অভিন্ন পারিবারিক আইন অন্তত শুরু হোক

তাসনুভা রিফাত | শনিবার , ২৪ মে, ২০২৫ at ৭:১২ পূর্বাহ্ণ

আমরা ইতোমধ্যেই জানি যে, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন একটি সময়োপযোগী ও আলোচিত প্রস্তাব রেখেছেসব ধর্মের নারীদের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, যার আওতায় বিয়ে, তালাক, ভরণপোষণ এবং উত্তরাধিকারের মতো মৌলিক অধিকার সমানভাবে নিশ্চিত করা হবে। অধ্যাদেশ জারি করার সুপারিশের পাশাপাশি সব সমপ্রদায়ের জন্য আইনটিকে ঐচ্ছিক রাখারও সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাব পেশের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন থেকে জানানো হয় যে, অভিন্ন পারিবারিক আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গেই মতবিনিময় করা হয়েছে। কমিশন চায়, এই আইন অন্তত কার্যকর হতে শুরু করুক। ঐচ্ছিক রাখার মাধ্যমে হলেও যেন তা শুরু করা হয়। এদিকে, প্রস্তাবটি উত্থাপনের পরপরই সমাজের একটি অংশ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, বিশেষ করে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি লালনকারীদের পক্ষ থেকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেএদেশে আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিলেই বিশেষ করে পারিবারিক ইস্যুগুলোতে কেন ধর্মের প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে, অথচ অন্যান্য ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বহু আইন কিন্তু আমরা বহু বছর ধরেই মেনে চলছি। এই দ্বৈতমানসিকতা বোঝার জন্য আমাদের আইনি কাঠামোর গভীরে প্রবেশ করার দরকার রয়েছে অর্থাৎ কোথায় কোথায় রাষ্ট্রীয় আইন ধর্মীয় আইনকে ছাড়িয়ে গেছে, আর কোথায় কোথায় ধর্মীয় আইনকে অপরিবর্তনীয় ধরে রাখা হয়েছে।

বিষয়ে আলোচনা চলমান থাকতে থাকতেই, আসুন আমরা বোঝার চেষ্টা করি এই সুপারিশগুলো আসলে কিরকম। সংবিধান ও আইনগত কাঠামো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সুপারিশের মধ্যে আরও বলা রয়েছে, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, ২০১০ এবং বিবাহবিচ্ছেদ আইনটির কার্যকর বাস্তবায়ন এবং শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি, বিবাহবিচ্ছেদের মামলাগুলোর নিষ্পত্তি ৩ বছরের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে। অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ সংশোধন করে সন্তানের ওপর নারীর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ২০০৯ সালে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে এবং বিভ্রান্তি এড়াতে একটি সুস্পষ্ট ও শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১ সংশোধন করে বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিবাহিত বাংলাদেশি নারীদের বিদেশি স্বামীকে নাগরিকত্ব প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করা। সাক্ষী ও ভুক্তভোগী নারীদের পরিচয় গোপন রাখা এবং তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ কার্যকর করে নারীদের সমান সুযোগ ও সুরক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের জন্য বিভিন্ন ধর্মের পারিবারিক আইন সংশোধন করা এবং মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারীদের সম্পত্তিতে অর্ধেক/অর্ধেক ভাগ নিশ্চিত করা, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ধারা ১৭ (১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের সুযোগ রাখা) বাতিল করা, সাক্ষ্য আইনে বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়েছে। বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভূক্ত করা, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের অবহেলা ও অপমান অবসানে সম্মানসূচক পদক্ষেপ নেওয়া, পাহাড়ি এলাকা ও শরণার্থীশিবিরে যৌন সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার নিশ্চিত করাসহ সব ক্ষেত্রে নারীর পক্ষে সুপারিশ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেছেন, অভিন্ন পারিবারিক আইনের বিষয়ে একটি আইনগত ভিত্তি থাকা দরকার। কেননা রাতারাতি প্রচলিত পারিবারিক আইন বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। প্রায় সময়ই দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য অনেক কিছু করতে চায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের সেরকম কোনো স্বার্থ নেই। ফলে এই সরকারই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন।

বলাবাহুল্য, একটি রাষ্ট্রের আইন তার নাগরিকদের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্যই প্রণিত হয়। এটি কখনোই কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা সমপ্রদায়ের সুবিধার্থে তৈরি হতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাস থাকবেই, কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন হবে যুক্তি, ন্যায় ও মানবাধিকারের ভিত্তিতেএটাই হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলনীতি। আমাদের বুঝতে হবে, অভিন্ন পারিবারিক আইন মানে কারও ধর্ম পালনের অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়। বরং এটি হবে এমন একটি কাঠামো, যেখানে ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের পারিবারিক আইন সংস্কার এখন আর বিলাসিতা নয়বরং এটি সময়ের দাবি। ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান দিয়ে, এবং যুক্তিবোধ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পুরনো ব্যাখ্যার সঙ্গে নতুন বাস্তবতার সংযোগ ঘটাতে না পারলে, একটি মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় তালের শাঁসে ভরে উঠেছে বাজার
পরবর্তী নিবন্ধনারী সমাবর্তীরা