সমকালের দর্পণ

গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের নেতাদের করতালিতে গাজার আহাজারি চাপা পড়ে গেছে

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১ জুন, ২০২৫ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৪ মে ২০২৫ থেকে চারদিন মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই সফরের তালিকায় ছিল সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় বারের মত র্ন্বিাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় সফরে প্রথম দেশ হিসাবে সৌদি আরব তথা ধনাঢ্য আরব দেশ গুলিকে বেছে নিয়েছেন।

সফরের প্রথম দিন সৌদি রাজধানী রিয়াদ পৌঁছে ডোনাল্ড ট্রাম্প রিয়াদ কে বিশ্বরাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন। প্রশংসায় ভাসিয়েছেন সৌদি রাজ পরিবার তথা ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান’কে।

এ স্ত্তুতির পিছনে যুক্তিও আছে অকাট্য। সৌদি আরব ইতিমধ্যে আমেরিকায় ৬০০ (ছয় শত) বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। এর বাইরে সৌদি আরব আমেরিকার কাছ থেকে ১৪২ (একশত বিয়াল্লিশ) বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনার চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। এ চুক্তি পৃথিবীতে এ যাবৎ সামরিক অস্ত্র ক্রয় চুক্তির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

এর বাইরে রিয়াদে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স’ এর উপস্থিতিতে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আসাদ পরবর্তী সিরীয় প্রেসিডেন্ট আহাম্মেদ আল শারার’ এর সাথে বৈঠক করেন। এ বৈঠকে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুত ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য সিরীয় প্রেসিডেন্টকে তাগাদা দেন। পাশাপাশি সিরীয়া থেকে বিদেশী যোদ্ধাদের বের করে দেওয়ার, আইসিস (ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া) যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে বিষয়েও উপদেশ দেন। এসবের বিনিময়ে দীর্ঘ দিন পর সিরীয়ার উপর থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকা আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার এই সফরকালীন সময়ে গাল্ফ কো অপারেশন কাউন্সিলের সদস্য রাষ্ট্রগুলির সভায়ও বক্তব্য রাখেন। এ কাউন্সিলে সৌদি আরব, ইউ এ ই, ওমান, কাতার, কুয়েত এবং বাহরাইন সদস্য। এই সভায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে উদ্দেশ্য করেই তার বেশির ভাগ বক্তব্য তুলে ধরেন। এমনকি তিনি উল্লেখ করেন তার প্রথম টার্মের প্রেসিডেন্টশীপ শেষে ইরানের কাছে অর্থই ছিল না হিজবুল্লাহ, হামাস আর হুতিদের অর্থায়নের জন্য। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ভুল নীতির জন্য ইরান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক হতে সক্ষম হয়েছে। এখন ইরানের সাথে পারমানবিক অস্ত্র অর্জনের পরিকল্পনা ত্যাগের বিনিময়ে চুক্তি করতে ট্রাম্প সম্মত তাও তিনি গাল্ফ কাউন্সিলের নেতাদের জানান।

প্যালেস্টাইন প্রসঙ্গে হামাস নেতাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তিনি গাজার মানুষদের উপর পরিচালিত গণহত্যার বিষয়টি বেমালুম চেপে যান। গাজার হাজারো মানুষের আহাজারি, নির্বিচার গণহত্যা, জীবন বাঁচানোর জন্য মৌলিক চাহিদা, খাদ্য, ঔষধ, পানি’র মত অত্যাবশ্যকীয় সরবরাহসমূহ পুরাপুরি বন্ধ করে দেওয়া, হাসপাতাল, স্কুল কলেজ, তাবুতে আশ্রিত মানুষের উপর অমানবিক বোমাবর্ষণ এসব কিছুই ট্রাম্পের ভাষণে বা আরব নেতাদের বক্তব্যে উঠে আসেনি। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার বক্তব্যে ‘আব্রাহাম এ্যাকর্ড’এর উপর জোর দিতে ভুলেননি।

পাঠকদের হয়ত অনেকের অনুসন্ধিৎসা জাগতে পারে ‘আব্রাহাম এ্যাকর্ড’ কী?

