কর্নাটকের কন্নড়ভাষা সাহিত্যের ইতিহাস এক গভীর প্রাণের উচ্ছ্বাস। সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় জীবনের বহু ঘাত–প্রতিঘাতে আবিষ্ট কন্নড় জাতির লড়াই আবেগ–ও প্রতিবাদী ভাষ্যগুণ কন্নড় সাহিত্য। বহু বিচিত্র আর সংগ্রামশীল সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কালপঞ্জি। জাতি হিসাবে তাদের বুনিয়াদ খুবই মজবুত। ঐতিহাসিক প্রাচীন এই জাতিগোষ্ঠী সব পরিস্থিতিতে নিজেদের সামলে নিতে জানেন। কন্নড় ভাষা বা কানাড়ি ভাষা ভারতের ২২টি যে সরকারি তফসিলি ভাষা, তার অন্যতম একটি। এ – ভাষায় প্রায় সাড়ে তিন কোটি লোক কথা বলে। এটি কর্ণাটক রাজ্যের সরকারি ভাষা। এই ভাষা অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রে প্রচলিত।
কন্নড় মূলত ধ্রুপদী দ্রাবিড় ভাষা, প্রধানত দক্ষিণ পশ্চিম ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে কথ্য। কন্নড় ভাষায় প্রায় ১২০০ বছরের অখণ্ড ইতিহাস আছে। এ পর্যন্ত কন্নড় সাহিত্যকে ৮ টি জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে যা, যে কোনো দ্রাবিড় ভাষার জন্য সর্বোচ্চ ; তথ্যটি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় বেঙ্গালুরু আইন অনুষদের ডাকসাইটে অধ্যাপক ড. সন্দেশ নাইছ, মহোদয়। সজারুর মতো সাদাপাকা চুল, ক্লিন সেভড্ কিছুটা শ্যামলা লম্বা প্রায় ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি অনুমানে। তিনি বসেছিলেন ঠিক আমার পাশে মেডিক্যাল টেস্ট সিরিয়ালে দেবী শেঠি পরিচালিত নারায়ণা হাসপাতাল বেঙ্গালুরুতে। আমি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও খর্বকায় দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কলকাতা থেকে এসেছি কি–না। আমার সবিনয়ে ‘না‘ উত্তর শুনে তিনি হতচকিত হলেন। আমি তাঁর উৎকণ্ঠা কাটিয়ে বল্লাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এ পর্যন্ত ৩ বার আসতে হলো আমাকে – বেঙ্গালুরুতে। তিনি কিছু সময় নিরব থেকে বল্লেন, আপনারাও আগাগোড়া এক সংগ্রামী জাতি। দীর্ঘ মন্দ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হলেন যুদ্ধ করে গত শতাব্দীর একাত্তরে। আমি না চাইতে নিজের পরিচয় দিলেন। ডাক্তারের সিরিয়াল ডাকতে দেরি হওয়াতে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার ভীষণ আগ্রহ কানাড়ি ভাষা ও সংস্কৃতি জানার। তিনি হাস্যোজ্জ্বল বললেন, আপনার কি বুঝতে কিংবা বোঝাতে অসুবিধা হচ্ছে এখানে? আপনি ইংরেজিতে বলুন, ওরা বুঝবে। এখানে অনেকেই ইংরেজি খুব ভালো বলে। কন্নড় ভাষা আসলে কিছুটা দুর্বোধ্য। কন্নড়বাসীর আশেপাশের কোন রাজ্যের নয় এমন কেউ সহজে শিখে নেবে মনে হয় না– এ–সব কথা বলার একটিই কারণ, সমপ্রতি দক্ষিণ ভারতের কথা সাহিত্যিক বানু মুশতাক আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতে নিলেন। হার্ট ল্যাম্প বা হৃদপ্রদীপ কন্নড় ভাষায় লেখা প্রথম ছোট গল্পের সংকলন নির্বাচিত হওয়ার কারণে। বানু মুশতাক একজন উচুমানের মননশীল কথা সাহিত্যিক। পেশায় আইনজীবী