বাংলায় মসনবী শরীফ

মোহাম্মদ আমান উল্লাহ খান | সোমবার , ১৬ জুন, ২০২৫ at ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ

ইসলাম বিশ্বের সকল মানব সম্প্রদায়ের জন্য, সকল যুগের সব দেশ ও জাতির জন্য স্বয়ং খোদা কর্তৃক অনুজ্ঞাত জীবন বিধান। স্বয়ং স্রষ্টা কর্তৃক প্রদত্ত বিধায় ইহা নির্ভুল এবং অপরিবর্তনীয়।

তবে আরব দেশে নাজিল হওয়া আরবী ভাষায় বর্ণিত এ বিধান পৃথিবীর প্রতিটি দেশে নিজ নিজ ভাষা ও আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে এক একটি নিজস্ব কৃষ্টি ও তমদ্দুন সৃষ্টি করেছে।

তার প্রথম উদাহরণ পারস্য দেশ। হোমআরাধ্য এ জাতির মধ্যে ইসলামের প্রবেশ ঘটে হযরত ওমর (রা) এর যুগে। হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের ন্যায় একজন প্রসিদ্ধ সম্মানিত সাহাবী এ দেশটিতে দীর্ঘদিন শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি এবং তাঁর সাথে অবস্থানরত সৈনিক ও কর্মচারী কর্মকর্তাদের সাহচর্যে ইসলামের প্রায় উষালগ্নে পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফের শিক্ষা ও ইসলামী জীবন যাপন পদ্ধতির বাস্তব প্রশিক্ষণ পারস্যবাসী লাভ করে।

অধিকন্তু সে যুগে পারস্য ছিল পৃথিবীর স্বল্প সংখ্যক জ্ঞানেগরিমায়, শিক্ষাসংস্কৃতিতে, চিন্তাচেতনায় ধনেমানে উচ্চতম পর্যায়ের আলোকিত জাতিদের অন্যতম।

পবিত্র কোরআন ও হাদীসের স্বর্গীয় পরশে তাই তাদের মাঝে জেগে উঠল সাদী, হাফেজ, রুমী, জামী, নেজামী, ফেরদৌসী, ওমর খৈয়ামের মত জগত প্রসিদ্ধ মহামানবগণ। যাদের সুবাসে মুগ্ধ হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, কবিগুরু গ্যাটের মত বিশ্বমান্যজনরা।

কবিগুরু গ্যাটে যাকে বাংলার রবীন্দ্রনাথ বা ইংরেজী সেক্সপিয়ারের সাথে তুলনা করা হয়, তিনি মন্তব্য করেছেনভাব যদি বর হয় আর কবিতা হয় কনে, তবে বর কনের মিলন কত মধুর হতে পারে তা তারাই শুধু বুঝবে যারা হাফেজের ভক্ত। উমর খৈয়ামকে পশ্চাত্য জগতের বিদগ্ধ সমাজে পরিচিত করেছেন ফিটজিরাল্ড। ইতোপূর্বে পাশ্চাত্যে তার পরিচয় ছিল একজন জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ হিসাবে। ফিটজিরাল্ডের অনুবাদের কারণে তার কবিত্বগুণে মুগ্ধ ইউরোপের বিদগ্ধজনেরা এখন ‘দূর নিরালা পাতায় ঘেরা শীতল ছায়ায় পাত্র আর প্রিয়ার সঙ্গ’ লাভের স্বপ্নে বিমোহিত।

ভাই গিরিশচন্দ্র যখন প্রথম পবিত্র কোরআন মজিদের আয়াতসমূহ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা শুরু করেন তখন দেশের আলেম সমাজ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন কোরআন পাক নাপাক করার অজুহাত দেখিয়ে। পরবর্তী পর্যায়ে তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয় বিভিন্ন পর্যায়ে। বিশেষ করে মুসলমানের ছেলে নজরুল ইসলামের কাব্যে কোরআন পাকের আমপারা বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে।

মাওলানা জালাউদ্দিন মুহাম্মদ রুমী (রা) বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর সর্বত্র আলেম সমাজের মাঝে জনপ্রিয় মুখ্যত তাঁর পবিত্র গ্রন্থ ‘মসনবী শরীফের’ জন্য। শুধু একটিমাত্র গ্রন্থ একজন লেখককে বিশ্ববিখ্যাত করতে পারে এমন নজির বিরল।

আর এ মহাগ্রন্থের মূল্যায়নও হয়েছে তেমনি অতুলনীয় পর্যায়ে। মুসলিম বিশ্বের আলেম সমাজ একে ফারসি ভাষায় ‘কোরআন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। একটি গ্রন্থের এর চাইতে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে?

