মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ভারী বৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে দুর্যোগ পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস দেখা দিয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ফসলি জমির। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে। এছাড়া বান্দরবানের লামা উপজেলায় পর্যটন রিসোর্ট সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন।
রাঙামাটি : রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, গতকাল রোববার জেলার কয়েকটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। ভারী বর্ষণ ছাড়াও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে প্লাবন পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। উজানের পানি ও বৃষ্টিতে কাপ্তাই হ্রদের পানি বাড়ছে। গত শনিবারের চেয়ে গতকাল আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দুর্গতদের আশ্রয়ে পুরো জেলায় ২৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে ৬৭২ জন আশ্রয় নিয়েছেন। জেলায় ৫৩টি ঘরবাড়ির আংশিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ৬৩ হেক্টর কৃষি জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এদিকে, টানা বৃষ্টির প্রভাবে জেলায় বড় পাহাড় ধসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে গতকাল রাঙামাটি–চট্টগ্রাম সড়কের মঘাছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড় থেকে মাটি ধসে পড়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ তাৎক্ষণিক ধসে পড়া মাটি অপসারণে কাজ করছে। এতে চট্টগ্রামসহ খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সঙ্গে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে জুরাছড়ির ও কাউখালী উপজেলার দুটি অভ্যন্তরীণ সড়ক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সড়ক দুটোতে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে, জেলার বাঘাইছড়ি পৌরসভা এলাকা, জুরাছড়ি উপজেলা ও সদর উপজেলার সাপছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল, নানিয়ারচর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে সড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি। ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন এইসব এলাকার মানুষ। তবে প্রশাসনের কাছে ঘরবন্দি মানুষের প্রকৃত তথ্য নেই। সদর উপজেলার সাপছড়ি ইউনিয়নে পাহাড়ি প্রায় ২০০টি পরিবার প্লাবিত হয়েছে।
বাঘাইছড়ির ইউএনও শিরীন আক্তার জানান, বাঘাইছড়ি পৌর এলাকার আশেপাশে কয়েকটি গ্রামে পানি উঠেছে। উপজেলার ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে খোলা রাখা হয়েছে। তবে আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজনের উপস্থিতি কম। সদর উপজেলার ইউএনও রিফাত আসমা বলেন, সদর উপজেলায় সাপছড়ি ইউনিয়নে অতিবৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। প্রায় ২০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর রাঙামাটি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, রাঙামাটি জেলার সড়কগুলোতে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে ১৫টি স্থানে ছোট ছোট মাটি ধসের ঘটনা ঘটেছে। সড়ক বিভাগ তাৎক্ষণিক সেগুলো অপসারণ করে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক করে দিয়েছে। সড়কে যান চলাচল সচল রাখতে আমাদের টিম সবসময় কাজ করছে। রাঙামাটি জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বলেন, দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষ হতে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। জেলায় মোট ২৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আমাদের ইমারজেন্সি টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা লোকজনদের পর্যান্ত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস দেখা দিয়েছে। গতকাল ভোরে ধুমনীঘাট এলাকায় পাহাড় ধসে মহালছড়ির সাথে জালিয়াপাড়া সড়কে যান চলাচল কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়। এছাড়া খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভূয়াছড়ি, গুগড়াছড়ি ও ন্যান্সি বাজার এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণহানির ঘটনা না হলেও যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। গতকাল সকাল থেকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শালবন, কুমিল্লাটিলা, ১৮ পরিবার, হরিনাথপাড়া গ্যাপ, নেন্সিবাজার, কলাবাগানসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করছে জেলা প্রশাসন।
সদর উপজেলার ইউএনও সুজন চন্দ্র রায় বলেন, পাহাড় ধসের ঝু্ঁকিতে থাকা অন্তত ৫ শতাধিক মানুষকে জেলা সদরের শালবন এলাকার শিশু কল্যাণ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়ে আসা হয়েছে। তাদেরকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খিচুড়ি এবং ডিম রান্না করে খাওয়ানো হচ্ছে। সদর উপজেলায় চারটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান বলেন, সকাল থেকে বিভিন্ন সড়কে পাহাড় ধসে যায়। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি–চট্টগ্রাম সড়কের আলুটিলায় এক অংশে পাহাড় ধসে পড়েছে। সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সড়ক সচল করতে কাজ করছে। এছাড়া দীঘিনালা–লংগদু সড়কে করইল্যাছড়ি এলাকায় পাহাড়ের মাটি ধসে যায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়। পরে সড়ক বিভাগ মাটি সরানোর কাজ করে।
এদিকে দীঘিনালার মাইনী নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ডুবে গেছে দীঘিনালা মেরুং ইউনিয়নের হেডকোয়ার্টার এলাকা। সড়ক ডুবে যাওয়ায় রাঙামাটি লংগদুর সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া মেরুং ইউনিয়নের সোবাহানপুর, চিটাগাংইয়্যা পাড়া ও মেরুং বাজারের একাংশ ডুবে গেছে। দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত কুমার সাহা বলেন, ছোট মেরুং বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৭টা পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তাদের খাবার এবং পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সড়ক ডুবে যানবাহন চলাচল বিঘ্ন ঘটছে।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এবি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, জেলায় ১২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণস্থান ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত মাইকিং করা হচ্ছে।
দীঘিনালা ২য় শ্রেণীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের বেলুং মেকার সুভূতি চাকমা বলেন, খাগড়াছড়িতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড হয়েছে।
বান্দরবান : বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বৈরী আবহাওয়ায় ঝুঁকি এড়াতে লামা উপজেলায় প্রায় ৬০টি পর্যটন রিসোর্ট সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। গতকাল রোববার উপজেলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা প্রস্তুতি কমিটির জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে লামার ইউএনও মো. মঈন উদ্দিন বলেন, কয়েকদিনের টানা ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢালুতে অবস্থিত রিসোর্টগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রাণহানির সম্ভাবনা রোধে মিরিঞ্জা ভ্যালিসহ লামার বিভিন্ন পর্যটন স্পটের রিসোর্টগুলো পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে পুনরায় রিসোর্টগুলো খুলে দেওয়া হবে।
বান্দরবান আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সনাতন কুমার মণ্ডল জানান, গতকাল বিকেল তিনটা পর্যন্ত গত চব্বিশ ঘণ্টায় ৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে জেলায়। বিকেলের পর থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরও বেড়েছে। অব্যাহত বর্ষণে পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে।
বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অরূপ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ভারী বৃষ্টির ফলে সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাকখালী নদীর পানির স্তর বেড়েছে, তবে এখনো তা বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলার সাতটি উপজেলায় ২২০টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, স্বাস্থ্য বিভাগ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও এনজিওদের সমন্বয়ে ‘দুর্যোগকালীন জরুরি সেবা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করে সতর্ক করা হয়েছে।