ও মানব অধিকারকর্মী। ব্যস্ত সমস্ত দিনকাটে আইন পেশা ও অধিকারকর্মীর নানা বিষয়ক কর্মকাণ্ড নিয়ে। এবং নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলন তাঁর ভূমিকা কন্নড় নারীদের সাহস যোগায়। গত শতাব্দীর শেষের দিকে অর্থাৎ ১৯৯০ থেকে চলতি শতাব্দীর ২০২৩ সালের মধ্যে বানু মুশতাকের লেখা ১২টি ছোট গল্পের হার্ট ল্যাম্প সংকলনটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি। ভাস্তি, সৃজনশীল পরিশ্রমী একজন সফল অনুবাদক। সাহিত্য অনুবাদে বিশেষ করে কন্নড় সাহিত্য অনুবাদে তাঁর নির্যাস চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বুকার পুরস্কার এর অর্থ দু‘জনেই সমান ভাগে নেবেন। বুকার কর্তাদের এমনিই ব্যবস্থাপনা । তো হার্ট ল্যাম্প বা হৃদপ্রদীপ এমনিই পোড়খাওয়া অধিকার বঞ্চিত মুসলিম নারীদের গল্প যা একদম খেটে খাওয়া নারীদের জীবনালেখ্য।
সংখ্যালঘু মুসলমান নারীরা বিবিধ বৈষম্যের শিকার সুবিধাবঞ্চিত ভারতবর্ষের সবখানে, এই ইতিহাস সর্বজনবিদিত। শুধু মুসলমান নারী নয়, মুসলমান সমপ্রদায়ের তরুণদের অবস্থাও সংকটজনক। এ–সব সর্বভারতীয় কর্মকাণ্ডের অংশ। রাজনৈতিক ও সামপ্রদায়িক প্রতিহিংসার অংশ। ভারত সাংবিধানিকভাবে সেকুলার রাষ্ট্রের তকমা লাগালেও সামপ্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার খবরও কম নাই। অনুরূপ অবস্থা বাংলাদেশেও বর্তমান। হিন্দুরাও যে খুব ভালো থাকে বাংলাদেশে তা–ও না। অর্থাৎ এই উপমহাদেশ যেকোনো ভাবেই হোক জাতিগত বৈষম্য ও বিভেদমূলক ঝগড়াফ্যাসাদে ব্যস্ত থাকে সব সময়।
বানু‘র সংবেদনশীলতা ও লেখার জায়গা মূলত মুসলমান নারীদের যাপিত জীবনের দুঃখ – কষ্ট ও সংগ্রামী জীবনের ভিন্ন চিত্রাঙ্কন, শব্দে ও অনুভূতিতে। এটাই প্রথম ছোট গল্পের সংকলন যা সম্মানজনক বুকার পুরস্কার জিতল। বিবিসি বলেছে, সমকালীন দক্ষিণ ভারতীয় কন্নড় ভাষা সাহিত্যে বানু মুশতাক অনন্যসাধারণ নাম। শুধু মাত্র কন্নড় সাহিত্যে বললে তাঁকে খণ্ডিত করা হবে। বানু এখন সর্বভারতীয় সাহিত্যে পরিচিত নাম। আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার তাঁর জীবনে ভিন্ন একটা বাতিঘর। ধর্মীয় রক্ষণশীল আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই সংগ্রামের আলেখ্য তাঁর নারীরা আগুয়ান। তাঁর গল্পের নারীরা সাহস ও ঝুঁকি নিতে পারে। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। প্রয়োজনে অবাধ্য হবার দুর্নিবার শক্তি রাখে। এই উপমহাদেশের নারীরা পুরুষতান্ত্রিকতার অধীনে সর্বক্ষণ থাকার কারণে যেখানে নিজেদের ব্যক্তিত্ব খুইয়ে নারীবাদী আন্দোলন স্থবির, সেখানে বানু মুশতাক নারীদের অনেক দুর্বলতা শনাক্ত করে সামনে এগুতে সাহস যোগান বলিষ্ঠ চিন্তার ঝড়ে। বানু দক্ষিণ ভারতের সংখ্যালঘু প্রান্তিক মুসলমান নারীদের ভরসার স্থল। তাঁর ধারণা মুসলমান নারীরা শিক্ষা–দীক্ষা সভ্যতা, সংস্কৃতিতে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী। সেটি যতটা না সমাজ পর্যবেক্ষণ ও দেখার অভিজ্ঞতার তার–ও অধিক তিনি নিজেও প্রতিশোধমূলক নিপীড়নের শিকার। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এক সমীক্ষায় লিখেছে, ভারতীয় সাহিত্যে মুসলমানেরা অবহেলা ও দহনের শিকার সর্বত্র। বিশেষ করে ভারতীয় মুসলিম মূলধারার নারীদের নৈতিক বিতর্কের জায়গায় স্থাপন করে কলঙ্কিত করার পাঁয়তারা খোঁজেন। বানুর প্রতিবাদ এখানেই। তাঁর গল্পের চরিত্রগুলো বাহাস করে, বুক টান টান করে সম্মুখে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও বানুর গল্পের চরিত্রের অংশ অনেক মজবুত ও গুরুত্বপূর্ণ হ‘য়ে ওঠে। দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বানু বলেন, নারীদের মসজিদে নামাজ পড়ার কথা বলে ২০০০ সালে তাঁকে কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। তাঁকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। সেই প্রচেষ্টায় ছুরি মেরে হত্যার চেষ্টা করে একজন, সঙ্গে স্বামী না থাকলে মেরেই ফেলত। এরপরও লেখালেখি থামানোর কথা কখনো ভাবেননি। তিনি বরাবরই ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন। নারী ও প্রান্তিক মানুষ তাঁর লেখার বিষয়।
বানু মুশতাক বিগত ২১ মে ২০২৫ আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কার লাভের পূর্বে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কার প্রাপ্তি ঘটে তাঁর ঝুলিতে ; সাহিত্যের জন্য কর্ণাটক সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার, দানা চিন্তামণি আত্তিমাব্বে পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা। হার্ট ল্যাম্প গল্পে যখন এক স্বামী, মেরুদণ্ডহীন লোভী দীর্ঘ বৈবাহিক জীবনের পর স্ত্রীকে ছেড়ে যৌতুকের জন্য বিয়ে করে অন্য এক তরুণী –কে, তখন কাহিনির কেন্দ্রে উঠে আসে মায়ের প্রতি কন্যার অসীম ভালোবাসা। এবং ধীরে ধীরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি তীব্র ঘৃণা, বিরক্তি ও বিবমিষা থেকে ক্ষোভ এবং প্রতিবাদ।
অনুবাদক দীপা ভাস্তি লেখকের প্রতিবাদের ভাষা, লেখার সততা এবং ঘটনাক্রমের বিবিধ খুঁটিনাটি বুঝে ফেলেন গভীর মননশীলতায়।
বানু মুসতাক হার্ট ল্যাম্পের ঝলমলে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে এ–ই উপমহাদেশের ঘরে ঘরে। মেহেরুন নরম প্রবণ নারী চরিত্র স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কারণে স্বামীর ঘর ছেড়ে বাবার বাড়ি ফেরত আসে। স্বামী হাসপাতালের নার্স –কে দ্বিতীয় বিয়ে করে। এ–ই টানাপোড়েন নিয়ে গল্পটা এগিয়েছে। কাহিনি নির্ভর চরিত্র। মেহেরুন–কে নিয়ে দ্বন্দ্ব বিশ্বাস– অবিশ্বাস হৃদবাতি গল্পটি জুড়ে। প্রচলিত গল্পের ছকে একটি সামাজিক কাহিনি। তবে নারীর আত্মনির্ভরশীলতা ফিরে পাওয়ার সাহস সব মিলে অনন্য। জেদ ও আত্মসম্মানবোধ মেহেরুন চরিত্র –কে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। ১২ টি গল্পের সমবায়ে নামগল্প হৃদবাতি এই গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য একটি গল্প। গল্প গ্রন্থটি বুকার সম্মাননা পেয়ে সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট