প্রেমের কবি নজরুল

মৃণালিনী চক্রবর্ত্তী | সোমবার , ২৬ মে, ২০২৫ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

যে কবি তাঁর শাণিত লেখনী দিয়ে পরিচয় দিয়েছে নিজেকে। বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে দিয়েছে আত্মমর্যাদার আসন। জাগরণ তুলেছে অন্যায়ে প্রতিবাদ ও মুক্তির জয়গান। সাম্যের শক্তি ও সম্প্রীতি মূল্যবান। দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধ্বজা বড় সম্মান।

তিনি গানে কবিতায় গল্পে প্রবন্ধে নাটকে উপন্যাসে লিখে গেছেন

বারবার

মানুষে মানুষে ভালোবাসার ছন্দ,

মুছে ফেলে যত দ্বন্দ্ব,

দূর করে যত মন্দ,

করি বন্দনা মিলন আনন্দ।

তিনি নিঃস্বার্থ প্রকৃতির প্রেমকে মানুষের ভাবাদর্শে অনুরণিত করে ভক্তিময় শ্রদ্ধাময় নন্দনকাননের অনুসর্গ রচিত করতে চেয়েছেন। বিভেদ বিচ্ছেদের ভয় তাকে বরাবরই কাঙালি করে তোলে। সে চায় সব দুয়ার থাক স্বচ্ছ সরলতায় খোলা। দুয়ারে দুয়ারে প্রেমের গান, গজল, কীর্তন, হামদ্‌ নাদ, গেয়ে শুনে সবাই উদ্ভাসিত হোক। সবাই এক এই বন্দনা উচ্চারিত হোক। বাংলা গজলের সম্রাট তিনি। সেই এক অন্য আঙ্গিকের সুর রসধারার সৃজক যা হৃদয়কে মন্দ্রিত করে, নন্দিত করে, কৃতার্থ করে। মানুষকে রসবোধে মগ্নিত করে। তিনি সুরগাহনে ছয়টি রাগের রূপও তৈরি করেছেন। তার এই তুঙ্গ প্রতিভায় নানা ধারার রচনার মধ্যে প্রেম,প্রতিবাদী গান ও গজল শ্রেষ্ঠ। প্রেমের ও নানা ধারা আছে। ঈশ্বর প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, মানুষ প্রেম, দেশপ্রেম সকল ধারায় তিনি সফল ও কৃতিত্বের দাবিদার। এই মানুষটি দরিদ্র চিত্তে সৃষ্টিকে করেছে বিত্ত। অভাব তাকে ঘিরে থাকলেও সেই জাল সে সৃষ্টিতত্ব দিয়ে ছিন্ন করে বিশ্বসভায় পেতেছে মূল্যবান গ্রহণীয় বরণীয় হৃদ্যতাপূর্ণ প্রেমের আসন। সবাই তাকে ডাকে, কণ্ঠে কবিতা শুনতে চায়, গান শুনতে চায় বিভিন্ন আসর বসে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও অনুষ্ঠানে তিনি মুখ্য হয়ে উঠেন। সৃজনের কৃতিত্বের কাছে তিনি সম্রাট। এই বঙ্গ ভাণ্ডারে খুঁজে পেয়েছেন তিনি অনেক অমূল্য রত্ন। তার আবির্ভাব ও তার আগুন ঝরা লেখা এক অভূতপূর্ব চমক লাগালো বাঙালি পাঠক সমাজের মনে। তাই অখণ্ড বাংলায় তার বিচরণ বিস্তারণ ছিল অকুতোভয় বীরের মতো। বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবির কাটে বাল্যকাল। কুমিল্লায় কাটে অনেকটা সময় তার যৌবন কাল পরে বিবাহ। আর ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কবি পূর্ব বঙ্গের সফরে বের হন। চট্টগ্রাম নোয়াখালী সিলেট প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করেন। ১৯২৬ সালের ও ১৯২৯ সালের গোড়ার দিকে পরপর দুবার চট্টগ্রাম আসেন আর বাংলার কাব্য ভাণ্ডারে সঞ্চিত হয় সমৃদ্ধ হয় কতগুলো শ্রেষ্ঠ কবিতার ‘সিন্ধু হিন্দোলা’ ও ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থে। চট্টগ্রামের বন পাহাড় সাগর নদী কবিকে অনেক আকর্ষিত করেছে। তিনি চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল, সমুদ্র পাহাড় নদী গিরি বন দেখে উতরোল হয়ে উঠতেন কলমের কালি পাতায় অঝোরে রূপায়ন করে চলতো। কবির প্রিয় জায়গা রাউজান, কাট্টলি, সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গা পার্বত্য অঞ্চল। ১৯২৬ সনে কবি চট্টগ্রামে এসে মুহম্মদ হাবীবুল্লাহ বাহারের বাড়িতে মাসখানেক অবস্থান করেন। নানা মানুষের শিল্পী সাহিত্যিক কবিদের আনাগোনা ছিল কবিকে ঘিরে। বাড়িতে সুপারি গাছের সারি দেখে বিখ্যাত কবিতা রচনা করলেন ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’। যে কয়দিন ছিলেন তার লেখাও প্রাণ পেলো তত। এক এক করে তিন তরঙ্গ, সিন্ধু, অনামিকা, গোপন প্রিয়া, কর্ণফুলী, মিলন মোহনায়, নবীন চন্দ্র, বাংলার আজীজ, শিশু যাদুকর, সাত ভাই চম্পা, আর ও কতো কবিতা। আজ চট্টগ্রামের সৌন্দর্য, প্রকৃতি, নদী, সমুদ্র, পাহাড় আমাদের বিদ্রোহী কবি জাতীয় কবির লেখা কবিতায় সাহিত্যে অমর অক্ষয় হয়ে আছে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই চট্টগ্রামে এসে সাহিত্য সংস্কৃতিতে চট্টগ্রাম প্রতীক হয়ে ঐতিহাসিক সূচনার গর্বিত পথ উম্মোচন করলেন। আমার চট্টগ্রাম বীর চট্টগ্রাম।

বৃটিশ আন্দোলনের ভীত কাঁপিয়েছে তার শক্তিধর গান ও কবিতা। তার গগনভেদী উচ্চারণ ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর এক হাতে রণতূর্য’ তার বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতার লাগি বিদ্রোহী কবি তিনি। এই বাংলার ভাষা আন্দোলন সহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে তার গান ও কবিতা বলিষ্ঠ সমুচ্চারিত ভূমিকা পালন করেছে। ভবিষ্যতে করবে।

বৃটিশ আমলে শাসনের সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তিনি বাঙালির বাঙলা প্রবন্ধে লিখেছেন,

বাঙলা বাঙালির হোক, বাঙলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক’।

বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সকল ক্ষেত্রে তার অসামান্য দৃষ্টি গোচরীভূত নির্মাতায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ভাষাসাহিত্য ও সংস্কৃতি একটি দেশের পরিচয়, একটি দেশের গৌরব, একটি দেশের সভ্যতার মানচিত্র। এভাষা ও সাহিত্যের বুননের মধ্যে আছে দেশপ্রেম মানব প্রেমের ইতিহাস ঐতিহ্য। বাঙালির হাজার বছরের ভাষা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্বসভায় স্থানের আসনে গৌরবময় উজ্জীবন করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্যার জোরে নয়, কোনো পৃষ্ঠপোষকতায় নয়, পারিবারিক সহানুভূতি নয়, যার অন্তরে অগ্নি জ্বলছে হিংসা বিদ্বেষের বিরুদ্ধে, মানবাধিকার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে। তিনি বিনীত ইচ্ছার আহ্‌বানে জগতে, শুদ্ধ ভালোবাসার জাগরণ হোক, শান্তির মৃদুমন্দ ঘণ্টা বাজুক দ্বারে দ্বারে। এক চন্দ্র সূর্য আকাশের ছায়াতলে সবাই শুদ্ধ আনন্দের প্রস্রবণে এক পাটাতনেই মিলন মেলা ঘটুক। এই অনন্য ব্যক্তিত্বে নজরুল শিক্ষিত বাঙালির চিন্তা জগতে মানসজগতে স্থায়ী প্রভাব ফেলে বরণীয় হয়ে উঠেছেন। বাঙালির জীবনে উৎসবের নানা ধারায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আগেই অভিষেকের সিংহাসন জুড়ে নন্দিত। কী লিখেন নাই তিনি। ছড়া কবিতা গল্প নাটক উপন্যাস প্রবন্ধ। গানের নানা ধারা গজল, প্রেমের, ঋতু, হামদ নাদ, ইসলামিক গান, ভক্তি গীতি, শ্যামা সঙ্গীত, কীর্তন, হাসির গান, রাগ প্রধান, লেটো গান, ছাদপেটা গান, ছড়া গান, দেশাত্মবোধক, প্রতিবাদী, প্রেরণামূলক ইত্যাদি বাঙালির কৃষ্টির গোচরীভূত যত বিষয় সবদিকে তিনি সিদ্ধহস্ত। শুধু তাই নয় তিনি একাধারে গীতিকার সুরকার শিল্পী নায়ক চলচ্চিত্রকার সাংবাদিক। তার লেখা প্রচলিত ধারা থেকে কিছুটা আলাদা কখনও কখনও। কোথাও বিশেষ করে গানে গজলে সংস্কৃত আরবি ফার্সি শব্দের সংমিশ্রণ ও ঘটেছে।