আমাদের দেশে শিক্ষিত সমাজের এক বড় সমস্যা হলো যারা আরবী, ফারসি, উর্দু ভালো জানেন তারা বাংলা ইংরেজী ভালো জানেন না। অবশ্য বর্তমান সময়ে এ সমস্যা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। তবে এতে ভালোমন্দ উভয় দিক লক্ষ্যণীয়। কোনো কোনো সময়ে তাতে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী হয়ে যায়।

মসনবী শরীফের সব বক্তব্য ও উপদেশাবলি বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। একবার কোনো এক মাদ্রাসার ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ ছাত্র মসনবী শরীফকে অশ্লীল গ্রন্থ বলে আখ্যায়িত করে নিজ জ্ঞানের বাহাদুরী প্রদর্শন করেছিল (নাউজুবিল্লাহ)। আসলে মসনবীর গূঢ়তত্ত্বে পৌঁছাতে তখন তার অনেক পথ বাকি ছিল। আমাদের মরহুম হুজুর কেবলা হযরত শাহ সুফি মওলানা আবদুল জব্বার সাহেব (রা) তখনও বেঁচেছিলেন। তিনি ছিলেন শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মানুষ। এ কথাটি শুনে তিনি অনবরত সাত দিন মেজাজে ছিলেন। বার বার বলতেছিলেনসে এটার কি বুঝে। মসনবী শরীফ বুঝা কি তার কাজ।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বায়তুশ শরফের প্রবাদপ্রতিম মেধাবী আলেম, আলীয়া নেসাবের সমাপনী পরীক্ষায় তৎকালীন সমগ্র পূর্বপাকিস্তানে প্রথম স্থান অধিকারীহযরত মওলানা কুতুব উদ্দীন সাহেব মন্তব্য করেছিলেন, মসনবী শরীফের শিক্ষা নিতে হলে আমার হুজুর কেবলার ন্যায় শিক্ষক আর আমাদের মত ছাত্র হতে হবে। একটি প্রসিদ্ধ আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ দুজন মনীষীর এ ছিল মসনবী শরীফ সম্পর্কে মূল্যায়ন।

এ মহাগ্রন্থ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার মত জ্ঞান আমার থাকার প্রশ্নই উঠে না। যেখানে কত হাতি কত ঘোড়া গেল রসাতল।

বাংলা ইংরেজীর উপর গভীর জ্ঞানসম্পন্ন আলেমের আমাদের সমাজে অভাবের কথা আগেই বলেছি। বর্তমানে এমনই একজন বিরল ব্যক্তিত্ব মসনবী শরীফকে পদ্য ও গদ্যে বাংলায় অনুবাদ করে আমাদের দ্বারে পৌঁছায়ে দেওয়ার কঠিন কাজটি সমাধা করেছেন। ভাষার উপর জ্ঞান থাকাটাই এ কাজের জন্য একমাত্র পূর্বশর্ত নয়। রচনার প্রকাশপ্রকটনের অন্তর্নিহিত প্রতিভাও এ উদ্যোগে বড় প্রয়োজন। এসব গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিটি জনাব আলহাজ্ব ড. মুহাম্মদ পসা শাহেদী সাহেব।

তাঁর এ মহৎ উদ্যোগের প্রতিফলে আমার মত স্বল্পজ্ঞানী মানুষও মসনবীর সৌরভে মুগ্ধ। তাতে অনুবাদকের জ্ঞানের গভীরতা এবং প্রকাশের ভঙ্গিমার বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে অনুধাবনীয়।

আমি অনুবাদককে বাংলার ফিটজেরান্ড বলে আখ্যায়িত করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করলাম। ব্যক্তিগত জীবনে তার এই সাধনা একই সাথে দেশ সমাজ ও দ্বীনের খেদমত হিসেবে গণ্য হবে, পথ দেখাবে। এমন সব্যসাচী ব্যক্তিত্বের আমি দীর্ঘ সুন্দর সুখি জীবন কামনা করছি।

অনুবাদকের জন্ম চট্টগ্রামের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য সমৃদ্ধ লোহাগাড়ায়। শিক্ষাগ্রহণ করেছেন ঐতিহাসিক শিক্ষা নিকেতন চুনতি মাদ্রাসায় এবং চট্টগ্রামের বাতিঘর হিসাবে চিহ্নিত দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসায়, তারপর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবখানে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চাকালে অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন তিনি। অতপর কোন এক সময়ে বিপ্লবোত্তর ইরানে রাষ্ট্রীয় সফর এবং সেখানে রেডিও তেহরানে চাকরির সুবাদে ইরানী গুলবাগের নির্যাস ধারন করলেন নিজের মাঝে। সে নির্যাসে সুরভিত করলেন বাংলার সবুজ বাগিচা। তার এ অবদান বাংলার বিদগ্ধ সমাজে অক্ষয় হয়ে থাকুক এটিই আমাদের কামনা। অনুবাদকের এ অসাধারণ কর্ম, তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা ও অদম্য অধ্যবসায়ের সুস্পষ্ট পরিচায়ক, যা সাধারণের মাঝে তার অসাধারণত্ব পরিস্ফুট করছে স্বকীয় আলোকে।

(. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবী শরীফের গল্প ১৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেঙ, ১৪৯/, এয়াপোর্ট রোড, ঢাকা।)

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে
পরবর্তী নিবন্ধকন্নড় সাহিত্য ও বানু মুশতাকের ম্যান বুকার পুরস্কার প্রাপ্তি