হল্যান্ড থেকে

দেশ থেকে ঘুরে এসে- সত্য হোক ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৭ মে, ২০২৫ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

হল্যান্ড ফিরে এসে কয়েকটি ছবি শেয়ার করার পর দেশ থেকে কাছের এক বন্ধু লিখেছে, ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।’ উত্তরে লিখি, কথাটা সম্পূর্ণ ঠিক না। বলা উচিত, ‘ঘরের বুড়ো ঘরে ফিরে এসেছে।’ মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না। কমই বা বলি কেন? বলা উচিত বেলা তো প্রায় শেষের দিকে। ধরে নেইঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। কিন্তু ঘর কোনটা? বাংলাদেশ না হল্যান্ড? দীর্ঘ ৩৪ বছর যে দেশে কাটিয়ে দিলাম, সেটি তো মায়েরদেশের চাইতে কোন অংশে কম নয়। জীবনকে সুন্দর করার যাকিছু প্রয়োজন, তার চাইতেও বেশি দিয়েছে এই দেশ। আমার বর্তমান, ভবিষ্যৎ, তার ওপর এই এতগুলি বছর কাটিয়ে দেয়া দীর্ঘ সময়। এই দেশ দিয়েছে একটি নিশ্চিত, নিরাপদ জীবন। ঘর থেকে বাইরে বের হলে গাড়ি চাপায় প্রাণ যাবে কিনা, ছিনতাইকারীর হাতে পড়বো কিনা কিংবা বেঘোরে, ভুল বা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবো কিনাএমনতরো কোন ভাবনা মাথায় ভুলেও আসেনা এদেশে। মাঝে মাঝে মাঝরাতে সুমনাকে (গিন্নী) একা মিনিট বিশেক গাড়ি চালিয়ে অসুস্থ মায়ের কাছে যেতে হয়। ভিন্ন দুই শহরে থাকা আত্মজ ও আত্মজা (অতীশ ও সপ্তর্ষি) মাবাবাকে দেখতে এসে রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে ট্রেনে ফিরে যায় নিজের ডেরায়। দেশে এ চিত্র ভাবাই যায়না। দেশে মাবাবাকে তাদের সন্তানদের নিয়ে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত উদ্বিগ্নে কাটাতে দেখেছি। দেখেছি অতি কাছ থেকে, নিকটজনদের। স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের কেবল স্কুলে পৌঁছিয়ে দিয়েই শেষ হয়না তাদের উৎকণ্ঠা ও ডিউটি। স্কুলের ধারেকাছে গাছের ছায়ায়, ফুটপাতে, রাস্তার ধারে মাথায় রোদবৃষ্টি নিয়ে তারা দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। সুমনার মামাতো বোন টুম্পাকে দেখেছি সপ্তাহের সাতদিন তার ৯বছরের মিষ্টি মেয়েটির পেছন পেছন ছুটতে। মেয়ের নয়, মায়ের কাঁধে স্কুলের বই, খাতার ভারী ব্যাগ। টুম্পা বলে, এই ব্যাগ বইতে বইতে আমার কাঁধ ব্যথা হয়ে গেছে। স্কুলে মেয়েকে গেইটের ভেতর ঢুকিয়ে তড়িঘড়ি করে বাসায় ফেরা, দিনের রান্না করে আবার দৌড়ে স্কুল, মেয়েকে নিয়ে বাসায় গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার মেয়েকে নিয়ে কোচিং সেন্টার যাওয়া। কষ্ট এখানেই শেষ নয়। স্কুল যেদিন নেই সেদিন নাচগানের স্কুল। তারপর রয়েছে নানা সামাজিকতা। এর বিয়ে, ওর অন্নপ্রাশন, কর্ণছেদন, এনগেইজমেন্ট, কারো শেষকৃত্যানুষ্ঠান। রয়েছে নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। এ শুধু এক টুম্পার দিনলিপি নয়। এমন টুম্পা দেখেছি আরো অনেক। ওর কষ্ট দেখে আমার কষ্ট হয়, আক্ষরিক অর্থে। কথাটি বললে মুখে শুকনো হাসি টেনে সে বলে, এ আমাদের গাসওয়া হয়ে গেছে। এত কষ্ট, এত দুঃখ, এত অনিয়ম, অবিচার, অবহেলা আর অযত্নে বেড়ে উঠা এই দেশটিকে তারপরও ভালো লাগে। ভালো লাগে বলে ফিরে যাই বারবার। ফিরে এসে ভাবিকোনটি আমার আপন? যে দেশ আমাকে জন্ম দিল, বড় করলো, সেটি? না, যে দেশ আমায় একটি নিরাপদ, নিশ্চিন্ত জীবন ও ভবিষ্যৎ দিলো সেটি? নাকি আমার দুটোই চাই? আবার নিজেকে নিজে প্রশ্ন করিযদি আমাকে দুটোর মধ্যে একটি বেছে নিতে বলে তাহলে কোনটি বেছে নেবো? আমার মন কী চায়? আমার অন্তর? প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাইনি।

