প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন, পবিত্র মক্কা নগরী পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা মন্ডিত বরকতময় শহর। এ শহরের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। মহান আল্লাহ এ শহরের মাহাত্ন বর্ণনা প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, আমি এই নগরীর শপথ করি যেহেতু হে মাহবুব আপনি এ শহরে তাশরিফ রাখছেন। (সূরা: আল–বালাদ, আয়াত: ১–২)
প্রাসঙ্গিক তাফসীর: মক্কানগরী নিজেও সম্মানিত ও পবিত্র। এ শহরে রয়েছে কা’বাতুল্লাহ এখানে রয়েছে মাক্কাম–ই ইব্রাহীম, হাজরে আসওয়াদ, বিশেষত: এ নগরী আপনার পবিত্র জন্মস্থান।
মক্কা নগরীর শপথের তাৎপর্য: মহান আল্লাহ কর্তৃক কোন শহরের শপথ করা সেই শহরের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রমাণ করে। প্রশ্ন হলো মহান মক্কা শহরের শপথের কারণ কী? এখানে রয়েছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ঘর খানায়ে কা’বা আরো রয়েছে জান্নাতী পাথর হাজরে আসওয়াদ আশে পাশে রয়েছে অসংখ্য নবী রাসূলগণের পদচারণার স্মৃতি বিজড়িত বরকতময় নিদর্শনাদি। যমযম কুপ, সাফা, মারওয়া পাহাড়দ্বয় আরাফা ও মুযদালিফার পবিত্র ময়দান। জবলে নূর, জবলে সওরসহ আরো অসংখ্য পবিত্র স্থান। এসব গুলোর কারণেই কী আল্লাহ মক্কা নগরীর শপথ করেছেন উত্তর হবে কখনো এসব কারণেই শপথ করেননি। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, হে প্রিয় মাহবুব! যেহেতু আপনি এ শহরে তাশরীফ এনেছেন। বসবাসকারীর শ্রেষ্ঠত্বের দরুন বাসস্থানের শ্রেষ্ঠত্ব বেড়ে যায় যেহেতু আপনার বসবাসের কারণে এর নগরীর সম্মান মর্যাদা আমি বহুগুনে বৃদ্ধি করে দিয়েছি। এ শহরের পবিত্র জমিন আপনার নূরানী কদম চুম্মন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। এ পবিত্র নগরী মহান আল্লাহর এতো অধিক প্রিয় যে, একে তিনি তাঁর পবিত্র কা’বা গৃহ নির্মাণের জন্য নির্বাচন করেছেন। এ পবিত্র মক্কাকে তিনি আরো অসংখ্য নামে ভূষিত করেছেন এ প্রসিদ্ধ নাম সমূহের মধ্যে রয়েছে বক্কা, উম্মুল কুরা, বায়তুল আতীক, আল বালাদুল আমীন, আল মুকাদ্দাসা, আল কারইয়াহ ইত্যাদি।
আল কুরআনের আলোকে কা’বা গৃহের নির্মাণ: কা’বা গৃহ প্রাচীন ঘর। এ বরকতময় ঘরের নির্মাণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা–তো বক্কায় যা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। তাতে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি, মকামে ইবরাহীম। আর যে কেহ সেথায় প্রবেশ করে সে নিরাপদ। (সূরা: আলে ইমরান, ৩:৯৬–৯৭)
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাকীমুল উম্মাত মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.) প্রণীত তাফসীরে নুরুল ইরফানে উল্লেখ হয়েছে খানায়ে কা’বা পাঁচবার নিমির্ত হয়েছে। ১. হযরত আদম আলাইহিস সালাম কর্তৃক, ২. হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক, ৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত প্রকাশের পর পনর বছর পূর্বে কোরাইশগণ কর্তৃক, ৪. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) কর্তৃক নির্মিত, ৫. হাজ্জাজ ইবনে ইউসূফ কর্তৃক নির্মিত। (তাফসীরে নূরুল ইরফান, পারা:১৭, পৃ: ৮৮৮)
পরবতীতে বিভিন্ন গোত্র কর্তৃক সংস্কার হয়: আমালিকা গোত্র, মুদার গোত্র উসমানী সুলতান ৪র্থ মুরাদের শাসনামলে ১০৩৯ হিজরিতে বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজীজ এর শাসনামলে ১৪৩৬ হিজরিতে সংস্কার ও সম্প্রসারণ হয়। (সূত্র: আব্বাস কারার আদদ্বীন ওয়া তারীখুল হারামাইন আশশরীফাঈন ৪র্থ সংস্কারণ ১৩৮৭/১৯৬৮)
সাফা মারওয়া পাহাড়দ্বয় আল্লাহর নিদর্শন: সাফা ও মারওয়া পর্বতদ্বয় হযরত মা হাজেরার কদম স্পর্শ করার কারণে আল্লাহর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলো অন্যতম। সুতরাং যারা কা’বা ঘরে হজ্ব বা ওমরাহ পালন করে তাদের পক্ষে এ দুটিও প্রদক্ষিণ করাতে কোন দোষ নেই। বরং কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিছু নেকীর কাজ করে তবে আল্লাহতা’আলা অবশ্যই তা অবগত আছেন এবং তার সে আমলের সঠিক মূল্য দেবেন। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৫৮)
হাদীস শরীফের আলোকে মক্কা আল্লাহর প্রিয়ভূমি: পবিত্র মক্কার মর্যাদা ও সম্মান প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, পবিত্র কুরআন মজীদ অবতরণের শহর, ইসলাম প্রচারের পবিত্র কেন্দ্রস্থল, সম্মানিত নবী রাসূলগণ, খানায়ে কা’বার তাওয়াফ ও যিয়ারতের জন্য এ শহরে তাশরীফ এনেছেন। কা’বা শরীফের আশে পাশে তিনশত সম্মানিত নবীগনের কবর শরীফ রয়েছে, রুকুনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে সত্তর জন নবীগণের কবর শরীফ রয়েছে, হাতীমে কা’বার অভ্যন্তরে যেটি কা’বা গৃহের অংশ বিশেষ এর মধ্যে মীযাবে রহমতের নীচে হযরত ইসমাঈল (আ.) ও তাঁর মা জননী হযরত হাজেরা (আ.)’র কবর শরীফ রয়েছে। মক্কা শরীফের প্রসিদ্ধ কবরস্থান জান্নাতুল মুআল্লা থেকে কিয়ামতের দিবসে এমন সত্তর হাজার মানুষকে কবর থেকে উঠানো হবে। যারা বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এদের প্রত্যেকে সত্তর হাজার গুনাহগার বান্দাকে সুপারিশের অনুমতি প্রাপ্ত হবেন। তাঁদের হারার চৌদ্দ তারিখের চন্দ্রের মতো ঝলমল করবে। (তারিখে মক্কা, খন্ড: ১, পৃ: ৬৭), মক্কা নগরীর প্রতি নূরনবীজির কতো গভীর ভালোবাসা তা নিম্নোক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা মুআযযামার উদ্দেশে বলেছেন তুমি কতোই পবিত্র শহর। আর তুমি আমার নিকট কতই প্রিয় যদি আমার সম্প্রদায় আমাকে তোমার অভ্যন্তর থেকে বের হতে বাধ্য না করতো তবে তুমি ব্যাতীত আমি অন্য কোথাও বসবাস করতাম না। (তিরমিযী শরীফ)
হাজরে আসওয়াদ: এটি একটি বেহেস্তি পাথর। এটি হযরত আদম (আ.)’র সাথে আনীত হয়। এটি মাটি থেকে চার ফুট উপরে কা’বা ঘরের দক্ষিণ পূর্ব কোনে দেয়ালের বহির্দিকে প্রোথিত। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথরটি) বেহেস্ত থেকে এসেছে, সেটা দুধের চেয়েও অধিক সাদা ছিলো। সেটাকে মানুষের গুনাহ সমূহ কালো করে ফেলেছে। (আহমদ, তিরমিযী)
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, মহান রবের শপথ, আল্লাহ সেটাকে কিয়ামতের দিন এমনভাবে উঠাবেন সেটার দু’টি চক্ষু থাকবে যে চক্ষু দ্বারা সে দেখতে পাবে এবং একটি জিহ্বা থাকবে যা দিয়ে কথা বলবে। চুম্মনকারীর পক্ষে সত্য সাক্ষ্য দেবে। (তিরমিযীত, ইবনে মাযাহ)
হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.) মিরাআত শরহে মিশকাতে বর্ণনা করেন, এ পাথরটি সাদা ছিলো, গুনাহগার কিংবা পূর্ববর্তী মুশরিকদের হাত স্পর্শ করার কারণে পাথরটি নিয়মিতভাবে কালো হতে থাকে। সুফিয়ায়ে কেরাম বর্ণনা করেন, গুনাহের কারণে যখন সাদা পাথরটি কালো হয়ে গেছে, তেমনিভাবে বদকার ও গুনাহগারদের সংস্পর্শ দ্বারা ভালো মানুষও মন্দ হয়ে যায়। তাই অসৎ মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত। তাওয়াফকালে হাজরে আসওয়াদের সামনে যাবেন। কাউকে কষ্ট দেয়া ব্যাতিরেকে সম্ভব হলে চুম্বন করবেন, বেশী ভিড় থাকলে ইস্তিলাম করুন, হাতে ইশারায় চুম্বন করুন। আর্থ্যাৎ যদি হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত হাত পৌঁছানো সম্ভব না হয় তাহলে কোন কাঠ বা লাটি দিয়ে স্পর্শ করবেন এবং ঐ কাঠ বা লাটিকে চুম্বন করুন। কাঠ বা লাটি দ্বারা স্পশ করাও সম্ভব না হলে দূর থেকে মাতাফের রেখার উপর দাঁড়িয়ে হাজরে আসওয়াদের দিকে ফিরবেন এবং উভয় হাত হাজরে আসওয়াদের দিকে দেখাবেন এবং আল্লাহু আকবর ওলা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ বলবেন এবং দরুদ শরীফ পড়বেন।
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ইমান সহকারে হাজরে আসওয়াদের নিকট উপস্থিত হবেন কিয়ামত দিবসে হাজরে আসওয়াদ তার জন্য সুপারিশ করবে। (দুররে মনসুর, কানযুল উম্মাল, খন্ড:১২, পৃ: ৯৮)
হাজরে আসওয়াদের চুম্বন সম্মানের জন্য: হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করা , পাথর পুজা নয়, এ চুম্বন ইবাদতের জন্য নয়, কেননা ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই। এ চুম্বন সম্মানের জন্য। স্বত্তাগতভাবে স্বয়ং লাভ ক্ষতি করার মালিক একমাত্র আল্লাহ । হাজরে আসওয়াদ মহান রবের নির্দেশে অত্যন্ত উপকারী এবং ক্ষতিকরও। রাব্বুল আলামীন সকল রূহ হতে স্বীয় একত্ববাদের যে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন ঔই অঙ্গীকার নামা এ পাথবে রক্ষিত আছে। এটা কিয়ামতের দিন এমনভাবে আসবে যে সেটার চক্ষুযুগল ও ওষ্ট যুগল থাকবে। একনিষ্ঠদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে এটি আল্লাহর পক্ষ হতে আমানতদার। (মিরআত শরহে মিশকাত, ৪র্থ খন্ড, পৃ:১৫৭)
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবিস ইবনে রবীআহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত ওমর (রা.) কে দেখেছি যে তিনি হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করতেন এবং বলতেন আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর, উপকারও করতে পারোনা ক্ষতিও করতে পারো না, যদি আমি রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম তাহলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। (বুখারী, মুসলিম)
কা’বা শরীফে এক রাকাত নামাযে এক লক্ষ রাকাত সওয়াব: হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মদীনা মনোওয়ার মক্কা মুকাররমার মসজিদে হারামে এক লক্ষ রাকাত নামাযের সওয়াব। (ইবনে মাযাহ, খন্ড: ১, পৃ: ১০২)
কা’বা শরীফের প্রতি দৃষ্টিপাত করা ইবাদত:
হযরত আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কা’বার দিকে দেখা ইবাদত। (কানযুল উম্মাল, খন্ড:৪, পৃ: ৪৫৮)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নূর নবীজি এরশাদ করেছেন, প্রতিদিন একশত বিশটি রহমত কা’বার উপর বর্ষিত হয়। ষাটটি রহমত তাওয়াফকারীদের জন্য, চল্লিশটি রহমত কা’বার হেরমে নামায আদায়কারীদের জন্য, বিশটি রহমত কা’বার দর্শনার্থীদের জন্য। মহান আল্লাহ আমাদেরকে কা’বা শরীফের মর্যাদা বুঝার ও হারামাঈন শরীফাইনে উপস্থিত হওয়ার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।