দ্রোহের কবি নজরুল ও নারী মুক্তির গান

ফারিহা জেসমিন ইসলাম | রবিবার , ২৫ মে, ২০২৫ at ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ

অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরে বিদ্রোহী নাম কুড়িয়েছেন যিনি তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের এই বিরল প্রতিভা তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্মে প্রচলিত ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে শুধু বিদ্রোহের ডাক দেননি পাশাপাশি তিনি গেয়েছেন সাম্য, মানবতা ও নারী মুক্তির গান। কবির সাহিত্য এবং সৃষ্টিকর্মে নারীর উপস্থিতি অত্যন্ত বর্ণিল এবং শক্তিশালী। ঠিক যে সময়টাতে নারীকে আমাদের সমাজ ভোগের বস্তু, বঞ্চনার সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করত, নারীকে মানুষের মর্যাদাটুকু দেয়া হত না সেই সময়েই বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের কলম তরবারির মত শক্তিশালী হয়ে উঠে নারীদের অধিকারের পক্ষে।

তাঁর মহান কবিসত্তা নারীকে এক মহামূল্যবান অস্তিত্ব রূপে স্বীকার করেছেন বারংবার। তিনি এমন সময়ে নারীর মুক্তির স্বর তুলেছেন যখন নারীরা মহলে আবদ্ধ, পরাধীন। নারীরা তখন বাংলার চরম রক্ষণশীল সমাজের গড়ে তোলা কঠোর রীতিনীতির শিকলে বন্দি। শিক্ষাহীন, আলোহীন, চরম উপেক্ষিত, সন্তান জন্মদান তার প্রধান কাজ, অন্দরে নির্বাসিত। নারী সমাজের এমন দুঃসময়ে কবি নজরুল ছিলেন সময়ের সাহসী কণ্ঠস্বর। তাঁর শক্তিশালী শব্দচয়নে তিনি দেশে দেশে নির্যাতিত, উপেক্ষিত, নিপীড়িত মানুষের জয়গান পাশাপাশি নারী মুক্তি এবং নারীদের অধিকারের বন্দনা গেয়ে গেছেন।

কবি নজরুল নারীকে কেবল মমতাময়ী মা, আদরের বোন কিংবা হৃদয়ের প্রেয়সীরূপে আবিষ্কার করেন নি। তাঁর লিখায় তিনি নারীকে চিত্রিত করেছেন চির সংগ্রামী, মুক্তিকামী, শক্তিশালি এবং সমঅধিকার সম্পন্ন মানুষ হিসেবে। নজরুল সৃষ্ট বহু গান, কবিতা, প্রবন্ধে কবি নারী মুক্তি, নারীর অধিকার এবং নারীর সম্মানের কথা বারেবারে উচ্চারণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীদের অবরুদ্ধ রেখে, তাদের মুক্তি না হলে সমাজ ও সভ্যতার প্রকৃত উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। তাঁর এই মহতী প্রচেষ্টার কারণে তিনি সকলের কাছে নারী জাগরণের কবি, নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন।

বিদ্রোহী কবি নারীকে কেবল কোমলতায় নয় বরং শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। ক্ষমতা এবং সমাজ সভ্যতায় অবদানের প্রশ্নে তিনি নারী এবং পুরুষের সমতাকে নির্দেশ করে ১৯২০ সালে লিখেছেন– ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

এমন তেজদ্বীপ্ত প্রাণস্পর্শী বাণীতে কেউ নারীর অবদান স্বীকার করবার ঘটনা বাংলা সাহিত্যে বিরল বৈকি। কবি বুঝতে পেরেছিলেন একটি উল্লেখ্যযোগ্য জনসংখ্যাকে পিছনে ফেলে রেখে কখনোই একটি জাতির, রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। ১৮৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করা কবি নজরুল নিজের চোখে দেখেছিলেন সমাজে নারীর দুর্দশা এবং ভোগান্তির চিত্র। তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেই যুগের সমাজব্যবস্থায় নারীর অবদানের কোনো স্বীকৃতি ছিল না। ঘরের বাইরে বিচরণ করবার কোন অধিকার ছিল না। পুরুষরাই ছিলেন পরিবার, সমাজের সর্বেসর্বা, তাদের মতামতের বিরুদ্ধে কেউ কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনি। সেই পুরুষ সমাজের একজন হয়েও নজরুল পুরুষের একচ্ছত্র সক্ষমতার প্রতাপ ভেঙে দিয়েছেন, দৃঢ় প্রত্যয়ে সাম্যের কথা বলেছেন, উচ্চারণ করেছেন সেই অমোঘ সত্য-‘সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/ বিশ্বে যা কিছু এলো পাপতাপ বেদনা অশ্রু বারি/ অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’

