জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুনের শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার যে আলোচনা শুরু করবে, তার মধ্য দিয়েই জাতীয় সনদ তৈরি সম্ভব বলে আশা করছেন কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। গতকাল সোমবার সংসদ ভবনের এলডি হলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কমিশনের দায়িত্ব হলো রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা। আমরা আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার মধ্য দিয়ে জুলাই মাসের মধ্যেই একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোন কোন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলোর ব্যাপারে এক ধরনের ঐকমত্যে এসে একটা জুলাই সনদ তৈরি করতে পারে, তাহলে সে সময় এই এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার প্রশ্নটি আসবে। আমরা আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু সংস্কার প্রস্তাবের ব্যাপারে অকুণ্ঠ চিত্তে সমর্থন জানিয়েছেন, বারবার জানাচ্ছেন, তাদের যে কমিটমেন্ট সেটা প্রকাশ করছে। আমরা মনে করি যে একটা পথ তারা নির্ধারণ করতে পারবে।
সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষমতা ঐকমত্য কমিশনের নেই মন্তব্য করে আলী রীয়াজ বলেন, এটা অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবেন। তারা কীভাবে অগ্রসর হবেন এবং আমি যেটা আগে বলেছি রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ–আলোচনার মধ্য দিয়ে কীভাবে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া তৈরি হয়, সেটা হচ্ছে প্রশ্ন। মনে রাখা দরকার যে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটা আসলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করবে। খবর বিডিনিউজের।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, আইন নতুন করে সাজানোর এক ঐতিহাসিক সুযোগ আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আমাদের ভোটাধিকার ও টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের পক্ষে জুলাই অভ্যুত্থানের বীর সেনানীদের রক্তের ঋণ স্বীকার করা সম্ভব হবে।
সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, বিচারপতি এমদাদুল হক, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে সুরাহা হয়নি : সংবিধান সংস্কার কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশের বিষয়ে আরো আলোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখছেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, এ কমিশনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের বিষয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এর মধ্যে বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতবার নির্বাচিত হতে পারবেন, একজন সংসদ সদস্য কতগুলো পদে থাকতে পারবেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া কী হবে–এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অমীমাংসিত থেকে গেছে।
সংবিধান সংস্কারে যেসব বিষয়ে একমত হওয়া গেছে তা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ‘বহুত্ববাদ’ না রাখার ব্যাপারে অধিকাংশ দল মতামত দিয়েছে। অন্য চারটি মূলনীতির ব্যাপারে এক ধরনের ঐকমত্য আছে। তবে অনেক দল এই চারটির বাইরেও অন্যান্য বিষয় যুক্ত করার কথা বলেছে।
তিনি বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কিছু দল অবশ্য এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। নিম্নকক্ষে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণের প্রশ্নে এক ধরনের ঐকমত্য রয়েছে দলগুলোর মধ্যে। তবে এর পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। যারা সংসদের উভয় কক্ষের পক্ষে এবং যারা এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভার পক্ষে, উভয়ই আইন সভায় ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়ার পক্ষে বলে জানান তিনি।
আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধানের ৪৮-(ক) অনুচ্ছেদ যা কার্যত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নির্ধারণ করে, তা সংশোধনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে হবে, সেই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।
তিনি বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ, অর্থাৎ সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেবার ক্ষেত্রে যে বিধান তা পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্য হলেও কী কী বিষয়ে দলের পক্ষে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে তার একটি আংশিক তালিকার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। অর্থ বিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন বিলের ব্যাপারে দলীয় অনুশাসনের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে অধিকাংশ দল একমত। এর অতিরিক্ত আরো কিছু যুক্ত করার, যেমন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিল যুক্ত করার জন্যও কিছু দলের প্রস্তাব আছে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে তা তুলে ধরতে গিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে পৃথকীকরণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করার ব্যাপারে সব দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে।
তিনি বলেন, বিচারকদের চাকরির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করার জন্য সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধন করার সুপারিশের বিষয়ে একমত পোষণ করেছে সবগুলো দল। বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশকে অসদাচরণ হিসেব বিবেচনা করে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করার সুপারিশের বিষয়ে সব দল একমত পোষণ করেছে বলে জানিয়েছে ঐকমত্য কমিশন।
আলী রীয়াজ বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রদ করে আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কোনো কোনো দল প্রবীণতম তিন বিচারকের মধ্য একজনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক কমিশনের যেসব সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে তা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, দল নিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তির রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বিধান করার ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা শপথ ভঙ্গ করলে মেয়াদ শেষে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করবে প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটি। এরপর সেই কমিটি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ পাঠাবে রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে। এ বিধানের বিষয়ে বেশিরভাগ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার প্রশ্নে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে দলগুলো। এর আইনি দিক বিবেচনার জন্যে অধিকাংশ দল গুরুত্ব দিয়েছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যা ও নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত এবং ভোট জালিয়াতি ও দুর্নীতির সঙ্গে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন প্রশ্নে অধিকাংশ দল একমত পোষণ করেছে। তিনি বলেন, বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে পুনর্গঠন করে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করার ব্যাপারে বেশিরভাগ দল নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছে।
দুদক সংস্কারে সব দল একমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দ্বিমত নেই : দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের সবগুলো সুপারিশের পক্ষেই মোটা দাগে রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে একমত বলে জানিয়েছেন আলী রীয়াজ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়েও দলগুলোর মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। তবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্নে এখন ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।
সংস্কারের সুপারিশ–জনগণের মতামত নিতে জরিপ চালাবে : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কারের সুপারিশগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু বিষয়ে জনগণের মতামত নিতে জরিপ চালাতে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তবে কবে, কীভাবে জরিপ চালানো হবে, সে বিষয়ে কিছু জানাননি তিনি।
গণ আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের অক্টোবরে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশনগুলো ২০২৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে তাদের সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করে। পরে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানদের নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে সরকার। বিভিন্ন সংস্কার সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছানো ও ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা এ ঐকমত্য কমিশনের লক্ষ্য।