) তবে এ প্রশ্নের উত্তর পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম থেকে স্নেহভাজন ইয়ার। পুরো নাম ইয়ার চৌধুরী। বয়সে আমার ছোট হলেও এবার দেশে তিন মাসের অবস্থান সময় সে প্রায় সময় আমার ডেরায় আসতো। বাসায়, কাছাকাছি কোন কফি শপ কিংবা রেস্তোরাঁয় বসে আলাপ হতো তার সাথে বিজ্ঞান, অর্থনীতি, বিশ্ব রাজনীতি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। ইয়ার জানেনা এমন কম বিষয় আছে। আমরা কাছের কয়েক বন্ধু এ কারণে ওকে ‘গুগল’ ডাকি। কিছুটা ‘ইন্ট্রোভার্ট’ ইয়ার ভালো ইংরেজি জানে। বলতে শুনিনি, বলার প্রয়োজন হয়নি, তবে লিখে যে ভালো তার প্রমাণ মিলেছে অনেকবার। তাকে লিখেছিলাম, দেশ থেকে ফিরে এসে দেশের কথা, বিশেষ করে আমার প্রাণের শহর চাটগাঁর কথা খুব মনে পড়ছে। চাইলে আগামীকালই ফিরে যেতে পারি সেশহরে। কিন্তু যাবো না। যাবো, বেড়াতে কিন্তু একেবারে থাকার জন্যে নয়। হয়তো কোন এক সময় এই দেহখানি যাবে। নিথর দশায়। জানতে চাই তার কাছে কেন এমনটি হয়? উত্তরে ইয়ার লেখে– ‘মানুষের মন কখনো কখনো একাধিক স্থানে বাস করে। হতে পারে সত্যিকার বাড়ি কিংবা ঘর কেবল একটি জায়গা নয়। সত্যিকার ঘর হলো সেখানে, যেখানে ভালোবাসা, স্মৃতি ও শান্তি বাস করে। আপনি হল্যান্ড এবং বাংলাদেশ উভয় জায়গায় এর কিছু না কিছু অংশ বানিয়েছেন।’ এটি দিয়ে হয়তো ইয়ার এটিই বুঝাতে চাইছে যে আমার দুটোই আপন, আমার দুটোই চাই। কেননা দেশে যেমন, ঠিক তেমন ভালোবাসা শান্তি আমি পেয়েছি হল্যান্ডেও। আমার যা কিছু সম্মান, অর্জন তার অনেকটা ওলন্দাজদের অতি উন্নত এই দেশে এসে। তাই বোধকরি দুদিকই আমায় টানে। ভাবি, আমার দশা কি তাহলে অমিতের মতো? লাবন্য ও কেতকীর প্রতি তার ভালোবাসা প্রসঙ্গে অমিত যতিকে বলেছিলো– ‘যে ভালোবাসা ব্যাপ্তভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ; যে ভালোবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সবকিছুতে যুক্ত হয়ে থাকে, সংসারে সে দেয় আসঙ্গ। দুটোই আমি চাই। একদিন আমার সমস্ত ডানা মেলে পেয়েছিলুম আমার ওড়ার আকাশ; আজ আমি পেয়েছি আমার ছোট্ট বাসা, ডানা গুটিয়ে বসেছি। কিন্তু আমার আকাশও রইলো।’

