সামুদ্রিক জলোচ্ছাস এবং অব্যাহত ভাঙনের কবলে পড়ে চকরিয়ার ভেওলা–ঢেমুশিয়া–কোনাখালী–বাঘগুজারা (পেকুয়া সংযোগ সড়ক) সড়কটি একেবারে চলাচল অযোগ্য হয়ে পড়ায় বছরের পর বছর ধরে চরম দুর্ভোগের শিকার হয়ে আসছিলেন যাত্রী–সাধারণ। এই অবস্থায় বিগত সরকার মাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের এই সড়কটি বিটুমিনাস কার্পেটিং দ্বারা টেকসইভাবে নির্মাণে উদ্যোগ নেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সড়কটি নতুন করে নির্মাণে সাড়ে ৮ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয় ধরে দরপত্র আহ্বানের পর ঠিকাদার নিয়োগ দেয়। এতে সড়ক ব্যবহারকারী ভুক্তভোগী মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ এই কাজের শুরুতেই নিয়োজিত ঠিকাদার যেসব সামগ্রী ব্যবহার করছেন তা একেবারেই নিম্ন মানের।
সরেজমিন দেখা গেছে, জনগুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটির নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যন্ত নিম্ন মানের ইট, ইটের খোয়া ও কাঁদামাটিযুক্ত মাতামুহুরী নদীর বালু। এছাড়া মাতামুহুরী নদী তীরের গাইড ওয়াল তৈরি করা হচ্ছে মাটির উপরিভাগ থেকেই। আবার আশেপাশে মিঠা পানি না থাকায় ব্যবহার করা হচ্ছে সমুদ্র মোহনায় সংযুক্ত থাকা মাতামুহুরী নদীর লবণাক্ত পানি। এত এত অনিয়মের মাধ্যমে নির্মাণ হতে যাওয়া সড়কটির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন এবং ভুক্তভোগীদের মাঝে ক্ষোভের উদ্রেক হয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, গাইড ওয়াল নির্মাণের কাজে একদিকে নিম্ন মানের সামগ্রীর ব্যবহার, অপরদিকে মিঠা পানির বদলে লবণাক্ত পানির ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারের বিপুল পরিমাণ এই টাকা দিয়ে সড়কটি নির্মাণ করার কাজ চলমান থাকলেও সার্বক্ষণিক কোনো নজরদারি নেই এলজিইডি চকরিয়া প্রকৌশলী কার্যালয়ের উপ–সহকারীর (এসও)। মাঝেমধ্যে গিয়ে ঢুঁ মেরে আসলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় এসও এবং কার্য সহকারী নিম্ন মানের এই কাজে কোনো প্রকার বাধা দিচ্ছেন না। এতে জনগণের কোনো কথাকে আমলে না নিয়ে সাব ঠিকাদার তার ইচ্ছেমতো কাজ চলমান রেখেছেন।
তবে তদারকি না থাকার বিষয়টি সত্য নয় জানিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ–সহকারী প্রকৌশলী মিরাজুল ইসলাম বলেন, উপজেলায় আমার অধীনে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। তাই শুধুমাত্র একটি কাজে সার্বক্ষণিক পড়ে থাকার সুযোগ নেই। অবশ্য সবগুলো কাজের মান যাতে ঠিকাদার বজায় রাখে তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা হয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) চকরিয়া সূত্র জানায়, গ্রামীণ সংযোগ উন্নয়ন প্রকল্পের (আরসিআইপি) তত্ত্বাবধানে এডিবি ও জিওবির অর্থায়নে চকরিয়া উপজেলার বদরখালী পশ্চিম বডার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৫৩০০ মিটারের সড়কটি বি.সি (বিটুমিনাস কার্পেটিং) দ্বারা নির্মাণের কাজ পায় মূল ঠিকাদার ইউটি মং নামের এক ব্যক্তি। কাজটি পাওয়ার পর ওই ঠিকাদারের কাছ থেকে সাব ঠিকাদার হিসেবে কাজটি বাগিয়ে নেন কঙবাজারের সেলিম এন্ড ব্রাদার্সের মো. সেলিম রেজা। প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার কাজটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ কোটি ৫২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩৫ টাকা। চলমান এই সড়কটির নির্মাণকাজে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করা স্থানীয় বাসিন্দা রেজাউল করিম, সেলিম উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজনের ভাষ্য– জনগুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। বঙ কাটিংয়ের পর সেই মাটি মিশ্রিত বালু দিয়ে বঙ ভরাট করণ, রোড রোলারের ব্যবহার না করা, লবণাক্ত পানি ব্যবহার করা এবং নিম্নমানের ইট, সিমেন্ট ও বালুর সংমিশ্রণ, নিম্নমানের ইটের খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবহৃত ইটের খোয়াগুলো ভাল করে চাপ দিলে গুড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের অভিযোগ– কাজ তদারকিতে চকরিয়া উপজেলার প্রকৌশলীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ এবং গাফিলতি থাকায় সাব ঠিকাদার যেনতেনভাবে কাজটি সম্পাদন করে সরকারের কোটি কোটি টাকার জলাঞ্জলি দিচ্ছেন।
তবে সাব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেলিম এন্ড ব্রাদার্সের সেলিম রেজার ভাষ্য– কাজের শুরুতে কিছু নিম্ন মানের ইট এসেছিল সাইটে। তা জানার পর সেই ইট ব্যবহার করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। তবে কাজের অন্যান্য সামগ্রীর মান ভাল রয়েছে। তিনি বলেন, দরপত্রের শর্তাবলী অনুসরণ করেই কাজ চলমান রয়েছে এবং এলজিইডি শতভাগ কাজ বুঝে নিচ্ছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের কঙবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন খান জানিয়েছেন– উন্নয়ন কাজের চুক্তি মোতাবেক কাজ না হলে এবং কাজে অনিয়ম পেলে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।