সুলেখক দীপালী ভট্টাচার্য এবং রম্যলেখক সত্যব্রত বড়ুয়া আজ আর আমাদের মাঝে নেই। দু’জনেই আমাদের প্রিয় লেখকদের অন্যতম। দৈনিক আজাদী পত্রিকায় দীপালীদির ছোট গল্প, কবিতা প্রবন্ধ প্রায়ই প্রকাশিত হতো। তখন তাঁর লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হতাম। সহজ সরল প্রবহমান ভাষায় বাস্তবধর্মী লেখা, মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁর লেখায় ফুটে উঠতো। একদিন চট্টগ্রাম বেতারে মহিলাদের সাপ্তাহিক ‘অনন্যা’ অনুষ্ঠানে দীপালীদির সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। তিনি স্বরচিত গল্প শ্রোতাদের শোনাবেন। আমি অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলাম। দীপালীদির সাথে দেখা হয়ে এতো ভালো লেগেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। কারণ পাঠকের সাথে যখন লেখকের সাক্ষাৎ হয় তখন পাঠকের মনে অনাবিল আনন্দ ও তীব্র আবেগ সৃষ্টি হয়। দীপালীদির হাসিখুশি অমায়িক ব্যবহার। তিনি মুহূর্তেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। তাঁর সাথে প্রথম দেখাতেই কথা বলে আমার মনে হয়েছিল তিনি আমার চিরচেনা। এরপর প্রায়ই চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের মাসিক সভায় ও দৈনিক চট্টগ্রাম মঞ্চের সাহিত্য সম্পাদক অমিত বড়ুয়ার পরিচালনায় সাহিত্যনির্ভর আড্ডায় তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হতো। আলাপচারিতার মাঝে তাঁর সাথে আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সব সময় তাঁর প্রসন্ন মুখ, নির্মল হাসি ও সাহিত্য সম্পর্কে অনর্গল বক্তব্য তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল। আত্মভোলা সহজ সরল মানুষের প্রতিচ্ছবি তিনি। “আড্ডার” অনুষ্ঠানে প্রায়ই উঠতি তরুণ লেখকদের জন্য তিনি স্বহস্তে খাবার তৈরি করে আনতেন। তাঁর সাথে সব সময় থাকতেন কবি মেহেরুন্নেসা রশিদ। ধর্মের ব্যবধান আজ মানুষকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু দীপালীদি ও মেহেরুন্নেসা আপা দু’জনে ছিলেন অভিন্নহৃদয়। তাঁদের বন্ধুত্বের মাধুর্যে সবাই বিস্মিত ও মুগ্ধ হতেন। ধর্ম নয় মানুষ বড় একথা দু’জন লেখকের শুধুমাত্র লেখায় নয় জীবনের যাত্রাপথেও প্রমাণ করে দিয়েছেন। দীপালীদি সহজেই মানুষকে তাঁর অন্তরের স্নেহ মমতায় কাছে টেনে নিতেন। আমাকে স্নেহ করতেন। তাই তাঁর জন্মদিনে আমাদের কয়েকজনকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমার গাড়িচালক আনোয়ারের নাম বলে তার জন্য একটা খাবারের প্যাকেট দিতে ভুলেন নি। কত উদার মন তাঁর। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য মমত্ববোধ। দেখা হলে আমার সাথে কত গল্প করতেন। সুখ দুঃখের আলাপ করতেন। চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশের অনেক জেলা থেকে তিনি অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু দীপালীদির আচরণে ও কথাবার্তায় কোনো অহমিকা ছিল না। রম্য সাহিত্যিক ফাহমিদা আমিন আপা এবং দীপালীদি সম্ভবত চট্টগ্রামের নারী লেখকদের মধ্যে নিয়মিত লিখতেন। দীপালীদির লেখায় দুর্বোধ্যতা ছিল না। তার সহজ সরল আচরণের মতই লেখালেখিতেও তিনি সবার মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন। লেখক বলতে যেমন সহজ সরল মনের মানুষকে বোঝায় দীপালীদি ছিলেন সেরকম একজন স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের মানুষ। আমার দেখা অন্যতম ভালো মানুষ। লেখক তো অনেক আছেন। কারও মনে দম্ভ, কারও মনে ঈর্ষা, কারো ব্যবহার রুক্ষ। কিন্তু দীপালীদি মানুষকে গভীর ভালবাসার সাথে গ্রহণ করতেন। তাই তার সাহিত্য জীবননির্ভর সাহিত্য। তিনি লেখালেখির জগতে অমর হয়ে থাকবেন নিঃসন্দেহে। আমি তাঁর বিদেহী আত্নার শান্তি কামনা করছি।