নারী অদম্য, দুর্বার। নারী জাগতিক সকল সৌন্দর্যের রূপকার। কবির কলমে উঠে এসেছে নারী শক্তির বন্দনা। উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত নারী হলে যেকোনো কাজ পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করার সক্ষমতা রাখেন। নারী ঘরে সন্তান জন্ম দিয়ে, তাদের বড় করে যেমন তুলতে পারেন তেমনি ঘরের বাইরেও নানান পেশায় নিযুক্ত হয়ে অর্থ উপার্জন থেকে শুরু করে দেশ ও দশের উন্নয়নে সমানে কাজ করে যেতে পারেন। নারীর বহুমুখী শক্তিকে দিনের পর দিন অবদমিত করে রাখা হয়েছে। কবি তাঁর লিখায় নারী শক্তির জয়গান গেয়েছেন সবসময়। নারী তাঁর কাছে শুধু প্রেম, ভালোবাসার উৎসই নয় বরং নারী একজন পুরুষের সকল কাজে অনুপ্রেরণাদাত্রী। যেখানে আবহমান কাল থেকে পুরুষেরা নারীদেরকে চরম অবজ্ঞা ভরে পরনির্ভরশীল করে রাখতে চেয়েছিলেন সেখানে কবি নজরুলের সাহসী উচ্চারণ– ‘কোন কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/ প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়লক্ষী নারী’।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন অসামান্য মানুষবাদী মানুষ। নারীরা নিজেকে নিছকই অবলা, কোণঠাসা, পুতুলসম মনে না করে তিনি তাঁর লিখার মাধ্যমে নারীদের জেগে উঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তার লিখা গান জাগো নারী, জাগো বহ্নি শিখা সমগ্র নারীজাতির নব জাগরণের গান। এই গানের মাধ্যমে তিনি জায়া, ভগ্নি, মাতা, কন্যা অর্থাৎ সকল নারীদের মেধায়, মননে, কর্মে, চেতনায়, শিক্ষায় জেগে উঠার আহ্বান জানিয়েছেন। নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার মতো তিনি মনে করেছেন নারী মুক্তির জন্য শুধু বাইরের সমাজ জাগলে হবে না। জাগতে হবে অন্দরের নারীকে। নিজেকে মুক্ত করতে নারীকে অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে আলোর কাছে আসতে হবে। নারীকে ভেতর থেকে সংগ্রাম ঘোষণা করতে হবে সমস্ত কুসংস্কার, অন্যায়, নিপীড়ন এর বিরুদ্ধে। আর শিক্ষাই পারে নারীকে সেই মুক্তির ক্ষণ টা এনে দিতে। আমাদের বিদ্রোহী কবি তাঁর আনন্দময়ীর আগমনে কবিতায় নারীকে নিষ্প্রাণ মাটির ঢেলা থেকে মানুষ রূপে জেগে উঠতে বলেছেন। সমস্ত অন্যায়অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে বাঁচতে বলেছেন। কবির গান, কবিতা, উপন্যাস এবং গল্পে কবি আমাদের সমাজের নারীদের অধিকার সম্পর্কে যে প্রগতিশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তা আমরা অন্য কোন সৃষ্টিতে তেমন দেখতে পাই না। কবির নারী কবিতা সম্পূণরূপে কবির সাম্যবাদী চিন্তা ধারার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

আজকের দিনে এই সমাজের নারীদের অগ্রযাত্রার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সম্পূর্ণ রূপে না হলেও আমাদের নারীরা জেগেছে। তারা অন্দরের আঁধার থেকে আলোর দিকে ধাবিত হচ্ছে। কবি নজরুলের দেখা স্বপ্নের মতো নারীরা সমাজের মূলধারায় মিশতে শুরু করছে। বিমান চালনা থেকে শুরু করে গবেষণা পর্যন্ত অনায়াসে করছে আজকের নারীরা। বিদ্রোহী কবি সমাজের অবলা নারীদের মধ্যে যে লুকায়িত আগুন দেখেছিলেন তার বাস্তব প্রতিফলন নারীরা তাদের কাজের মাধ্যেমে দেখিয়ে দিচ্ছেন। নারীদের এই এগিয়ে যাওয়ার দিনগুলোই বেগম রোকেয়া, আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুল দেখতে চেয়েছিলেন।

নজরুলের নারী বন্দনা একজন নারী হিসেবে আমাকে মুগ্ধ করে, অনুপ্রেরণা যোগায়। এই নারীকে তিনি সমাজে চির বঞ্ছিত, নিপীড়িতের স্থানে দেখেলেও একজন পুরুষ হয়েও এই নারীতেই তিনি অফুরন্ত সম্ভাবনা দেখেছেন। নিগৃহীত নারীদের মধ্যেই তিনি অসীম শক্তির প্রতীক দেবীকে কল্পনা করেছেন। এই নারীতেই তিনি আবার দেখেছেন তাঁর মনের ভেতর শত বছরের প্রেম সঞ্চারী তাঁর প্রিয়াকে। যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে নিগৃহীত নারীদের জয়গান গেয়ে কবি লিখে গেছেন মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেব খোঁপায় তারার ফুল এর মতন কালজয়ী গান। প্রিয়াকে ভালোবেসে লিখেছেনআলগা কর খোঁপার বাঁধন দিল মেরা অহি ফাস গেয়ি।

লেখক : কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক; শিক্ষক,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী ভাবনায় কবি নজরুল
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