দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার, সংস্কার এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশসহ বিষয়গুলোতে জনগণের যে মতামত রয়েছে বা জনগণের যে প্রত্যাশা রয়েছে, জনআকাঙ্ক্ষার বিষয়টি জানার জন্যই কর্মসূচি শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ।
তিনি বলেন, আমরা চট্টগ্রাম দক্ষিণ থেকে শুরু করেছি, সারা বাংলাদেশে এনসিপির পক্ষ থেকে এই মানুষের কাছে যাওয়া অব্যাহত থাকবে। বিচার, সংস্কার এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে আমার দল কী ভাবছে, সেটা মানুষকে জানানো এবং মানুষের চিন্তাগুলো আমরা জানা, কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা সেটা প্রকাশ করছি। গতকাল রোববার সকালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় সাংগঠনিক সফর কর্মসূচি শুরুর আগে নগরের বিপ্লব উদ্যানের জমায়েতে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমরা স্পষ্টভাবেই জানিয়েছি–যে দুজন উপদেষ্টার পদত্যাগের কথা বলা হচ্ছে, তারা গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে এ সরকারে প্রতিনিধিত্ব করছেন। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি বা এনসিপির প্রতিনিধি হিসেবে এ সরকারে নেই। তারা গণঅভ্যুত্থানের সবার প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাদের একটা দলীয় পরিচয়ে পরিচিত করানোর মধ্য দিয়ে তাদের যে ট্যাগ দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে, এ বিষয়টিকে আমরা নিন্দা জানিয়েছি। একইসাথে আমরা বলেছি, যে দুজন ছাত্র উপদেষ্টা আছেন, তারা গণঅভ্যূত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন, এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের যেন সম্মানহানি করা না হয়। প্রতিনিয়ত তাদের যেভাবে এননিপির সাথে অ্যালাইন করা হচ্ছে, আমরা সে বিষয়ের নিন্দা জানিয়েছি।
জুলাই গণঅভ্যূত্থানের সকল পক্ষের শক্তির মধ্যে বিভেদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিভেদ মানে রাজনৈতিক দলের মধ্যে পলিসির জায়গা থেকে মতপার্থক্য থাকবেই। সংকটকালীন সময় যখন আসে, এই বিভেদটাই কাটিয়ে উঠে আমরা আবার ঐক্যবদ্ধ হই, এটাই আমাদের জাতীয় চরিত্র। তো সেই জায়গা থেকে বিভেদ–মতপার্থক্য যেমন চলমান রয়েছে, আবার জাতীয় সংকট উত্তরণের সামগ্রিক প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। যখনই সংকট এসেছে, যখনই দেশি–বিদেশি কিংবা অভ্যন্তরীণ দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র হয়েছে, আমরা সামগ্রিকভাবে গণঅভ্যূত্থানে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দল এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, যাদের দীর্ঘদিনের লড়াই–সংগ্রাম রয়েছে, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবেই দেশবিরোধী এবং বাইরের যে ষড়যন্ত্র রয়েছে, সেগুলো আমরা প্রতিহত করছি।
গত শনিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, শনিবার আমরা আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি যে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার, সংস্কার এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করা।
সাংগঠনিক সফরে হাসনাত আবদুল্লাহর সাথে আছেন, এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা, যুগ্ম সদস্য সচিব মীর আরশাদুল হক, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ডা. মাহমুদা আলম মিতু ও মো. আতাউল্লাহ এবং সংগঠক আরমান হোসেন।
চট্টগ্রামে এনসিপির মিডিয়া উইংয়ের মুখপাত্র আরাফাত আহমেদ রনি জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জ্যারটেক, সকাল সাড়ে ১১টায় আনোয়ারার চাতুরী চৌমুহনী, দুপুর দুইটার দিকে বাঁশখালী উপজেলা চত্বর, সাড়ে তিনটার সাতকানিয়ার কেরানীহাট, সন্ধ্যা ছয়টার দিকে লোহাগড়া উপজেলার আমিরাবাদ, এরপর ক্রমান্বয়ে চন্দনাইশের দোহাজারী পৌরসভা, চন্দনাইশ পৌরসভা, পটিয়া উপজেলা কলেজ গেইট মোড়, বোয়ালখালী উপজেলার গোমদণ্ডি ফুলতলে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি জানান, আজ সোমবার দিনব্যাপী উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় পথসভা করবে হাসনাত আবদুল্লাহ। এর পরদিন চট্টগ্রাম নগরে প্রোগ্রাম করবে এনসিপি।