) দিন কয়েক আগে বন্ধু জানতে চায় দেশ থেকে ফিরে এসে কী ‘মিস’ করছি। উত্তরে বলি, চাটগাঁ শহর। আমার প্রাণের শহর। চাটগাঁর মানুষ। চাটগাঁর মানুষের মত আন্তরিক, অতিথিপরায়ন দেশেবিদেশে খুব বেশি দেখিনি। আমার মানুষ দেখতে ভালো লাগে। কাজেঅকাজে যখনই ঘরের বাইরে গেছি মানুষ দেখেছি। কেউ কেউ বলে, তাতে (মানুষ) দেখার কী আছে? কী যে আছে, নিজেও জানিনা। কিন্তু দেখতে ভালো লাগে। জামালখান এলাকায় সন্ধ্যে বা রাতের বেলায় যখন হেঁটে বেড়িয়েছি, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে, দেখতাম তরুণতরুণীরা এমন কী বয়স্ক, আধবয়স্ক পুরুষমহিলা পাশাপাশি, মুখোমুখি, কেউ কেউ একে অন্যের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে, গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসে নিচু স্বরে, কখনো উঁচু স্বরে কথা বলে চলেছে। তাদের প্রায় সবাই ফুটপাতলাগোয়া ভ্যান থেকে গরম গরম চাফুঁচকা, অন্যান্য স্নাঙ খেতে খেতে কথার পাহাড় বুনছে। আমি ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম, দেখতাম, দেখে ভালো লাগতো। এর বাইরেও মানুষ দেখেছি। দেখেছি ভালো মানুষ, দেখেছি অসৎ, ঠকবাজ মানুষ। অসৎ বা ঠকবাজ বললেই হয়। এতেই বুঝা যায় কেবল মানুষ সম্পর্কে বলা হচ্ছে। কেননা কেবল মানুষই অসৎ, ঠকবাজ, জোচ্চুর, বদমাশ হয়। পশুরা হয় না। পশুদের মধ্যে এই ত্রুটিগুলি (দোষ) নেই। কেবল মানুষই মানুষের ক্ষতি করে, তারা পশুপ্রাণীর ক্ষতি করে, প্রকৃতির ক্ষতি করে। কাক কাকের মাংস খায়না বলে একটি কথা আছে। কিন্তু মানুষ খায়। অর্থাৎ মানুষ মানুষকে মারে। ছেলেমেয়ে তাদের জন্মদাতা মাবাবাকে হত্যা করছে, স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, বন্ধু বন্ধুকে, শত্রুকে হত্যা করছে। স্বার্থ সহ নানা কারণে। মানুষই অন্যের সম্পত্তি কেড়ে নেয়। মানুষই পরসম্পদ, পরস্ত্রী, পরস্বামী নিজদখলে নেয়। পত্রপত্রিকার পাতা খুললে এমনতর ঘটনা অহরহ দেখা যায়। তখন দেশে ফিরে যাবার যে অদম্য ইচ্ছে তা অনেকটা মিইয়ে আসে। হল্যান্ডে আমার বাড়ির পেছনের বাগানে (ব্যাকইয়ার্ড গার্ডেন) পাউরুটিকে ছোটছোট টুকরো করে ছড়িয়ে দেই। কয়েকটা কবুতর, পাখি এমন কী কাকও এসে তা খায়। লক্ষ্য করি, প্রত্যেকটি প্রাণী মুখে কেবল পাউরুটির একটি টুকরো নিয়ে উড়াল দেয়, বাগানের দেয়ালে বসে খায়, নয়তো ধারেকাছে তার নীড়ে গিয়ে তার সন্তানদের খাওয়ায়, তারপর আবার ফিরে আসে। হতো যদি মানুষ, তাহলে দেখা যেত যার পেশি শক্তি বেশি সে একসাথে সব নিজ দখলে নিতো। পশুপাখিরা নেয় না। মানুষপশুতে কী পার্থক্য। মাঝে মাঝে ভাবি আমরা কেন পশুর মত ভালো হতে পারিনা। আমরা কেন বলি, পশুর মত আচরণ। পশুর আচরণ কি মানুষের চাইতেও খারাপ? সত্য হোক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা– ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।

লেখক

সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদাম্পত্য অধিকার
পরবর্তী নিবন্ধসামাজিক অসুখ উচ্চ রক্তচাপ ও লবণ-তেঁতুল সমাচার