আব্রাহাম এ্যাকর্ড হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর নামে নামকরণ করা একটি শান্তি উদ্যোগ। এ উদ্যোগ আমেরিকানদের দ্বারা উৎসারিত এবং উৎসাহিত। ইহুদি, খ্রীস্টান এবং মুসলমানদের হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সূত্রে একই উৎস আর ঐত্যিহ্যের ধারক হিসাবে ধরে নিয়ে ইসরাইল এবং আরব রাষ্ট্রগুলির মাঝে পারস্পরিক স্বীকৃতি, সম্প্রীতি সৌহার্দ্য ইত্যাদি স্থাপনের লক্ষ্যে এ চুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগে সারা দিয়ে ইতিমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, মরক্কো, সুদান ইত্যাদি দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্ত্তু বিনিময়ে ইসরাইল এ পর্যন্ত প্যালেস্টাইনী জনগণের অধিকার স্বীকৃতিতে একপাও আগায় নি। বরং প্রতিদিন গণহত্যার মাধ্যমে ফিলিস্তিন তথা সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য ইসরাইল এক দুবির্ষহ প্রেক্ষাপট রচনা করে যাচ্ছে। যে উদ্যোগ আর উৎসাহ নিয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ব্রতী হয়েছেন তার শতভাগের এক ভাগও উৎসাহ বা উদ্যোগ তিনি ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে প্রদর্শনে ব্যর্থ এমনকি ফিলিস্তিনি নারী শিশুদের জীবন রক্ষার্থে, বরং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজাবাসীকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে অর্থাৎ বাস্ত্তুচ্যুত করে গাজা দখলের অভিলাষও ব্যক্ত করেছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রথম টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমেরিকান দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছিলেন, এটা ছিল ফিলিস্তিনিদের প্রতি চরম বৈরীতার শামিল। এই প্রেক্ষাপটে স্যামুয়েল হান্টিংটন এর বিখ্যাত বই ‘দি ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন এন্ড দি রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ বইএর দশম অধ্যায় ফ্রম ট্রানজিশন ওয়ারস টু ফ্‌্রল্ট লাইন ওয়ারস এ, গাল্ফ ওয়ার কীভাবে ইরাককুয়েত যুদ্ধ মুসলমানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল তার অপূর্ব একটি বর্ণনা এভাবে দিয়েছেনঃ

The Gulf War thus began as a war between Iraq and Kuwait, then become a war between Iraq and the West then one between Islam and the West. And eventually came to be viewed by many non-Westerns as a war of East versus West, a white man’s war, a new outbreak of old-fashioned imperialism”

উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয় ইরাককুয়েত যুদ্ধ হিসাবে, পরে এ যুদ্ধ রূপ নেয় পশিচমাদের বিরুদ্ধে ইরাকের যুদ্ধ হিসাবে তারও পরে ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের যুদ্ধ হিসাবে। পরবর্তীতে অনেক পশ্চিমার কাছে এ যুদ্ধ প্রতিভাত হয় প্রাচ্যের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের যুদ্ধ হিসাবে, কারো কারো কাছে সাদাদের নতুন রূপে সাম্‌্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধ হিসাবে।

বর্তমানে আমেরিকানদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি কৌশল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং পর্যালোচনা করলে বিশেষ করে তাদের ইরান নীতি, গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সকল কুকর্মে অমেরিকানদের অতিমাত্রায় ক্রমাগত সাহায্য সমর্থন, একই সাথে আব্রাহাম এ্যাকর্ড’কে সমর্থন দিতে আরব দেশগুলিকে আহবান আমেরিকানদের দ্বিচারিতা ছাড়া অন্যকিছু নয়। এবং আমেরিকান এই নীতি চলতে থাকলে তা মধ্যপ্রাচ্য তথা সারা বিশ্বের মুসলমানদের মনোজগতে স্যামুয়েল হান্টিংটন অংকিত উপসাগরীয় যুদ্ধ ক্রমপরিণতির দৃশ্যপটই আবার তুলে ধরবে নিশ্চিতভাবে।

