রঙ চটে যাওয়া জামা, ফিতা ছিঁড়ে যাওয়া জুতোজোড়াও ফেলে দিতে ইচ্ছা করে না। এর বিকল্প নতুন এবং দামি সংগ্রহ করতে পারি, তবুও স্মৃতিবিজড়িত অতীত ছাড়তে ইচ্ছা করে না। দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে অদৃশ্য ও অলিখিত এক অজানা মায়া তৈরি হয়েছে।
যে রিকশাওয়ালার সাথে ভ্রমণ করি, সে রিকশাওয়ালা যখন অন্য রিকশাওয়ালা কিংবা পথচারীদের সাথে বিবাদে জড়ায়, তখন আমার রিকশাওয়ালার পক্ষ অবলম্বন করি। ন্যায়–অন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে কার্পণ্যও করি। কারণ, আমাকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তার সাথে ১০/২০ টাকার কথিত চুক্তি হয়েছে।
একই নিয়োগে সারাদেশে পদায়ন পাওয়া সবাই সহকর্মী, অথচ তার পক্ষেই বলি–তাকে আপন মনে হয়, যার সাথে পাশাপাশি বসি, একই প্রতিষ্ঠানে থাকি। মোটকথা, একসাথে থাকতে থাকতে, পথ চলতে চলতে, কথা বলতে বলতে একটা ‘টান’ অনুভব করি। দীর্ঘজীবন যে পাথরের পাশে থাকি, সে পাথরের জন্যও মায়ার জন্ম হয়।
টান এক অদ্ভুত জিনিস। সমস্ত জীবনে এই মায়া ছেড়ে বের হওয়া যায় না। ভাষাতেও সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করা প্রায় অসম্ভব, অথচ দূরে গেলে বিচ্ছেদের অনল মনকে অহর্নিশ পোড়ায়। নিয়মিত পাশে থাকার টান আর দীর্ঘদিন দূরে থাকার টান–একটান নয়। তবে মনের মধ্যে প্রকৃত মায়া জন্মালে কাছের কিংবা দূরের–এটা কোনো ব্যাপার নয়–আর মায়া কাটে না।
টানের আত্ম তারে অবসরে সবাইকে মনে পড়ে। ফেলে আসা অতীতের স্মৃতি মনের ক্যানভাসে সতেজ হয়ে ভেসে ওঠে। মনকে টেনে নেয় স্মৃতিময় দূর সমুদ্দুরে। হয়তো যাকে জীবনে পেলে ব্যথা বাড়ত, তবে না–পাওয়ার ব্যথা আরও বেশি বেদনার। শখের কলম কিংবা প্রিয় ঘড়ি হারিয়ে গেলে বেদনার বালুচর মরুর মতো খা খা করে। আরও দামি কিছু কেনার সামর্থ্য থাকার পরেও শখের বস্তুর শূন্যতা আসলে মেটে না। না–পাওয়ার আফসোস কোনোদিন মেটাবার নয়।
মানুষ যে মানুষের সাথে বাঁচে, পাশে হাঁটে এবং সারাজীবন থাকে–মায়া না জন্মালে থাকা যায় না। পোষা বিড়ালটি, খাঁচায় রাখা পাখিটি ছেড়ে দূরে গেলেও কলিজায় ব্যথা অনুভব হয়। প্রিয় আকাশ, খোলা মাঠে শিশিরভেজা ঘাস–শৈশবের টানে অতীতে ফিরিয়ে নেয়। ঝগড়াঝাঁটি হয়, মারামারি–কাটাকাটি, কত কেস–মামলা–তারপরেও মানুষ আবার মানুষের আপন হয়। ঘর বাঁধে, একসাথে স্বপ্ন বুনে। টান না থাকলে ভালো লাগা মরে যেত, ভালোবাসা হারিয়ে যেত। শখ–আহ্লাদ পূরণের প্রেরণা মায়া থেকেই জন্মে। যার মনে প্রেম–ভালোবাসা নেই, সে স্বপ্ন দেখতে জানে না।
মানুষ সাধারণত অতীত–আশ্রয়ী। সে বর্তমানকে ভবিষ্যতের সাথে তুলনা করার বদলে অতীতের বাটখারায় মেপে নেয়। অতঃপর ভালো–মন্দের বিচার করে।
সমাজ–সংসারের প্রতি যখন টান বাড়ে, তখন মানুষ দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠে। যে নিজেকে ভালোবাসতে জানে না, সে অন্যদেরও ভালোবেসে আগলে রাখতে পারে না। টান আছে বলেই চারপাশের দৃশ্য সৌন্দর্যের শোভায় সেজে থাকে। মায়া মানুষের মহৎ গুণের একটি। মায়া বাড়লে দায়িত্ব বাড়ে। তখন বিশ্বাস ও ভরসা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালিত হয়।
মায়াহীন হৃদয়, টানহীন দুনিয়া কবরের সাথে দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেঙে সবাইকে কবরমুখী করে। জীবন থাকতেও যারা মৃত হিসেবে বিবেচ্য–তারা মায়াবিহীন। প্রতিশ্রুতি রাখা, বেলাশেষে নীড়ে ফিরে আসা এবং দায়িত্বকে অবশ্য পালনীয় মনে করা–মায়া থেকেই জন্মে। যে নিজেকে ভালোবাসতে পারে না, সে দুনিয়ার সমস্ত ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়।
দুনিয়ায় দু–দিন থাকতে মেহমান হয়ে এসেছি। কোনো কিছুর প্রতি মায়া যাতে মোহে রূপান্তরিত না হয়–তবে দুঃখ বাড়বে। কোনোকিছুকে চরমভাবে আকাঙ্ক্িষত করলে এবং সেটা না পেলে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন ঘটবে।
কারো সাথে রুক্ষতা দেখানো, আপত্তিকর আচরণ করা কিংবা অন্যের ক্ষতির ক্ষতিতে যাতে আমাদের নাম না থাকে। বিশ্বাস অটুট রাখলে এবং আমানত রক্ষা করলে–মানুষের দোয়া মিলবে। ঠকালে এবং ঠেকালে নিজের ভাগ্য থেকে দায় চুকাতে হবে। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে উত্তম বিনিময় পাবে, কিন্তু মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে নিজেকেই বঞ্চিত করার পথ পৃথক করা হবে।
মানুষ বড় হয় দোয়ায়, বাঁচে কৃতজ্ঞতায়। স্বপ্ন সাজায় ভালোবাসায়। ন্যায়বোধে পরিস্ফুটিত হোক জীবনের প্রিয় ফুল–যেন ভালোবাসার বকুল, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা এবং সুন্দরের সুবাসিত মুকুল।