সত্যব্রত বড়ুয়া দৈনিক আজাদীতে নিয়মিত রম্যরচনা লিখতেন। সামান্য বিষয়কে অবলম্বন করে তিনি এতো চমৎকার হাস্যরসের সাথে বিশ্লেষণ করতেন যা পাঠকের মনকে অভিভূত করে। আমি অনেক সময় পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখা জমিয়ে রাখতাম। মাঝে মাঝে সেটা আবার পড়তাম। হাস্যরসাত্মক লেখা পড়লে মনে জমে থাকা বিষাদ দূর হয়ে যায়। হালকা আনন্দে অন্তর ভরপুর হয়ে ওঠে। সত্যব্রত বড়ুয়া একজন অত্যন্ত গুণী লেখক। লেখায় হাস্যরস ফুটিয়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন। সেজন্য রম্যসাহিত্যিক সংখ্যায় স্বল্প। কৈশোর থেকে আমি সৈয়দ মুজতবা আলী– ও শিব্রাম চক্রবর্তীর লেখা পড়তাম। সত্যব্রত বড়ুয়ার লেখা পড়ে কখনো আনন্দ অনুভব করতাম ও কখনো সমাজের অসংগতির প্রতি তাঁর বিশ্লেষণ আমাকে জীবনকে উপলব্ধি করতে সহায়তা করতো। তিনি ছিলেন একেবারে নির্ভেজাল সহজ সরল মানুষ। তাঁর শান্তশিষ্ট আচরণ এ যুগে দুর্লভ। দেখা হলেই স্মিত হাসিতে শুভ কামনা জানাতে ভুলতেন না। দেশ সমাজ ও মানুষ তাঁর লেখায় সর্বদা ঠাঁই পেয়েছে। তিনি একজন অনন্য সাধারণ লেখক। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
চট্টগ্রামের অনেক লেখক ও তাঁদের সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ের আলোচনাকে প্রাধান্য দিয়ে শৈলী প্রকাশনার কর্ণধার সুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ গত ২২ এপ্রিল শিল্পকলা একাডেমিতে ‘শৈলী লেখক পাঠক উৎসবের’ আয়োজন করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। লেখকের বইয়ের আলোচনার মাধ্যমে পাঠক বইগুলো সম্পর্কে জানতে পারে এবং পড়তে উৎসাহ বোধ করে। তাছাড়া লেখকদের সরাসরি প্রত্যক্ষকরা ও তাঁদের সাথে আলাপ করা বই পাঠে উৎসাহ সৃষ্টি করে। বর্তমান যুগের অস্থিতিশীল সমাজে বই পড়া প্রধান্য পাওয়া প্রয়োজন। এজন্য বই কেনা দরকার। যাদের ঘরে অনেক বই আছে দেখা যায় সে সব পরিবারের ছেলেমেয়েরা শৈশব থেকে বইয়ের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিভিন্ন ধরনের বই পাঠ করে প্রকৃত জ্ঞানার্জন করা সম্ভব হয়। বর্তমান যুগ আধুনিক যুগ। কম্পিউটার মোবাইল ইত্যাদির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু কথায় বলে “যে রাধে সে চুলও বাঁধে”। অবসর সময়ে বৃষ্টির দিনে ছুটির দিনে একটি ভালো বই হতে পারে পাঠকের মনের সঙ্গী। বই পড়লে মন উদার হয়। ধর্মের বিভেদ ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর হয়। দেশ, সমাজ, প্রকৃতি পৃথিবী এবং মানুষকে উপলব্ধি করা সহজ হয়। একটি ভালো গ্রন্থ মনকে অভূতপূর্ব আনন্দে ভরিয়ে দেয়। জীবনে সময়ের অভাবে কত ভালো বই পড়তে পারছি না এ কথা ভাবলে দুঃখ অনুভব করি। চট্টগ্রাম একাডেমিতে রাশেদ রউফের সহযোগিতায় অনেক কল্যাণকামী ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের বইয়ের আলোচনা, বই উৎসব ইত্যাদির ব্যবস্থা করে বই কেনা ও বই পাঠে বর্তমান প্রজন্মকে উৎসাহ প্রদানের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বয়সের কারণে আমি প্রায় সময় উপস্থিত হতে পারি না, কিন্তু বই সংক্রান্ত প্রতিটি আলোচনার উদ্যোগে আমার শুভ কামনা থাকে। শৈলী লেখক পাঠক উৎসব ও সে সাথে সর্বজনপ্রিয় আয়েশা হক শিমু পরিচালিত ‘উঠোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের’ মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠান দর্শকদের অন্তরকে অভিভূত করেছিল। সংস্কৃতির প্রসারে ‘উঠোন’–এর উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
টীকা : শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে বই কিনতে হবে ও বই পড়তে হবে তা নয়। সারা বছর সবার বই পড়া ও ক্রয় করা প্রয়োজন। বই পড়া ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম; কবি–সাহিত্যিক–কলামিস্ট।