ঈদের দিন। খুব ভোর সকালে আফিয়া ঘুম থেকে উঠে তার কাছে শুয়ে থাকা ফুফাতো বোন মার্জিয়াকে ডাকছে। এই উঠিসনে ক্যান! ওঠ, তাড়াতাড়ি ওঠ। কিন্তু মার্জিয়া শুধু উহ্ উহ্ করছে আর এপাশ ওপাশ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ছে। অনেকক্ষণ ধরে ডাকার পরেও যখন মার্জিয়া ঘুমিয়েই রইলো, তখন আফিয়ার একটু আনন্দমাখা রাগ হলো। টেবিলে থাকা জগ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে মার্জিয়ার চোখে ছিটালো। আর অমনি মার্জিয়া রেগেমেগে জেগে পড়লো। আফিয়া তাকে যেই বললো– এই, আজ না ঈদের দিন! আর তুই ঘুমিয়ে থাকবি? একথা শুনেই মার্জিয়ার রাগ কেটে ঘুমের ক্লান্তি মুছে আনন্দে মনটা ভরে গেলো। তারপর দুইবোন মিলে একসাথে দাঁত ব্রাশসহ বাথরুমের কাজ সারলো।
ওদের ঘুম থেকে দেরিতে ওঠার কারন হলো, কাল রাত প্রায় সোয়া একটা পর্যন্ত দুজনই জেগেছিলো। হাতে মেহেদি লাগানো, নতুন জামা–কাপড় দেখাদেখি, বন্ধু–বান্ধবদের মোবাইলে দাওয়াত, আর ঈদের দিন সকালে উঠে ঈদগাহে যাবার আগে কার কার কাছ থেকে সেলামি নেবে এসব বলাবলি করে অন্যরকম একটা আনন্দে কাটালো রাত।
তখন আফিয়ার ঘুম আসছিল, কারন সে গ্রামের মেয়ে। সকাল সকাল ঘুমানো আর ভোরে ঘুম থেকে ওঠা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। কিন্তু মার্জিয়ার চোখে ঘুম আসছিলো না মোটেও। কারন সে শহুরে মেয়ে। অনেক রাতে ঘুমুতে যাওয়া শহুরে লোকদের অভ্যাস। সে ঢাকায় থাকে। এবার সে তার বাপ–মা’র সাথে গ্রামের মামা বাড়িতে ঈদ করতে এসেছে। সে ভালো ডিজাইন করে মেহেদি লাগাতে পারে। ছোট ছোট মামাতো ভাইবোনদেরকে আগে আগেই মেহেদি লাগিয়ে দিলে তারা আনন্দমনে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লো। আর আফিয়া একটু বড়, মার্জিয়ার মত ক্লাস ফাইভে পড়ে। তাই আফিয়াকে সে একটু সময় করে অনেক সুন্দর করে হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিলো। আর সে নিজেও নিজের হাতে খুব সুন্দর করে মেহেদি লাগালো ।
ঈদগাহে যাবার জন্য তারা দুজনই এখন প্রস্তুত। ঈদের সেলামি নিবে এখন। বাড়ির পুকুর থেকে দুজনে মিলে গোসল সারে একসাথে। গোসলের সময় খুব মজা করেছিলো আফিয়া মারজিয়াকে নিয়ে। কারন সে সাঁতরাতে পারে না। আফিয়া পানির তলে ডুব দিয়ে মার্জিয়ার পা টেনে ধরলে মজার এক কান্ড হয়েছিলো। আফিয়া ভয় পেয়েছিলো আর কয়েক ঢোক পানিও খেয়েছিলো। খুব হাসছিলো আফিয়া মারজিয়ার কান্ড দেখে। মার্জিয়ার একটু রাগ হলেও পরে ঠিক হয়ে গেছিলো। ডুবিয়ে ডুবিয়ে গোসল করে এক অন্যরকম মজা লুটেছিলো মার্জিয়া। যাই হোক, এখন তারা ঈদের সেলামি নিতে প্রথমে গেলো আফিয়ার আব্বুর কাছে। একশ টাকার দু’খান নোট দিলো দুজনকে। তারপর মার্জিয়ার নানার কাছ থেকে ওইরকমই পেলো। কিন্তু ছোটমামার কাছ থেকে ওরা বেশি নেবে এটা কাল রাতেই পরিকল্পনা করেছিলো। ছোটমামা ওদের একশ টাকার দু’খান নোট দিলেও ওরা নিলো না। তারপর আরও একখান নোট দিলো তা–ও নিলো না। শেষমেশ পাঁচশো টাকার একখান চকচকে নোট দিলে ওরা মহা খুশিতে ঈদগাহে চলে গেলো। আফিয়ার মা সকালে খিচুড়ি ও ডিম ভাজি করেছিলো। তারা দু’জন মিলে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঈদগাহে চলে গেলো।
