সারা দিনের প্রচণ্ড গরমের পর গতকাল বিকেলে খানিকটা স্বস্তি মিলেছিল মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে। তখন গরমের তীব্রতা অনেকটাই কমে এসেছিল। এ সুন্দর আবহাওয়ায় সেন্ট প্ল্যাসিডস স্কুলের মাঠে গিয়ে দেখা গেল হাতেগোনা কয়েকজন ছেলে ফুটবল খেলছে। কিছু মহিলা মাঠের এক প্রান্তে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। অথচ তখন ছেলেদের পদচারণায় মাঠটি মুখর থাকার কথা। কিন্তু নেই। কারণ এ মাঠে কলেজ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। শুধু পরিকল্পনাই নয়, এরই মধ্যে মাঠের সয়েল টেস্টও হয়ে গেছে। ফলে এই মাঠে এখন খেলতে ভয় পায় ছেলেরা। কখন জানি দারোয়ান বের দেয় মাঠ থেকে। অথচ এই মাঠ থেকেই উঠে এসেছিল দেশ সেরা ফুটবলার আবু তাহের পুতু সহ অনেক নামজাদা ফুটবলার। ডেরিক রেন্ডলফের মত অ্যাথলেট। একটা সময় ফিরিঙ্গিবাজার ইয়ং স্টার ক্লাব, ইয়ং স্টার ব্লুজসহ পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গিবাজার এবং আশেপাশের অনেক ক্লাবের বিপুল সংখ্যক ফুটবলার এই মাঠে অনুশীলন করত। আয়োজিত হতো নানা টুর্নামেন্ট। সকাল কিংবা বিকেল ফুটবলার, ক্রিকেটার, অ্যাথলেটদের পদচারণায় মুখর থাকতো মাঠটি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মাঠটি এখন খেলার অনেকটাই অনুপযোগী। কয়েক বছর আগে মাঠের চারপাশে উচু প্রাচীর তুলে দেওয়া হয়। ফলে অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়ে মাঠে খেলাধুলা করা। এবারতো মাঠটিই শেষ হওয়ার দশা। যদি কলেজ ভবন নির্মাণ করা হয় তাহলে সেটি আর খেলার মত মাঠ থাকবে না বলে মনে করছেন এলাকার ক্রীড়ানুরাগী লোকজন।
সেন্টপ্ল্যাসিডস স্কুল এখন কলেজে পরিণত হয়েছে। ফলে তাদের এখন নতুন ভবন প্রয়োজন। আর সে নতুন ভবনের জন্য জায়গা হিসেবে বাছাই করা হয়েছে স্কুলের সামনের মাঠটি। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর এলাকার ছেলেরা মানববন্ধন করে মাঠটি রক্ষার দাবি জানান। গতকাল সরেজমিনে মাঠে গিয়ে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকজন ছেলে মাঠে খেলছে। তাদের আকুতি, এই মাঠ যেন খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত থাকে। মাঠটি যেন ভবন নির্মাণ করে নষ্ট করে ফেলা না হয়। মাঠের একপাশে বসে থাকা মহিলাদের কয়েকজন বললেন তারা তাদের ছেলেদের নিয়ে টেনশনে থাকেন। এই মাঠে পাঠিয়ে নিজেরাও পাশে বসে একটু সময় কাটাতে পারেন। কিন্তু মাঠে কলেজ ভবন নির্মাণ করা হলে সে সুযোগ আর থাকবে না। তাদের ছেলেরা আর খেলতে পারবে না।
এলাকার বাসিন্দা এবং সাবেক ক্রিকেটার ও সিজেকেএস এর সাবেক ক্রিকেট সম্পাদক নিখিল রঞ্জন দাশ। তিনি নিজেও খেলেছেন এ মাঠে। এখনো মাঠের পাশ দিয়ে যখন যান তখন দেখেন ছেলেরা খেলছে। মনের অজান্তে দাড়িয়ে তাদের খেলা দেখেন তিনি। আর নিজেকে সেই শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যান এই ক্রিকেট সংগঠক। যখন শুনলেন এই মাঠে নির্মাণ করা হবে কলেজের ভবন তখন তাঁর মন যেন ব্যথিত হয়ে উঠল। তিনি বলেন, মাঠে কেন ভবন নির্মাণ করতে হবে। অন্য কোনো পাশে কি জায়গা বের করা যায় না ? মাঠটাকে খেলার জন্য রেখে কলেজ ভবন নির্মাণের জন্য অন্য কোন উপায় বের করার অনুরোধ করেন প্রবীণ এই ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার।
এলাকার সাবেক বেশ কয়েকজন ফুটবলারের সাথে কথা হলে তারাও এই মাঠ নষ্ট না করার অনুরোধ জানান। বলেন, আমরা খেলেছি এই মাঠে। আমাদের সিনিয়ররা খেলেছেন। এখন আমাদের ছেলেরা খেলছে। প্রায় দুইশ বছরের পুরানো এই মাঠটি কেবল একটি মাঠই নয়, এটি একটি ইতিহাস। আবু তাহের পুতু, ফারুকুজ্জামান, আখতারুজজ্জামান, ইসমাইল বালি, শামিম আজাদ খোকন, সুদীপ, রণজিত, আকতার, স্বপন, পারভেজদের মত অনেক ক্রিকেটার উঠে এসেছে এই মাঠ থেকে।
গত শুক্রবার এলাকার বাসিন্দারা মাঠে ভবন নির্মাণের প্রতিবাদে এবং মাঠ রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন করে। তাদের বক্তব্য, এমনিতেই চট্টগ্রামে খেলার মাঠের তীব্র সংকট। এ অবস্থায় একটি ঐতিহ্যবাহী মাঠ হারিয়ে যাবে – এটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে।
গতকাল বিকেলে সেন্ট প্ল্যাসিডস স্কুলে গিয়ে এ বিষয়ে কথা বলতে প্রিন্সিপ্যাল স্যামুয়েল সবুজ বালার সাথে সাক্ষাত করার চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রামের সাবেক ফুটবলার, ক্রিকেটার, অ্যাথলেট এবং এলাকার বাসিন্দাদের আকুল আবেদন ঐতিহ্যবাহী এই মাঠটি নষ্ট না করে অন্য কোনোভাবে কলেজ ভবন নির্মাণ করা হোক। খেলার মাঠটা খেলার জন্য উম্মুক্ত রাখা হোক।