নূরুননাহার পালায়। শ্বশুরবাড়ি থেকে। ভোরবেলা। মসজিদের মাইকে তখন ফজরের আজান শুরু হয়েছে। কুয়াশায় ঢাকা গ্রামের রাস্তা। মাথায় সাদা ওড়না, কাঁধে পুরোনো কাপড়ের ব্যাগ, পায়ে হাওয়াই চটি। হাতে ধরা একটা মোটা ডায়েরি। মুখ নিচু করে হাঁটছে সে–একদম নিঃশব্দে। কারও ঘুম না ভাঙুক, এমন একটা ভয় যেন তার বুকের ভেতরে বাজছে টিনের গ্যালনের মতো।
তার বয়স বাইশ। তিন বছর আগে বিয়ে হয়েছে। বর, রায়হান– একটা ওষুধের দোকানে কাজ করে। শ্বশুর–শাশুড়ি দুজনই রুক্ষ, কম কথা বলে। কিন্তু যেটুকু বলে, তা যেন কাঠের ফালি দিয়ে গায়ে চাবুক মারা।
নূরুননাহার শুরুতে ভেবেছিল, সব ঘরই তো এমন হয়। চুপচাপ ছিল। তারপর একদিন শাশুড়ি বলল, তোরা মেয়ে পোলাপান কবে আনবি? বইঠা বইঠা কি জিন্দেগি পার হইব?
সেইদিন থেকে, প্রতিদিনের প্রত্যাশা, বাচ্চা। যেন একটা মেয়ের শরীর মানেই সন্তানের কারখানা। কিন্তু রায়হান ডাক্তার দেখায় না। শুধু রাতে এসে চুপচাপ শরীরের দখল নেয়। কাল রাতেও তাই হয়েছিল। আর আজ সকালে, ঠিক আজানের সময়, নূরুননাহার বেরিয়ে আসে দরজা ঠেলে।
সে এখন দাঁড়িয়ে আছে ব্রিজের কাছে। নিচ দিয়ে শান্ত নদী বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একখানা বাস আসে। নূরুননাহার হাত তোলে। বাস থামে।
কই যাইবেন?
জামতলা।
ড্রাইভার তাকায় একবার। মেয়ে একা। ভোরবেলা। কিছু না বলে ওঠার অনুমতি দেয়। জামতলায় নূরুননাহার নামে। ওখানে তার মামাতো ভাই ইলিয়াসের টেইলার্স। সেখানে ঢুকে বলে, ভাই, আমি পালাইছি। কোথাও যাবো।
ইলিয়াস তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর একটা চেয়ার টেনে দেয়–বসো। আমি শুধু জানি, তুমি সাহসী। এখন বলো, কই যাবা?
নূরুননাহার ডায়েরি খুলে একটা নাম লেখে– রহিমা খালার বাড়ি, নারায়ণপুর।
খালার সঙ্গে সে ছোটবেলায় একবার দেখা করেছিল। সেই বাড়ি একবার বলেছিল, যদি কবে কেউ তোরে মানে না, আমার বাড়ি আইস।
নূরুননাহার এখন নারায়ণপুরে। খালার বাড়িতে উঠেছে। রহিমা খালা বলছে, এই বাড়িতে কেউ তোকে খুঁটায়ে দেখবে না মা। খালি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সাহস রাখতে হয়।
খালা তাকে একটা মহিলা কমিউনিটি সেন্টারে কাজ জোগাড় করে দেয়। সেখানে সেলাই শেখায়, কিছু বাচ্চা মেয়েদের পড়ায়। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে ডায়েরির পেছনের পাতায় লিখে রাখে– পালিয়ে এসে প্রথমবার নিজের টাকায় সাবান কিনলাম। ভালো লাগছে।
চার মাস পর, শহরের একটা মহিলা সংগঠন, যেখানে সে কাজ করত, হঠাৎ একটা মামলায় জড়িয়ে পড়ে। সংগঠনটাকে দোষী প্রমাণ করার জন্য পুলিশ খোঁজ নিতে শুরু করে সব কর্মীদের বাড়ি।
রায়হান তখনো খুঁজে ফিরছে। সে থানায় একটা অভিযোগ দিয়েছিল– ‘স্ত্রী উধাও। মানসিক ভারসাম্যহীন। ফিরে এলে চিকিৎসা করাতে চাই।’
সংবাদ ছড়ায়। পুলিশ আসে নারায়ণপুরেও। তবে এবার নূরুননাহার পালায় না। সে দাঁড়ায় পুলিশের সামনে।
আমি পালাইনি, আমি বেঁচেছি।
আপনার স্বামী তো অভিযোগ দিয়েছে আপনি অসুস্থ!
যদি বেঁচে থাকতে চাও, নিজেকে পাগল বলো– এই ছিল ওদের নিয়ম। আমি তাতে থাকবো না।
এখন সংগঠনের আইনজীবীরা পাশে দাঁড়ায়। মিডিয়াতে আসে তার কথা– ‘নূরুননাহার: এক পালানো মেয়ের জীবনের সত্যি গল্প।’
এক বছর পর, নূরুননাহার এখন ঢাকায়। একটি এনজিও চালায়–যেখানে আশ্রয় পায় ঘর ছাড়া মেয়েরা। ডায়েরির শেষ পাতায় সে লেখে, পালানো মানেই হেরে যাওয়া নয়। পালিয়ে এসে যদি কাউকে বাঁচাতে পারি, সেই তো সবচেয়ে বড় জয়।