ঈদগাহে গিয়ে দেখে কতো দোকানপাট বসেছে। পাড়ার সব মুসল্লিরা নামাজ পড়তে এসেছে। আর বাচ্চারা দোকানে দোকানে ঘুরাঘুরি করছে। ইচ্ছেমত নতুন টাকার নোট দিয়ে ভাজা, পাঁপড়, জিলাপি কতো কি কিনছে। কুমারেরা ছোটদের জন্য মাটির তৈরি রঙিন হাঁড়িপাতিল ও খেলনা সাজিয়ে বসেছে। মার্জিয়া এটা দেখে তো অবাক! মনে মনে বললো– মাটি দিয়ে কতো সুন্দর করে এগুলো বানিয়েছে তারা। সে মার্জিয়ার সাথে ঘুরে ঘুরে পছন্দমত অনেক কিছু কিনলো।তারপর পাঁপড় খেলো, ভাজা খেলো, চটপটিও খেলো। চটপটি খাওয়ার সময় মার্জিয়া হঠাৎ দেখতে পেলো একটা গাছের নিচে একটা ছেলে মনমরা হয়ে বসে আছে। মার্জিয়া আফিয়াকে বলল– চল্ তো ওখানে। গাছতলায় ওই ছেলেটা ওখানে বসে আছে কেন। আফিয়াও বললো– হুম, চল্ তো গিয়ে দেখি।
আফিয়া ছেলেটিকে দেখে চিনতে পেরেছে। ছেলেটির চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়ছে। মার্জিয়া ছেলেটির এ রকম অবস্থা দেখে খুব মায়া অনুভব করছে। ছেলেটিকে বললো– তুমি কাঁদছো কেন ভাই? ছেলেটি কোনো উত্তর দিলো না। আফিয়া ছেলেটিকে চেনে। ওদের পাড়ারই এক গরীব অসহায় বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে । তার বাবা মারা গেছে ক’বছর আগে। ওর মা বাড়ি–বাড়ি কাছ করে সংসার চালায়। আফিয়া মার্জিয়াকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে এসব কথা বললো। শুনে মার্জিয়া খুব দুঃখ অনুভব করলো।
তারপর ছেলেটির কাছে গিয়ে বললো– তুমি কাঁদছো কোন ভাই? আজ তো ঈদের দিন। আজ আনন্দ করতে হয়। হাসিখুশি থাকতে হয়। ছেলেটি একথা শুনে আরও জোরে জোরে কেমন ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগলো। তখন আফিয়া ছেলেটিকে বললো– এই মতিন তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর? বল্ না ভাই! মতিন আফিয়াকে চেনে, একই স্কুলে পড়াশোনা করে তারা। তাই আফিয়ার কথার উত্তর দিলো। কাঁদা–কাঁদা কন্ঠে ছেলেটি বললো– আমার আম্মু আমাকে বিশ টাকার একটি নোট দিয়েছে। পাঁপড় আর ভাজা কিনে ফুরিয়ে গেছে। আমার কাছে আর কোন টাকা নেই। তাই আমি এখানে বসে আছি। একথা শুনে আফিয়াদের মনে খুব কষ্ট হলো। তারপর আফিয়া আর মার্জিয়া দুজনে মিলে যুক্তি করে একশ টাকার দুটি নোট মতিনকে দিলো। মতিন নিতেই চাচ্ছে না। অনেক বলা–কওয়ার পরেই তবে নিলো। তারপর আফিয়া মতিনের হাত ধরে উঠিয়ে বললো– চল্, আমাদের সাথে ঘুরবি । মার্জিয়াও বললো– হ্যা ভাই! তুমিও চলো, আমরা সবাই একসাঘথে ঘুরাঘুরি করি। আনন্দ ভাগাভাগি করি।
ভালোবাসা মাখা এমন কথা শুনে কেউ কি থাকতে পারে। মতিনের শরীরটা কেমন হালকা হয়ে গেলো মুহূর্তে। মনের ভিতর ঈদের খুশির জোয়ার ঢুকে গেলো। মতিনের চোখেমুখে কেমন যেনো আনন্দের ফোয়ারা। এটা দেখে আফিয়াদেরও খুব ভালো লাগছে। তারপর ওরা তিনজন মিলে ঈদের মেলায় খুব আনন্দ সহকারে ঘুরাঘুরি করে কাটালো। মতিন আনন্দের ভাগ পেয়ে খুব খুশি হলো।