তিনি বাংলা সাহিত্যে একজন কালজয়ী কবি বিদ্রোহী কবি আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। তার সৃষ্টি কর্ম বাংলা সাহিত্যে শুধু নয় বিশ্বসাহিত্যেও অমূল্য সম্পদ। তিনি অসাম্যের বিরুদ্ধে সাম্যের কবি। সেই ধর্ম নারী সমাজ যেখানেই শোষণ বাড়াবাড়ি দেখেছেন। তার লেখনী সেখানে রণতূর্য। তিনি অবিনাশী প্রেমিক কবি। যা দেখেছেন সেখানেই সুন্দরের মাধুরী মিশিয়ে বিবেকের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। বিদ্রোহী কবিতা তার জীবনেব প্রধান রচনা সেই সময়ে বাঙালি মুসলমানের জীবনে রেনেসাঁসের বাতাবরণ তৈরি হয়। প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরীর বর্ণনায় শীতের দেশে বসন্তের মত নজরুলের প্রবেশ। তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে রেনেসাঁসের আবির্ভাব হলো বুদ্ধি অনুভূতি ও কল্পনার দ্বার খুলে গিয়ে মানব মহিমা উপলব্ধি হলো। তার ‘বিদ্রোহী’ মানব মহিমারই কাব্য।

নজরুল ১৯৩২ খৃষ্টাব্দে গ্রীষ্মকালে চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে এক সাহিত্য সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হয়ে আসেন। কবিকে শেষ বারের মত চট্টগ্রামে আনা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তখন কবি বাকরুদ্ধ স্মৃতি শক্তিহীন।

কবি এয়াকুব আলী দোভাষীর আমন্ত্রণে একবার তার বাসভবনে দাওয়াত গ্রহণ করেন। ভোজন পূর্বে গানের আসর বসছিল কবি গান শুনিয়ে আনন্দ দান করেছিলেন। ফিরিঙ্গী বাজার তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাওয়া সড়কটি বেয়ে কবি সঙ্গীসাথী সমেত কর্ণফুলী নদীতে বিহার করতে যেতেন। সেই সড়কটির তখন থেকেই নাম হয় কবি নজরুল সড়ক আজো বিদ্যমান। তার কাছাকাছি আমি থাকি আমি গর্বিত হই। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৪ শে মে বঙ্গবন্ধু কবি নজরুলকে বাংলাদেশে সম্মানের সাথে নিয়ে আসেন এবং নাগরিকত্ব প্রদান করেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবির সম্মানে মর্যাদায় ভূষিত হন এবং ঢাকার মাটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে চিরশায়িত হয়। তার ভাবনা বোধ অনুভূতি সৃষ্টি সংস্কার অনন্ত প্রেমের ঐশ্বর্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপলিথিনের বিকল্প ব্যবহার করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের পাঠ্যসূচি ও অবহেলিত বিজ্ঞানের ইতিহাস