চট্টগ্রাম নগরীর কাট্টলী অঞ্চলটি বহু কীর্তিমান জ্ঞানীগুণী মানুষ, কবি সাহিত্যিক, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, বর্ষীয়ান নেতা, দেশের শীর্ষ পর্যায়ের খ্যাতনামা জনপ্রিয় বহু গায়ক গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, অভিনেতা অভিনেত্রীসহ বহু দেশ বরেণ্য গুণীজনের পদচারণায় এর মাটি ও জনপদ হয়েছে ধন্য। কাট্টলীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঝুলি হয়েছে সমৃদ্ধ ও গর্বিত।
গবেষকদের মতে কাজী নজরুল ইসলাম তৎকালীন সময়ে পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ সারা বাংলাদেশে কাজির শিমলা, দৌলতপুর ও কান্দিরপাড় বাদ দিলে ১২ বছরে মোট ১৮ টি জায়গায় ২৭ বার এসেছেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৬ এই একযুগে এতবার ঘুরে যাওয়াটা ছিল তাঁর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সফর।
কাট্টলীতে সংবর্ধনা নিতে যেদিন এসেছিলেন সেই দিনটা ছিল ১৯২৯ সালের ২১ জানুয়ারি। মাঘ মাসের শীতল পবনের রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল। কাট্টলীতে আসছেন সাম্য ও মানবতা, প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর পদচারণায় ধন্য হবেন কাট্টলীর আপামর জনতা। মুখরিত হবে পুরো জনপদ। সবার মুখে মুখে চলছিল কবি বন্দনা। উৎসব মুখর পরিবেশে চারিদিকে সাজ সাজ রব। এই এক অন্যরকম অনুভূতিতে অধীর আগ্রহে সবাই কবি‘র পথপানে চেয়ে চেয়ে যেন অপেক্ষার শেষ নেই। আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই তাকিয়ে আছেন কবি কখন আসবেন, একনজর প্রাণভরে কবিকে দেখবেন, বক্তৃতা শুনবেন, শুনবেন কবি‘র কণ্ঠে গান গজল আবৃত্তি।
কাট্টলীর তৎকালীন তরুণ যুবকদের প্রগতিশীল ক্লাব ‘কাট্টলী ইউনিয়ন ক্লাব’ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলাকে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক ছিলেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বিশিষ্ট লেখক বহু গ্রন্থের অনুবাদক, চার হাজার আরবি ফার্সি শব্দের অভিধান প্রণেতা তৎকালীন বুদ্ধিজীবী মহলে সুপরিচিত কাট্টলীরই কৃতীপুরুষ মাওলানা তমিজুর রহমান। আরেকজন ছিলেন অদ্যম প্রগতিশীল তরুণ মাহমুদুন নবী চৌধুরী (পরবর্তীতে প্রাদেশিক মন্ত্রী হয়েছিলেন )।
দুপুর থেকে অনুষ্ঠানসহ কর্নেল হাট চত্ত্বর লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। জানা যায় দূর থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কবিকে দেখার জন্য কিছু মহিলাও সমবেত হয়।
সেবার চট্টগ্রাম এসে কবি কাজী নজরুল ইসলাম উঠেছিলেন হাবীবুল্লাহ বাহারের তামাকুমণ্ডির আজীজ মঞ্জিলে। সেখানে দুপুরের খাবার সেরে শোভাযাত্রা সহকারে কবি কাট্টলীর অনুষ্ঠানে পৌঁছেন সোয়া ২ টার দিকে। কবিকে সরাসরি মঞ্চে নেওয়া হয়। সেই সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমান ছাপাখানা এসলামাবাদ প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ মৌলানা আজিজুর রহমান।
সভায় কবি‘র শ্রদ্ধার্ঘ্যে একখানা মানপত্র রচনা ও পাঠ করা হয়। মানপত্রটি রচনা ও পাঠ করেছিলেন মাওলানা তমিজুর রহমান। সেই মানপত্রটি হুবহু তুলে ধরা হলো–
অগ্নি–কবি কাজী নজরুল ইসলামের খায়রে–মকদম উপলক্ষ্যে–
আজ আমাদের গুল্ শনেতে ফুল ফুটেছে শীতের কালে,
অগ্নিবীণার বুল্ বুলিটী গাইবে
গযল ডালে ডালে।
আয়রে দয়েল, আয় পাপিয়া,
ভক্তি গুলের হার গাঁথিয়া,
আগমনীর নায্ রানা দে,
বিশ্ব–কবি নজরুল গলে,
গরীর দেশে আর কি আছে
তোহ্ফা দিতে চরণ তলে।
আয়রে কবি, বঙ্গ–রবি,
আঁকিয়ে দে তোর রক্ত–ছবি,
বিশ্বজোরা কীত্তি তোমার
থাকুক লিখা যুগের তালে,
হিংসা–অনল দগ্ধীভূত
করুক তোমার শত্রু দলে।
উরফি তুমি, ছাদি তুমি,
জামি ও ফেরদৌছি তুমি,
আনওয়ারী, খাকানী তুমি,
ঘোষবে জগৎ কালে কালে।
বঙ্গদেশে জন্মেছিলে
বাঙালীদের ভাগ্যফলে।
সর্ব্বহারা জাতি মোরা,
হিংসা দ্বেষে দেলটী ভরা,
গুনের আদর করতে জানে
কয়জন আছে মোদের দলে
তাইত এই বিশাল জাতি
যাচ্ছে ক্রমে রসাতলে।
তুমি কবি ভাবের আকর,
ভাবগুলিত তোমার চাকর,
অনায়াসে ভাবের ধারা
আনতে পার এমন ছলে,
দোশ্ মনেরাও দোস্ত হয়ে
নাচে যেমন তোমার তালে।
ধ্বংস পথের যাত্রী মোরা,
তরক্কি পথ চাই আমরা,
তুমি পার কাব্য ছলে
পথ দেখাতে সর্ব্ব–দলে
বিশ্ব–প্রেমের কীত্তি যেন
বজায় থাকে ধরাতলে।
মানপত্রটি পাঠ করার সময় কবি নজরুল বার বার তাকাচ্ছিলেন এবং এক পর্যায়ে মানপত্রের লেখক মাওলানা তমিজুর রহমানকে জড়িয়ে ধরেন। এরপর কবি গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়া হয় এবং মানপত্রটি হাতে তুলে দেয়া হয়।
সভায় অন্যান্য বক্তার পর কবি জাতীয় শিক্ষা–সংস্কৃতি ও সভ্যতার উপর দীর্ঘ ভাষণ দেন। মনোমুগ্ধ হয়ে পিনপতন পরিবেশে শ্রোতারা তাঁর দীর্ঘ বক্তব্য শুনেন। এরপর প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল শ্রোতাদের অনুরোধে কবিতা আবৃত্তি, গান ও গজল পরিবেশন করেন।
সভা শেষে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সদলবলে জাস্টিস উইলিয়াম জোনস রোড দিয়ে পায়ে হেঁটে সাগরপারে যান এবং সেখানে কিছুক্ষণ সময় ভাবাবেগে সমুদ্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন। (তথ্যসূত্র : বিভিন্ন প্রবন্ধাদি)
লেখক : প্রাবন্ধিক, ছড়াকার