সৈয়দ জিয়াউদ্দীন একজন সত্তর দশকের লেখক। লেখক জীবনের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ‘বর্ণমালার বর্ণমেলা’ তাঁর প্রথম গ্রন্থ। সেজন্য প্রশ্ন জাগতেই পারে এত প্রবীণ লেখকের এই সুদীর্ঘ সময়ে মাত্র একটি বই কেন? আসলে সৈয়দ জিয়াউদ্দীন এমন একজন লেখক যার লেখনীর অনুরাগ সেই ছোটবেলা থেকেই। সত্তর দশক থেকে দীর্ঘদিন তিনি চট্টগ্রামের সাহিত্যঙ্গনে সগৌরবে বিচরণ করেছেন; কিন্তু জীবিকার তাগিদে সুদূর বিদেশে পাড়ি দিয়ে লেখালেখি থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু শিশুসাহিত্যিক কবি সৈয়দ খালেদুল আনোয়ারের একান্ত আগ্রহে লেখালেখিতে আবার সগৌরবে ফিরে আসা। বিদেশে থেকেও লেখালেখির প্রতি তাঁর অনুরাগের ঘাটতি দেখা যায় না। পরিবেশ হয়তো সেখানে কিছুটা বাধা দেয় কিন্তু মনের জোরে এভাবে আবার ফিরে আসতেই হয় লেখকদের। সৈয়দ জিয়াউদ্দীন তেমন একজন লেখক যিনি বিদেশে থেকে অর্থ বিত্তের মোহে তাঁর লেখক সত্তাকে বিসর্জন দেননি। শিকড়ের টানে আবার ফিরে এসেছেন। ‘বর্ণমালার বর্ণমেলা’ নামে স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা শৈলী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বই নিয়ে ২০২৫ সালে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছেন লেখক সৈয়দ জিয়াউদ্দীন। ক্রাউন সাইজের তিন ফর্মার বইটিতে মোট ২০টি ছড়া কবিতা স্থান পেয়েছে। শিশুমনস্ক সৈয়দ জিয়াউদ্দীন শিশুতোষ ভাবনার আদলে তাঁর নিপূণ হাতের স্পর্শে দারুণ যে শব্দ তৈরির খেলায় মেতেছেন, তা যেকোনো পাঠকের কাছে ভালো লাগবেই। বইয়ের ছড়া কবিতাগুলোতে আমাদের দেশের বর্ণিল সব উপাদান চমৎকারভাবে স্থান দখল করে আছে। যেখানে আছে আমাদের বর্ণমালার কথা ফুল, পশু, পাখি, ঋতু, উৎসব, রূপ, বৈচিত্র্য, উপদেশসহ নানা ধরনের অনুষঙ্গ। বইটির প্রথম ছড়া ‘বর্ণমালার বর্ণমেলা’ যার নামে বইয়ের নাম ছড়াটিতেই তিনি ছন্দের অনবদ্য মেলবন্ধন রচনা করেছেন। স্বরবৃত্তের স্বাভাবিক গতির চাল থেকে একটু বেরিয়ে এসে প্রতি লাইনে চারমাত্রার ছন্দে এগিয়ে যাওয়াটা চমৎকার। ছড়ার প্রথমেই বলছেন ছড়াকার, ‘বর্ণমালার বর্ণমেলায়, একুশেরই ভোরের বেলায়, ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে, ছোট্ট শিশু যায় এগিয়ে।’ ‘ইশকুল’ নামক ছড়াটিতে একটি ছোট্ট খুকুর সাথে পরিবারের সদস্যদের গল্পের ছলে যে ছন্দের বুনন তা বেশ নান্দনিক। ‘গানের পাখি’ নামক ছড়াটিতেও লেখকের কুশলতার পরিচয় মেলে। স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা ছড়াটিতে কোনো ভাঙা পর্ব না রেখে চার চার মাত্রায় এগিয়েছে গেছে ছড়াটি। স্বপ্নের মায়াবী বর্ণনা, ‘ভোরে খুকুর ঘুম ভেঙে যায় গানের পাখির মিষ্টি সুরে, আকাশ ভরা তারার আলো খেলে খুকুর দোলনা জুড়ে।’ ‘হাতের লেখা’ নামের ছড়াটিতে ছড়াকার মাকে চমৎকারভাবে চিত্রায়িত করেছেন, যা যে কোনো সন্তানকে স্মৃতিকাতর করে তুলবে। ‘এই পৃথিবীর সবচে’ সেরা পাঠশালাটাই মা, তাইতো বলে সন্তানেরই স্বর্গ মায়ের পা’ –এমন নিরেট সত্য ও সুন্দর উপলব্ধি মায়ের প্রতি ভালোবাসারই প্রকাশ। টুনটুনি, প্রজাপতি, টিয়াপাখি, ঝিঁঝিঁ, পাখির ছানা নামের ছড়াগুলোতে একধরনের ভিন্ন আমেজ ধারণ করার প্রয়াসী হয়েছেন লেখক। যেখানে আছে ছন্দের বৈচিত্র্য, পাখিসহ আমাদের চারপাশের নানা অনুষঙ্গের স্বভাবজাত চরিত্রকে তুলে এনে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করার নিরলস প্রচেষ্টা। আর এ বিষয়গুলো আমাদের শিশুরা কিন্তু দারুণভাবে উপভোগ করে। তাঁর ছড়া কবিতায় শিশুতোষ মননশীলতার পরিচয় মেলে।‘হতাম যদি’ নামক কবিতায় তিনি বলছেন, ‘হতাম যদি সাগর বুকে চপলা রঙ নীল, মেঘের উপর হারিয়ে যাওয়া ডানা কাটা চিল।’ কাব্য উপমায় কবি এখানে নিজেকে সাদা মেঘের ঢেউ, পাহাড় চূড়া, ছুটে চলা নদীর মত কল্পনা করে পাঠককে নিয়ে যান ভিন্ন এক জগতে। ‘অপূর্ব চিত্র’ নামের ছড়াটি এগিয়ে গেছে চার মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। ‘বকগুলো উড়ে যায় দল বেঁধে ঝাঁকে ঝাঁকে সূর্যটা উঁকি দেয় বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে।’ প্রকৃতির এমন চিত্রায়ন বেশ সুন্দর। স্বপ্ন নামের ছড়ার শেষের অংশে ছড়াকারের উচ্চারণ ‘রকেট বেগে ছুটছে তারা পিছু টানও বাঁধনহারা, দেখতে দ্যুলোক ভূলোক ঘুরে যাবেই যত হোকনা দূরে।’ এখানে একজন কিশোরের দুর্দমনীয় প্রত্যয় বা সংকল্প ব্যক্ত হয়েছে। কিশোরদের সাধারণত এ ধরনের অনুভূতি একটি সহজাত ভাবনা। কবির ভাবনায় যদি তা ফুটে ওঠে তা শিশুকিশোরদের নিকট সুখপাঠ্য হতে বাধ্য। ‘ঝরে পড়া পাতাগুলো দল বেঁধে এলো চুলো কিশোরীরা ঘাটে জল ভরছে, বেলীফুলে মৌমাছি করে মিলে নাচানাচি ফুলকলি তালে তালে নড়ছে।’ ‘জ্যৈষ্ঠের বৃষ্টি’ নামক ছড়ার লাইনগুলো এমন ছোট ছোট মাত্রাবৃত্তের ছন্দে এগিয়ে গিয়েছে যা প্রকৃতির রূপের সাথে মিলে মিশে যেন একাকার হয়েছে। বইয়ের সর্বশেষ ছড়া ‘নতুন ধানের ঘ্রাণ।’ ‘সুজল দিঘির পাড়ে, তমাল বনের আড়ে, ধুরুং খালের বাঁকে, পরিযায়ী পাখি খেলে, এসে ঝাঁকে ঝাঁকে।’ ছড়াকার স্বরবৃত্ত ছন্দে ছয়মাত্রার তিন লাইন ও শেষের লাইনে চারমাত্রার তিনপর্বের সাথে দুই মাত্রার ভাঙা পর্ব দিয়ে চমৎকার অন্ত্যমিলে যা সৃজন করেছেন তা অনবদ্য। এখানে সিংহমামা, নোলক ও ঈদ এলো ছড়াগুলোর বক্তব্যও শিশুমননের সাথে বেশ সংগতিপূর্ণ। ছড়াকার দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করলেও তাঁর লেখার গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হয় তিনি লেখালেখি থেকে মোটেও দূরে ছিলেন না। মন মননে তিনি শৈশবে যেটা ধারণ করেছিলেন সেটা খেকে বিচ্যুত হননি। ‘বর্ণমালার বর্ণমেলা’ বইটির লেখাগুলোর দিকে চোখ রাখলেই তা সহজেই অনুমেয় হবে। বইটির প্রচ্ছদ ও প্রকাশনার মান বেশ মনোমুগ্ধকর। লেখক সৈয়দ জিয়াউদ্দীন সমাজসচেতন একজন লেখক। শিশুমনস্তত্বের বিষয়গুলো তিনি মনে ধারণ ও লালন করেন তা তাঁর লেখা দেখেই বোঝা যায়। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদের প্রচ্ছদ ও শিল্পী নাটু বিকাশ বড়ুয়ার ইলাস্ট্রেশন বেশ মনকাড়া। শৈলী থেকে প্রকাশিত বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ২২০ টাকা। আমি বইটির বহুল প্রচার কামনা করি। লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