করে সেগুলো জঙ্গল থেকে বের করা হয়। তবে গাছগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের ঝিরিপথ ও স্লুইচ গেট দিয়ে পরিবহন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি না নেওয়ায় গাছগুলো জব্দ করা হয়। এছাড়া আইন অনুযায়ী গাছ কাটার জন্য নেওয়া হয়নি স্থানীয় বন বিভাগের অনুমতি। এভাবে অনুমতি ও ছাড়পত্র ছাড়া গাছ কেটে অবৈধ পথ হিসেবে পরিচিত ঝিরিপথে সেগুলো ভাসিয়ে নেওয়ায় জব্দ করা গাছের মালিক দাবি করা গাছ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে গাছ পাচারের অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে। অভিযুক্ত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি থেকে গাছ কেনার দাবি করলেও কোনো ধরনের প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

অভিযুক্ত গাছ ব্যবসায়ী আলীর দাবি, তিনি মালিকানাধীন জমি থেকে শতাধিক গাছ কিনে সেগুলো চারমাস আগে কেটে রেখেছেন। বর্ষা মৌসুমে শ্রমিক খরচ বাঁচাতে ঝিরিপথে গাছগুলো ভাসিয়ে দেন। কাটা গাছ নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লুইচগেট সংলগ্ন ঝিরি পথ ব্যবহার করতে অনুমতি নেওয়া ও এই পথটি বৈধ কিনা সে ব্যাপারে অবগত ছিলেন না বলে দাবি তার। তবে বৈধভাবে গাছ কাটার কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি ব্যবসায়ী আলী। মালিকানাধীন যে জায়গা থেকে গাছ কাটা হয়েছে বলে দাবি করেছেন আলী সে জায়গার খতিয়ানে মালিকের নামও দেখাতে পারেননি তিনি। আইনানুসারে মালিকানাধীন জায়গা থেকে অধিক গাছ কাটার জন্য স্থানীয় বন বিভাগ থেকে যে অনুমতি নিতে হয় তাও নেওয়া হয়নি বলে স্বীকার করেছেন অভিযুক্ত ওই ব্যবসায়ী। গাছগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাকি সরকারি জায়গা থেকে কাটা হয়েছেসে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে আজ রোববার গাছ কাটার স্পট পরিদর্শন করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্থায়ী বাসিন্দা বলেন, পাহাড় ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে সবুজের সমারোহ বন, পাহাড়, গিরিপথ ও প্রশস্থ একটি ঝিরিপথ। বৃষ্টি হলেই ঝিরিতে তীব্র স্রোত দেখা দেয়। স্রোতের সাহায্যে অসংখ্য কাঠের গুঁড়ি ভেসে আসতে দেখা যায় প্রায়শই।

স্থানীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছরই এভাবে লাখ লাখ টাকার গাছ পাচার করার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিরিপথ ব্যবহার করে গাছ পাচারকারী চক্র। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বনাঞ্চলের গাছও অবৈধভাবে কেটে পাচার করতো এসব সংঘবদ্ধ চক্র। তখন থেকেই এই ঝিরিপথ অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাহাড়ি অঞ্চলে হওয়ায় এখানে অসংখ্য গাছপালা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম সীমানা জুড়ে ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের সমারোহ। খুব বেশি একটা জনবসতি চোখে পড়ে না বললেই চলে। এসব পাহাড়ি জায়গাগুলো সরকার স্থানীয়দের কাছে দীর্ঘমেয়াদে ইজারা প্রদান করে থাকে। এছাড়া রয়েছে বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা। রয়েছে সরকারি জায়গাও। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের তোয়াক্কা না করেই নিজেদের ইচ্ছেমতো গাছ কেটে পাচার করা হচ্ছে এখানকার দেশীয় সম্পদ। আর গাছ পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে ঝিরিপথগুলোকে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ৬() ধারায় বলা হয়, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়, টিলার গাছ কর্তন করা যাবে না। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্বিচারে গাছে কেটে দেশীয় বনজ সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। যা জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকা থেকে বৃক্ষ নিধনের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরেই একটি অসাধু চক্র জড়িত। এতে একদিকে বন সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে অপরদিকে পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই সমস্যাটি সমাধান করতে হলে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকাগুলোতে এ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ঝিরিগুলোতে বাড়াতে হবে নিরাপত্তা।

সম্প্রতি গাছ পাচারের বিষয়ে চবির সহকারী প্রক্টর প্রফেসর ড. মো. কোরবান আলী বলেন, গত বুধবার বিকেল ৩টার পরে স্লুইচ গেট এলাকায় কাটা গাছ ভেসে আসার খবর পাওয়ার সাথে সাথেই সেখানে নিরাপত্তা কর্মী পাঠিয়ে গাছগুলো জব্দ করা হয়। ৪৯টি গাছের গুঁড়ি জব্দ হয়েছে। এর আগেও এখান দিয়ে বেশ কিছু গাছের গুঁড়ি ভাসিয়ে নেওয়া হয়। আমরা জেনেছি প্রতিবছর এ পথ ব্যবহার করে গাছ পাচার করা করা হয়। আমরা এ বিষয়ে খতিয়ে দেখবো। তিনি জানান, রোববার (আজ) গাছগুলো কোন জায়গা থেকে কাটা হয়েছে তা দেখার জন্য স্পট ভিজিটে যাওয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ভেসে আসা গাছগুলো জব্দ করার পর এ বিষয়ে একটি মিটিং হয়েছে। বন বিভাগকে অবগত করার জন্য অফিসিয়াল চিঠি দেওয়া হবে। পরবর্তীতে যে জায়গা থেকে গাছ কাটা হয়েছে সে জায়গা ঘুরে দেখা হবে। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে এসব বনাঞ্চল থেকে গাছ কেটে পাচারের ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ ব্যবহার করে এসব গাছ পাচার হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়কে জরিমানাও গুণতে হয়েছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে একাধিকবার চেষ্টা করেও স্থানীয় বনবিভাগের কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় অস্ত্রসহ দম্পতি গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত হয়ে বৃদ্ধার মৃত্যু, নতুন আক্রান্ত ৬