হজ্বের মৌসুম আসলেই আমাদের হৃদয় পটে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর আত্মত্যাগ এর ঘটনা। তিনি মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আত্নত্যাগ করেছেন। মহান রাব্বুল আ’লামিন পৃথিবীতে যত নবী–রাসূল (সাঃ) পাঠিয়েছেন সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। সেজন্যেই তাঁর পবিত্র কালামে পাকে ২৫টি সূরার ৬৩ টি আয়াতে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এবং তাঁর নামে একটি সূরা–ই আল্লাহতায়ালা অবতীর্ণ করেছেন। এটি কোরআনের ১৪তম সূরা। আল্লাহর কাছে আত্নসমর্পণের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। শৈশবকাল থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী। আল্লাহতায়ালা যাদেরকে নবী হিসেবে নির্বাচন করেন, তাঁদের জীবন আলেখ্য অন্যান্যদের থেকে ব্যতিক্রম। তাদের চাল–চলন, আচার–আচরণ, পোষাক–আশাক, মানসিকতা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পিতা আযর ও তাঁর সম্প্রদায় ছিল মূর্তিপূজারী। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) শৈশব থেকেই এগুলো পছন্দ করতেন না। সেজন্যই তো তিনি তাঁর পিতাকে বলেছিলেন, ‘হে আমার পিতা তোমরা কেন এগুলোর পূজা কর? তাদের তো কথা বলার ক্ষমতা নেই, চলারও ক্ষমতা নেই’। আযর বললেন, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের এগুলো করতে দেখেছি। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) শিশুকাল থেকেই তাঁর রবের অনুসন্ধান করতে লাগলেন। আল্লাহর কোরআনে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর কথাগুলো স্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে এভাবেই, ‘যখন তাঁর উপরে আধাঁর ছেয়ে রাত এলো, তখন সে একটি তারকা দেখতে পেল, সে বলে উঠলো–এই (বুঝি) আমার মালিক, অতঃপর যখন তারকাটি ডুবে গেল, তখন সে বলল যা ডুবে যায় তাকে তো আমি (আমার মালিক বলে) পছন্দ করতে পারি না! যখন সে একটি জ্বলমলে চাঁদ দেখলো তখন বললো এই আমার মালিক, অতঃপর যখন তাও ডুবে গেল তখন সে বলল, আমার রব যদি আমাকে সঠিক পথ না দেখান, তাহলে আমি অবশ্যই গোমরাহ লোকদের দলে শামিল হয়ে যাব, সে যখন একটি আলোকিত সূর্য দেখলো এবং বলতে লাগলো, এই আমার মালিক (কারণ এই যাবৎ যা দেখেছি) এটা সবচাইতে বড়, তাও যখন ডুবে গেল তখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নিজের জাতিকে ডেকে বলল, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! তোমরা যে সব কিছুকে অংশীদার বানাও আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এরপরে তিনি বললেন, ‘আমি নিষ্ঠার সাথে সেই মহান সার্বভৌম মালিকের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি যিনি এই আসমানসমূহ ও জমিন পয়দা করেছেন, আর আমি মুশরিকদের দলভুক্ত নই’– সূরা আল আনআম–৭৬–৭৯। এরপরে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন এবং শিরকের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগলেন কিন্তু কেউ তাঁর দাওয়ার গ্রহণ করেননি। সেখানে তিনি নিজেই ছিলেন একটি জাতি। তাঁর জন্মস্থান ইরাকের একটি নগরী ব্যবিলনের বাদশা ছিলেন নমরুদ। নমরুদ নিজেকে বড় খোদা দাবি করত। আল্লাহর তওহীদের বাণী যখন তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সেটি নমরুদ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। সে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে আগুনে নিক্ষেপ করার জন্য এক বিশাল অগ্নিকুন্ড তৈরি করল। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা ১ মাস ধরে জ্বালানী সংগ্রহ করে ৭ দিন ব্যাপী সেই অগ্নিকুন্ডটা প্রজ্বলিত করল। আর সেখানে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)কে নিক্ষেপ করে দিল। কিন্তু আসমান জমিনের মালিক আল্লাহতায়ালা ছিলেন মহা পরিকল্পনাকারী। তিনি আগুনকে নির্দেশ দিলেন যে, ‘হে আগুন তুমি আমার হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর জন্য নিরাপদ ও ঠান্ডা হয়ে যাও’। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বললেন, নমরুদের অগ্নিকুন্ডে আমি যে সুখ উপভোগ করেছি, আমার জীবনে কোনদিন সেই ধরনের সুখ উপভোগ করতে পারিনি। অনেকগুলো পরীক্ষা আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে দিয়েছিলেন এবং সেগুলো তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ৮৬ বছর বয়সে আল্লাহতায়ালা তাঁকে একটি সন্তান দান করলেন এবং সেটি তাঁর দোয়ার ফসল। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন এভাবে, ‘হে আমার রব তুমি আমাকে নেককারদের মধ্য থেকে একটি সন্তান দান কর। এরপর তাকে একজন ধৈর্যশীল পুত্রের সু–সংবাদ দিলাম’–সূরা আছ ছাফফাত–১০০–১০১। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো, স্বীয় পুত্র ও তাঁর স্ত্রীকে সহ মক্কার জনমানবহীন প্রান্তরে রেখে আসতে হবে, আল্লাহর নির্দেশে তিনি তাই করলেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তখন সিরিয়ায় ছিলেন। এর পরের পরীক্ষাটি আরও ভয়ংকর–যেটি আল্লাহর কোরআনে এভাবে এসেছে, ‘সে যখন তাঁর পিতার সাথে দৌড়াদৌড়ি করার মতন অবস্থায় উপনীত হল তখন সে একদিন ছেলেকে বলল, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি আমি তোমাকে জবাই করছি, তোমার অভিমত কি? হযরত ইসমাঈল বললেন, হে আমার স্নেহপরায়ণ আব্বাজান, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা পালন করুন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন’ সূরা আছ ছাফফাত – ১০২–১০৩। এভাবে পিতা–পুত্র আল্লাহতায়ালা সামনে আত্নসমর্পণ করলেন। আল্লাহতায়ালা বললেন, তোমরা উভয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। আসলে এটা ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা মাত্র। এভাবে আল্লাহতায়ালা পরীক্ষার উপর পরীক্ষা করে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)কে মুসলিম জাতির স্থপতি বানিয়েছেন। যা আল্লাহর কোরআনে এসেছে এভাবেই, ‘যখন ইব্রাহীম (আঃ) কে তাঁর রব কতিপয় বিষয়ে আনুগত্যের পরীক্ষা করলেন অতঃপর সে তা পুরোপুরি পূরণ করল। আল্লাহতায়ালা বললেন আমি তোমাকে মানবজাতির জন্য নেতা বানাতে চাই, সে বলল–আমার ভবিষ্যৎ বংশধররাও কি নেতা হিসেবে বিবেচিত হবে? আল্লাহতায়ালা বললেন, আমার এই প্রতিশ্রুতি জালেমদের কাছে পৌঁছাবে না’ – সূরা আল বাকারা–১২৪। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর জীবনের সাথে পবিত্র হজ্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আল্লাহতায়ালা তাঁকে নির্দেশ দিলেন, ‘আমি যখন মানুষদের মিলনস্থল ও নিরাপত্তার কেন্দ্র হিসেবে কাবাঘর নির্মাণ করেছিলাম, তখন তাদের আদেশ দিয়েছিলাম–তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর স্থানটিকে নামাজের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর। আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আরও আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের জন্য, আল্লাহর ইবাদতে আত্ননিয়োগকারীদের জন্য, রুকু ও সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখে’– সূরা আল বাকারা– ১২৫। এই হজ্ব ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি ফরজ ইবাদত। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তর থেকে হজ্বব্রত পালন করতে যায় পবিত্র মক্কা নগরীতে। আল্লাহতায়ালা নবী ইব্রাহীম (আঃ) কে নির্দেশ দিলেন, ‘আমি তাকে আদেশ দিয়েছিলাম–তুমি মানুষদের মাঝে হজ্বের ঘোষণা করে দাও, যাতে করে তারা তোমার কাছে দূর দূর থেকে পায়ে হেঁটে এবং দূর্বল উটের পিঠে আরোহন করে ছুটে আসে’–সূরা আল হজ্ব–২৭। হাজীরা মুখে তালবিয়া পড়তে থাকবে অর্থাৎ ‘হে রব হাজির, আমি হাজির। তোমার কোনো শরীক নেই, সমস্ত প্রশংসা, সমস্ত নেয়ামত এবং বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক তুমি। তোমার কোন শরীক নেই’। হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মাঝে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল: সায়ী করা অর্থাৎ সাফা–মারওয়া পাহাড়ের মাঝে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করা। যেদিন শিশুপুত্র ইসমাঈলকে আল্লাহর নবী ইব্রাহীম (আঃ) জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে রেখে এসেছিলেন তখন সামান্য পানির জন্য হযরত হাজেরা এই দুই পাহাড়ের মধ্যে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন, সেই দৌড়াদৌড়ি আল্লাহর কাছে এত পছন্দ হয়েছে তাঁর সমস্ত মুসলমানদের জন্য আগামী কেয়ামত পর্যন্ত সায়ী করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। হজ্বের শেষে আরেকটি বিষয় উঠে আসে সেটি হল কোরবানি। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর স্বীয় পুত্রকে আল্লাহর নির্দেশে জবাই করার জন্য মিনা প্রান্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর গলায় ছুরি চালানোর সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশনা আসে, হে ইব্রাহীম (আঃ) তোমার ধৈর্য, আত্নত্যাগ আমার কাছে পছন্দ হয়েছে। হযরত ইসমাঈল এর স্থলে একটি পশু কোরবানি হয়ে গেল। সেই থেকে এই কোরবানি সমস্ত মুসলমানদের উপর ওয়াজিব করে দিলেন আল্লাহতায়ালা। যদিও কোরবানির প্রাথমিক ইতিহাস হযরত আদম (আঃ) এর থেকেই শুরু হয়েছিল। এই কোরবানির মধ্যে অনেক শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা হল পশু কোরবানির সাথে সাথে নিজের মধ্যে যে পশুত্ব রয়েছে তা আল্লাহর রাহে বিসর্জন দেওয়া এবং আল্লাহর প্রতি তৌহিদের বিশ্বাসকে দৃঢ় ও সমুন্নত করা। নিজের সমস্ত পাপ–পংকিল, অশুভ মানসিকতাকে পরিহার করে আল্লাহর রাহে আত্নসমর্পণ করাই হল কোরবানির অন্যতম শিক্ষা।
লেখক : সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল