আত্মপরিচয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়

নাসের রহমান | সোমবার , ২৬ মে, ২০২৫ at ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ

এদেশে বিভিন্ন ধর্ম ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। বহুকাল থেকে পারস্পারিক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থেকে বংশ পরম্পরাই বাস করে আসছে। মাঝে মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত হয় না যে তা নয়, এমনকি সহিংসতায়ও জড়িয়ে পড়েছে। হিংসা হানাহানি থেকে খুনাখুনিও হয়েছে। পরে আবার মীমাংসা হয়েছে। সম্প্রীতির জায়গায় ফিরে এসেছে। কোন কোন সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সহঅবস্থান আরো সুদৃঢ় হয়েছে। সকল সম্প্রদায়ের বসবাস নির্বিঘ্ন হয়েছে। বিশেষ করে হিন্দু মুসলিম যে বিরোধ তা আর সহজে মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। ধর্মীয় বিভাজন থাকলেও সমঝোতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সহঅবস্থান নিশ্চিত হয়েছে। সংখ্যালঘুরা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান যথাযথভাবে পালন করেছে। যে কোন ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের পাশাপাশি এদেশের প্রতিটি মানুষের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখারও দায়িত্ব সবার ওপর বর্তায়।

হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান মানুষের ধর্মীয় পরিচয় হলেও সব দেশের মানুষের একটা জাতীয় পরিচয় থাকে। ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে জাতীয় পরিচয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। এ পরিচয়টা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। জাতিসত্তার বিকাশ ঘটায়। পারস্পরিক সহ অবস্থানের পথ দেখায়। সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে সহায়তা করে। নানা রকম মতভেদ থাকলেও জাতীয় ইস্যুগুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছার বাধাগুলোকে সরিয়ে দিতে পারে। সর্বোপরি জাতিকে এগিয়ে চলার প্রেরণা দেয়ার সাহস যোগায়। বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি নীতির মধ্যে থেকেও জাতিসত্তার উৎকর্ষতা অর্জনে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখা যায়। এতে করে ধর্ম বর্ণ দল মত নির্বিশেষে জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্যসমূহ সর্বদা সমুজ্জ্বুল থাকে। কখনো ম্লান হতে পারে না। কখনো বিলীন হতে পারে না। মানুষই এসবের ধারক হিসেবে বয়ে নিয়ে চলে। কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে মুছে দিতে পারে না।

এদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় বাঙালি। অনেকে বাংলাদেশী বলে থাকলেও মূল পরিচয় বাঙালি। অনেক দেশে কয়েকটি জাতি পাশাপাশি বসবাস করে। ছোট বড় মাঝারি নানা জাতি মিলেমিশে বসবাস করে। সব দেশে প্রত্যেক জাতির সমান অধিকার থাকার কথা। সংখ্যায় কম বেশি হলেও প্রত্যেকে সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে। যদিও বা কোন কোন দেশে ভিন্ন চিত্রও দেখা যায়। এক জাতি গোষ্ঠীর ওপর আরেক জাতি গোষ্ঠীর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এরকম অনেক দেশে হয়ে থাকে। তারপরও তারা ঐক্যবদ্ধ থাকে। জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে চলে। সবাই জাতীয়বাদী চেতনাগুলোকে সমোন্নত রাখার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকে। এসব ক্ষেত্রে কোন রকম ছাড় দেয় না, কোন সময়ে আপোষ করে না। জাতি যেন কোন রকম বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে।

অন্যান্য দেশের মতো এদেশেও বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বসাবাস করে। কেউ কেউ তাদেরকে আদিবাসি বা উপজাতি বলে থাকে। যে যা বলুক তারাও এদেশের মানুষ। তাদেরও রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বহুকাল ধরে যা তারা ধারণ করে আসছে। তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা শুধু দেশের মানুষের কাছে নয় বিশ্ববাসীর কাছেও নন্দিত। তাদের মধ্যেও বৃহৎ জনগোষ্ঠী চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ছাড়াও আরো অনেক ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী রয়েছে। যারা স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এক্ষেত্রে যারা যে জাতি গোষ্ঠীর হোক না কেন সবাই বাংলাদেশের নাগরিক অর্থাৎ বাংলাদেশী। এ পরিচয়টি বাংলাদেশের সকল নাগরিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ বাঙালিরা বাংলাদেশী। বাংলাদেশী বলতে বাংলাদেশের সকল নাগরিককে বুঝানো হয়ে থাকে।

বাঙালিদের হাজার বছরের বাঙালি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এ জনপদে বাঙালির অস্তিত্ব আরো অনেক আগে থেকে। মূলত বাঙাাল বা বাংলা নামক জনপদটি গড়ে ওঠে বাঙালিদের নিয়ে। তবে বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ লাভ করতে সময় লাগে। বাঙালি যে একটি জাতি তার পরিচয় গড়ে উঠতে বহু কাল অপেক্ষা করতে হয়। কোন ধরনের ঘাত প্রতিঘাত সংঘাতের মধ্য দিয়ে নিজস্ব স্বকীয়তার পথ খুঁজে পায়। সব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে সে পথে বাঙালি এগিয়ে চলতে শুরু করে। চলার বয়সও হাজার বছরের চেয়ে বেশি। বাঙালি নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তোলে। বাংলা ভাষা এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিল্প সাহিত্য সর্বত্র বাঙালির নিজস্ব বলয় গড়ে ওঠে। বাংলা ভাষার মধ্য দিয়ে বাঙালির সকল আবেগ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আদিযুগ মধ্যযুগ যেভাবে ভাগ করা হয় না কেন বাংলা ভাষা বাঙালিদের চিন্তা চেতনার ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। বাঙালি ও বাংলা ভাষা যেন একে অপরের পরিপূরক হয়ে আবহমান কাল থেকে বাঙালিকে জাতি হিসাবে বিনির্মাণ করেছে।

বাংলা ভাষা বাঙালি জাতির অমূল্য সম্পদ। এর চেয়ে বড় সম্পদ বাঙালির আর নেই। পৃথিবীর অনেক জাতিরই নিজস্ব ভাষা থাকে। সেভাবে বাঙালি জাতিরও নিজস্ব ভাষা বাংলা। এ বাংলা ভাষাকে মর্যাদাশীল গড়ে তুলতে বাঙালি জাতিকে অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হয়েছে। নিম্নবর্ণের মানুষের বা অতি সাধারণে ভাষা বলে বাংলা ভাষাবাসীকে অনেক তুচ্ছ তাচ্ছিলের শিকার হতে হয়েছে। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ বিশেষ করে যারা নিজেদেরকে অভিজাত শ্রেণি বলে দাবী করতো তারা কোনভাবে বাংলাকে ভাষা হিসেবে মেনে নেয়নি। বাংলাকে কখনো উচ্চ শ্রেণির ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেনি। কিন্তু সাধারণ মানুষের একমাত্র ভাষা ছিল বাংলা। মায়ের মুখ থেকে শেখা এ বাংলা ভাষাই তাদের মাতৃভাষা। যুগে যুগে প্রবল বাধা বিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে বাংলা ভাষাকে একমাত্র নিজের ভাষা হিসেবে ধারণ করে। এ ভাষাকে রক্ষা করার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেন নি। আর কোন জাতিকে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়নি। বাঙালি জাতি প্রাণের বিনিময়ে নিজের মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছে।

এ আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে শুধু বাংলা ভাষা রক্ষা পায়নি, বাঙালি আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজে পেয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে পেরেছে। এ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি তার আত্মপরিচয় সুদৃঢ় করেছে। নিজেদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয়ে বলিয়ান হয়েছে। নিজস্ব ভূখণ্ডে নিজেদের শাসন ব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন দেখেছে। যে স্বপ্ন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে। বাঙালির শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে নিজেদের একটা দেশ গড়ে তোলার দৃপ্ত অঙ্গীকারে এগিয়ে গিয়েছে। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার থেকেছে। অত্যাচার নিপীড়নের সকল বাধাকে সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে, কখনো পিছ পা হয়নি। জেল জুলুম নির্যাতন কোন কিছু আর আটকে রাখতে পারেনি। এমনকি মৃত্যুও আর থামিয়ে রাখতে পারেনি। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলা ভাষার গৌরবও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এদিন বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন করা হয়। এটি বাংলা ভাষাভাষির জন্য অনেক সম্মানের, অনেক গৌরবের, বিশ্বে যা বিরল দৃষ্টান্ত। মাতৃভাষার জন্য প্রাণবিসর্জন এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন বিশ্বের অন্য কোন জাতির ভাগ্যে আসেনি। এই দুই মহতি অর্জন বাঙালি জাতিকে অনেক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। এজন্য এদেশের মানুষের মূল পরিচয় বাঙালি। আর যতো পরিচয় থাকুক না কেন এদেশের মানুষের আসল পরিচয় বাঙালি। অন্য কোন পরিচয়ে বাঙালির পরিপূর্ণ পরিচয় প্রকাশ যায় না। ধর্ম বর্ণ গোত্র সম্প্রদায় গোষ্ঠীভেদে এদেশের মানুষের নানা পরিচয় থাকতে পারে। অনেকে বাংলাদেশী বলে থাকে। তবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে এদেশের মানুষকে বাঙালি পরিচয়ে দাঁড়াতে হবে। অন্য কোন পরিচয়ে বাঙালি এতো উচ্চতায় পৌঁছতে পারবে না।

লেখক: কথাসহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের পাঠ্যসূচি ও অবহেলিত বিজ্ঞানের ইতিহাস
পরবর্তী নিবন্ধজুয়া খেলার সরঞ্জাম ও নগদ টাকাসহ আটক ১৭