প্রতিবছর ১৮ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব জাদুঘর দিবস। ১৯৭৭ সালে International council of Museums (ICOM) বা আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদ এই দিবসটি প্রবর্তন করে, যার মূল উদ্দেশ্য জাদুঘরের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষামূলক ভূমিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো -‘দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে জাদুঘরের ভবিষ্যৎ’- অর্থাৎ জাদুঘর কেবল অতীতের নয়, বরং ভবিষ্যতের জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র।
বাংলাদেশে জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে যেসব জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলো ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, লোকজ সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্যের ধারক ও বাহক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম- যে শহরটি প্রাচীন ইতিহাস, সমুদ্রবন্দর, উপনিবেশিক নিদর্শন, ও নৃ-গোষ্ঠীগত বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ-সেখানে এখনো একটি পূর্ণাঙ্গ নগর জাদুঘর গড়ে ওঠেনি।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও প্রাকৃতিক বন্দর শহর। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে এটি হরিকেল, সমতট ও শ্রীহট্ট প্রভৃতি রাজ্যের অংশ ছিল। আরব বণিক, পর্তুগিজ, মোগল ও ব্রিটিশ শাসকদের আগমন এই শহরের সংস্কৃতিতে রেখেছে গভীর ছাপ। চট্টগ্রামে আজও দৃশ্যমান প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন, আরাকানী প্রভাব, উপনিবেশিক স্থাপত্য ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। এমন ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলে এখনো একটি সুসংগঠিত নগর জাদুঘরের অভাবে সাংস্কৃতিকভাবে অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
যদিও ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি একাডেমিক গবেষণাভিত্তিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, নৃ-তত্ত্ব ও শিল্পকলা বিভাগে সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা হিসেবে কাজ করছে, তবুও এটি একটি নগর জাদুঘরের ভূমিকায় পুরোপুরি আসতে পারেনি। শহরের কেন্দ্র থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় এটি নাগরিকদের সহজলভ্য নয়। ফলে নগরবাসীর বৃহৎ অংশ চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কাছ থেকে জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
একটি আধুনিক নগর জাদুঘর কেবল অতীত সংরক্ষণের জায়গা নয়-এটি হয়ে উঠতে পারে এক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাকেন্দ্র, যা গবেষণা, সৃজনশীলতা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জাদুঘরে চট্টগ্রামের প্রাক-ঐতিহাসিক নিদর্শন, বন্দরের ইতিহাস, উপনিবেশিক সময়ের দলিল, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারা, লোকশিল্প, ঐতিহাসিক মুদ্রা ও মানচিত্রসহ নানা উপাদান একত্রে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা সম্ভব।
বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক জাদুঘরের মতো এই জাদুঘরে ব্যবহার করা যেতে পারে ডিজিটাল প্রযুক্তি-যেমন ভার্চুয়াল ট্যুর, ইন্টারেক্টিভ মাল্টিমিডিয়া, ও ডিজিটাল আর্কাইভ। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ঐতিহ্য চর্চা ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থী, গবেষক ও পর্যটকদের জন্য এটি হয়ে উঠতে পারে একটি অনন্য আকর্ষণ ও গবেষণার ক্ষেত্র।
রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়া। একটি পূর্ণাঙ্গ চট্টগ্রাম নগর জাদুঘর প্রতিষ্ঠা সেই উদ্দেশ্যে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। এটি এ নগরের আত্মপরিচয় নির্মাণে যেমন সহায়তা করবে, তেমনি চট্টগ্রামকে একটি সাংস্কৃতিক হাব হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তুলে ধরতে পারবে।
বিশ্ব জাদুঘর দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-ইতিহাসকে শুধু বইয়ের পাতায় নয়, আমাদের জীবনের অভ্যন্তরে স্থান দিতে হবে। সেই ইতিহাসের শিকড়, স্মৃতি ও চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এখনই সময় চট্টগ্রাম শহরে একটি নগর জাদুঘর প্রতিষ্ঠার। এটি শুধু একটি ভবন নয়, বরং হবে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে এক চিরস্থায়ী সেতুবন্ধন।
আসুন, আমরা সবাই এই দাবিকে শক্তিশালী করি।
লেখক: সিনিয়র কিউরেটরিয়াল অফিসার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।