যে বিভাজন দেখা দিচ্ছে তা দূর করতে হবে : পটিয়া প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকাল ১০টায় কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জারটেকে ও রাত সাড়ে ৮টায় পটিয়ার থানার মোড় চত্বরে আয়োজিত পৃথক পথসভায় বক্তব্য রাখেন হাসনাত। তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিস্টদের বিতাড়িত করেছি, এখন আমাদের মধ্যে বিভাজন দেখা দিচ্ছে তা দূর করতে হবে। ফ্যাসিবাদী চক্র আমাদের ঐক্য বিনষ্টে চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, অতীতের যে বৈষম্য ছিলো সেটার ঊর্ধ্বে উঠে আমরা একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। আমরা চাই পরিবর্তিত বাংলাদেশ হবে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির বাংলাদেশ।
আর কেউ দিনের ভোট রাতে নিতে পারবে না : আনোয়ারা প্রতিনিধি জানান, গতকাল দুপুর ১২টায় আনোয়ারা চাতরী চৌমুহনী বাজারে এনসিপির পথসভায় হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, এ দেশে আর কেউ ইউএনও–পুলিশকে ব্যবহার করে দিনের ভোট রাতে নিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে না। এই বাংলাদেশে আর একসাথে দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হবে না। আগামীর বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে যারা চর্চা করে তাদের ওপর নির্যাতন করা হবে না, আগামীর বাংলাদেশ হবে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির বাংলাদেশ।
সংবিধান নামে আওয়ামী বিধান পরিবর্তন করতে হবে : লোহাগাড়া প্রতিনিধি জানান, গতকাল বিকেলে লোহাগাড়া উপজেলা সদর বটতলী স্টেশনে এক পথসভায় হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, জুলাই আন্দোলনে যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন তাদের প্রতি কমিটমেন্ট ছিল সংবিধান নামে যে আওয়ামী বিধান রয়েছে সেটি পরিবর্তন করতে হবে। এই আওয়ামী বিধানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী হয়েছে। আমাদের নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। খুন, গুম ও নিপিড়নের রাজনীতি করা হয়েছে। বিরোধী দলকে মত প্রকাশ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। ভোটের অধিকার হরণ করা হয়েছে। রাতের ভোট ও ঢামি নির্বাচনের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে। সবকিছু থেকে উত্তোরণের জন্য এই সংবিধান পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, শিগগিরই জুলাই ঘোষণাপত্র, আওয়ামী লীগ আমলের সব নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা, সরকারকে বিচার কার্যক্রম, সংস্কার কার্যক্রম ও নির্বাচনী রোডম্যাপ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এনসিপি নির্বাচনের বিপক্ষে নয়। কিন্তু জুলাই–আগস্টে যারা গুম, খুন ও নির্যাতন করেছে তাদের (আওয়ামী লীগের) বিচার আগে হতে হবে। তারপর নির্বাচন দিতে হবে।
নেতা নয়, নীতি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থা গঠন করুন : চন্দনাইশ প্রতিনিধি জানান, গতকাল সন্ধ্যায় চন্দনাইশের দোহাজারী পৌরসদরে আয়োজিত পথসভায় হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, এনসিপির বার্তা হল–নেতা নির্ভর নয়, নীতি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থা গঠন করুন। যেখানে নেতা আসবে নেতা যাবে, কিন্তু নীতি সবসময় ঠিক থাকবে।
শেখ হাসিনা আর আসবে না : এদিকে বাসস জানায়, গতকাল দুপুরে বাঁশখালী উপজেলা পরিষদ চত্বরে এনসিপির পথসভায় হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, শেখ হাসিনা আর কখনো দেশে ফিরে আসবে না। আপনারা সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা করবেন না। আপনারা নিজেরা নিজেরা মিলে নিজেদের বিকল্পহীন মনে করবেন না। হাসিনা নিজেকে নিজে বিকল্পহীন মনে করতো। আমরা জনগণ বিকল্প খুঁজে নিয়েছি। সচিবালয়ে বসে এখনও যারা সরকারকে অসহযোগিতা করছেন, আপনাদের বিকল্প আমরা জনগণ ঠিক করে নিবো। দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা অনেক উচ্চশিক্ষিত যুবক রয়েছে। প্রয়োজনে তারা আপনাদের স্থলাভিষিক্ত হবে।
তিনি আরও বলেন, আপনারা যদি মনে করেন, হাসিনার রাজত্ব আবার কায়েম হবে, তাহলে আপনারা ভুল পথে রয়েছেন। আপনারা ষড়যন্ত্র না করে দেশের স্বার্থে বিচার, সংস্কার ও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যান।
ডা. তাসনিম জারা বলেন, বাঁশখালীর অনেক কৃতি সন্তান এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তারা আপনাদের পাশে থাকবে। আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ অনেক বাকী।