বিল্লাল সাহেব টেবিলে বসে একদৃষ্টিতে চায়ের কাপের দিকে চেয়ে আছেন। আজকাল তার চোখে তেমন ভালো দেখেন না। সবই ঝাপসা, চোখের কোণের পানিতে আরো ঝাপসা দেখছেন সব। বিল্লাল সাহেব তরুণ জীবনে ফিরে গেলেন ভাবছেন নিজের বাবার কথা। বাবা ছিলেন প্রচণ্ড রাগী একজন। সারাক্ষণ বকতেন ছেলে–মেয়েদের। বাবার আড়ালে চার ভাই বোন মনে মনে বাবাকে বকতেন। প্রতিনিয়ত খুন করতেন তাদের বাবাকে। সব ভাইবোনেরা মিলে প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল তারা তাদের সন্তানদের কখনো বকবেন না। এমনই করে যাচ্ছেন বিল্লাল সাহেব। কিন্তু আজ তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন তার নিজের বাবা আহমদ খান সওদাগর কত ভালো এবং যথোপযুক্ত কাজটি করতেন।
বিল্লাল সাহেবের তিনজন ছেলে মেয়ে। ছেলে আবির সবার ছোট। দুই মেয়ের পর আল্লাহর কাছে রাত দিন কান্না করে ছেলেকে পেয়েছেন। সেই দিনটা কতই না আনন্দের ছিল তার জীবনের। বংশের প্রদীপ ঘরের আলো হয়ে জন্মেছিল সে। সামাজিক জীবনে সেটাই ভাবা হয় ছেলে না হলে এ জীবন বৃথা। অনেক আদর যত্নে বড়ো করা হলো আবিরকে। দুই বোনের কলিজার টুকরা। মাথায় তুলে বড়ো করা হলো তাকে। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী কখনো সন্তানদের বকা দিতেন না। মেয়েরা ঝামেলা করেনি কখনো। কিন্তু আবির সব সময় দুষ্টুমি, দুষ্টু বুদ্ধি এবং অভিযোগ সহকারে বাসায় ফিরতো। স্কুলে কতবার সতর্কীকরণ চিঠি আসতো। বিল্লাল সাহেব মিটিয়ে আসতেন সব। এবং প্রতিবারই বলে আসতেন আর হবে না। কড়া শাসন করা হবে। আজ ছেলে স্কুল পেরিয়ে কলেজে পড়ে। আবির মেয়ে বন্ধু সঙ্গ নিয়ে চলে। চেহারা মোটামুটি ভালো তাই মেয়েরাও তাকে মানিয়ে চলে। কিন্তু ইদানীং সে উগ্রতা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এবং আরো কী সব করে যাচ্ছে। বিল্লাল সাহেব প্রতিমাসে হাত খরচ দিতো। যা দিতেন তা এখন আর পোষাই না আবিরের। প্রতিদিন এসে সে বাবার সাথে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করে। টাকার নেশা তার ইদানীং চরমে। রাতে বাইরে থাকে সকালে ঘরে এসে ঝিমোই। বিল্লাল সাহেবের বুঝতে বাকি রইল না তার আদরের ছেলে, প্রার্থনাই পাওয়া ছেলে এখন অন্য জগতের বাসিন্দা।
গত রাতের ঘটনা –আবির ঘরে ফিরল আজ তাড়াতাডড়ি। ঘড়িতে এগারোটা বেজে দশ মিনিট। বিল্লাল সাহেব পরম যত্নে ছেলেকে কাছে ডাকলেন। বললেন, ভাত খেতে বসো। আমি দেখব আর তোর সাথে গল্প করব। কতদিন একসাথে গল্প করা হয় না। ছেলে এ কথাগুলো তেমন আমলেই নিল না। বরং ধমকের স্বরে কী সব যেন বলে গেল। বাবা হয়ে এসব কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলেন না।। তবুও নিজেকে সংযত করে ছেলেকে নৈতিক শিক্ষা দিতে গেলেন। আর এক পর্যায়ে আবির তার শ্রদ্ধেয় বাবাকে কিল ঘুষি দিয়ে দিলো। বিল্লাহ সাহেব চিৎকার করতে গিয়েও করলেন না। তিনি নিজ রুমে ফিরে এলেন। এবং সারারাত বিছানায় কাতরালেন। আমেনা বেগম এসবের কিছুই টের পেলেন না। নিশ্চিন্ত ঘুমাচ্ছেন। বিল্লাহ সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠোন আর বারান্দায় পায়চারি করেন। আবার বিছানায় যান। এ জীবন রাখবেন কি রাখবেন না তাও কয়েকবার ভেবেছেন। সকালে টেবিলে চায়ের কাপে চোখ তার ঝাপসা। আজকে তিনি উপলব্ধি করলেন আহমদ খান সওদাগর কতইনা কঠোর কঠিন শাসক বাবা ছিলেন। তার এমন বাবাই পারে তার সন্তানদের সঠিক দিশা দিতে। বিল্লাল সাহেব ব্যর্থ একজন বাবা। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিলেন। চোখের পানিতে ভেজা চা এক চুমুক খেলেন। এরপর নীরব নিথর ঘুমিয়ে গেলেন। একটি প্রতিজ্ঞা করলেন পরবর্তী জীবনে তিনি একজন আহমদ খান সদাগরের মত কঠিন হৃদয়ের শাসক বাবা হবেন। যদি সন্তান মানুষ করতে কঠোর বাবা বাস্তব জীবনে কোমল হৃদয়ের একজন যার হৃদয়ে মায়া ভরা। এবং লুকায়িত আবেগ। যা তিনি ছাড়া কেউ দেখবেন না। বিদায় বিল্লাল সাহেব।