১৫ মে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাতারের আমীরের সাথে কাতার এয়ার ওয়েজের জন্য ২৪৫ (দুইশত পঁয়তাল্লিশ) বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ২১০ টি বোয়িং বিক্রির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বোয়িং এর ইতিহাসে এটি সর্ববৃহৎ ক্রয় আদেশ। এই ক্রয় আদেশের ফলে আমেরিকান শ্রমবাজারে বছরে ১৫৪,০০০ (এক লক্ষ চুয়ান্ন হাজার) কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এছাড়াও নানা ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তির বিপরীতে কাতার এবং আমেরিকা ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের চুক্তিও স্বাক্ষর করে। চুক্তি স্বাক্ষরান্তে রাষ্ট্রীয় ভোজ সভায় দেওয়া কাতারের আমীরের দেওয়া বক্তব্য ছিল ব্যতিক্রম এবং উল্লেখযোগ্য। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, তারা কথার চেয়ে কাজ দেখতে চান।

আরব আমিরাত সফর ছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরের শেষ দেশ। এই সফরে আরব আমিরাত আমেরিকার সাথে ১. ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির মাঝে ২০০ বিলিয়ন ডলারের এ আই প্রযুক্তি সংক্রান্ত। বাকী অর্থের মাঝে আছে অস্ত্র ক্রয় যার মাঝে আছে এফ ১৬, এ্যাপাচে এবং চিনহুক হেলিকপ্টার, ৪৩০ বিলিয়ন বিনিয়োগ হবে আমেরিকান গ্রীন এনার্জি এবং জ্বালানী খাতে।

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট তার সফরে নিশ্চিতভাবে আরব উপদ্বীপের মানুষের বিশেষ করে গাজার অসহায় মানুষের জন্য ভালো কিছু নিয়ে গিয়েছেন তেমন একটি ধারণা ছিল বিশ্ববাসীর। অথচ তা হয়নি বরং দুঃখের বিষয় হল ট্রাম্প যখন মধ্যপ্রাচ্য সফরে গাজায় তখনও শত শত নিরীহ মানুষ ইসরাইলীদের অকারণ হত্যার শিকারে পরিণত। ট্রাম্প যখন বিলাসী রাষ্ট্রীয় ভোজে মত্ত তখন গাজার লক্ষ মানুষ অভুক্ত, খাদ্যাভাবে আহাজারিতে হাজার হাজার শিশু খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শূন্য পাত্র নিয়ে তাবুতে ফিরছে সে দৃশ্য এবং ঐ শিশুরাই যখন ইসরাইলী বোমা বর্ষণের শিকার হয়ে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে পড়ে থাকে তাদের কথা একবারও উঠে আসেনি বিলাসী ঐ আলোচনা সভায়।

এ যেন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালে জোয়ান বায়েস নিউর্য়কের মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে তার গানে যে আর্তনাদ করেছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি

When the sun sinks in the west

Die a million people of the Bangladesh

পশ্চিমে যখন সূর্য অস্ত যায়

বাংলাদেশে লক্ষ মানুষের তখন হন্তারক সময়।

আজ মধ্যপ্রাচ্যেও ঠিক ১৯৭১ সালে জোয়ান বায়েসের নিউর্য়কের মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে গাওয়া গানের যেন প্রতিধ্বনি শুনা যাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈর শাসকেরা যখন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা দিয়ে তুষ্ট করতে মত্ত তখন এই আমেরিকারই মদদে

গাজায় তখন লক্ষ মানুষ হন্তারক সময়ের মুখামুখি’।

পুনঃশ্চ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প’ এর মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষ হতেই ইসরাইলীরা অপারেশন ‘গিডিয়নস ওয়াগনস’ নাম দিয়ে প্রায় ৬০ (ষাট) হাজার রিজার্ভ সৈন্য তলব করে গাজার উপর ধ্বংস এবং হত্যাভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছে। তাদের এই অভিযানের লক্ষ্য “Seize & Control” অর্থাৎ দখলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ কর।

লেখক: কথা সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্যান্সারকে জয় করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধমিরপুরে ২ মাদক কারবারিকে পিটিয়ে হত্যা