চট্টগ্রাম শহরের প্রধানতম সমস্যা জলাবদ্ধতা। বর্ষাকালে এই জলাবদ্ধতা নগরবাসীর জীবনমরণ সমস্যা হিসাবে দেখা দেয়। টানা বর্ষণ শুরু হলে শহরের অনেক এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। থমকে যায় মানুষের চলাচল। বললে অসত্য হবে না যে, জলাবদ্ধতার কারণে বর্ষা মৌসুম চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসীদের কাছে কয়েক দশক ধরে এক ধরনের যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। বলা যায়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের জন্য তা ইতোমধ্যে এক আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই শহরের বেশিরভাগ রাস্তায় কোথাও হাঁটুজল, কোথাও কোমর সমান পানি জমে যায়। কোথাও কোথাও রীতিমতো সাগরে রূপ নেয়। বছরের পর বছর জলাবদ্ধতার এ সমস্যা থাকলেও এ থেকে মুক্তি মিলছে না। জনপ্রতিনিধিরা আসেন আর যান। অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। আশ্বাসও মেলে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না! যদিও জলাবদ্ধতার যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
তবে চলতি মৌসুমে নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যা অর্ধেকে এবং ক্রমান্বয়ে তা শূন্যে নামিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি চট্টগ্রামকে এই কাজে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন। তিনি গত বুধবার দুপুরে সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন এবং অঙিজেন–হাটহাজারী মহাসড়কের উন্নয়ন সংক্রান্ত’ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। এসময় প্রধান উপদেষ্টা এবার বর্ষায় জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকে নগরবাসী কতটা মুক্তি পাবেন সেটা জানতে চান সংশ্লিষ্টদের কাছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এ বছর যেহেতু বর্ষা মৌসুম ইতোমধ্যে এসে গেছে তাই এবার সমস্যা পুরোপুরি সমাধান সম্ভব হবে না। কিন্তু গত কয়েক মাসে সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাতে যদি এবছর আশানুরূপ ফল না আসে তাহলে তো সব কিছু মনে হবে জলে গেল।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা অনেক রকম থিওরিটিক্যাল আলোচনা করেছি, সেসব আর করতে চাই না, আমরা চাই জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে চিরতরে বের হয়ে আসতে। কিন্তু সেটা একবারেই হবে না, তাই আমাদেরকে ক্রমান্বয়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
ড. ইউনূস বলেন, চট্টগ্রাম শহরের যে সক্ষমতা রয়েছে অন্য অনেক অনেক শহরের সেই সক্ষমতা নেই। তাই চট্টগ্রামের সকল প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় হতে হবে এবং নাগরিক সমাজকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে একটি প্রতীকী সমস্যা এবং খুবই জটিল সমস্যা। এই সমস্যা নিরসনের মাধ্যমে অন্যান্য শহর ও জেলা উৎসাহিত হবে, তাই চট্টগ্রামকে এই কাজে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে।
এবার বর্ষায় জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকে নগরবাসী কতটা মুক্তি পাবেন এ বিষয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জানতে চেয়েছেন, জলাবদ্ধতার কত পার্সেন্ট এবার আমরা কমাতে পারব। মূলত প্রধান উপদেষ্টা এটাই শুনতে চাচ্ছিলেন, আমরা এত যে কাজ করেছি, কত শতাংশ এবার জলাবদ্ধতার হাত থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে পারব? এটা কি ২০ শতাংশ, ৩০ শতাংশ নাকি ৪০ শতাংশ, না ৫০ শতাংশ? আমি বলেছি, আমি ১০০ শতাংশ বলব না, ইনশাল্লাহ ৫০ শতাংশ। গত ছয় মাস ধরে আমরা যে কাজ করেছি, খাল খনন করেছি, অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়েছি ও নালাগুলো পরিষ্কার করেছি। এখান থেকে আশা করতে পারি, ৫০ পার্সেন্ট হলেও জনগণকে স্বস্তি দিতে পারবো। এটা আরো বেশিও হতে পারে।
এর আগেও দায়িত্ব গ্রহণের ৬ মাস উপলক্ষ্যে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বেশি ‘ফোকাস’ করছেন বলে জানিয়েছিলেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে বেশি ফোকাস করেছি; যেহেতু এটা শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা। জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে খাল–নালা পরিষ্কার করছি। এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার নালা আছে। সেখানে থোক বরাদ্দ থেকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছি। তিনি বলেন, চারশ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট পরিকল্পনা কমিশনে আছে। সেটা অনুমোদন পেলে জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খননে আরো বেশ কিছু ইক্যুইপমেন্ট আমরা সংগ্রহ করতে পারব।
বাস্তবিক অর্থে জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখগাথা হয়ে আছে। বর্ষা মৌসুমে ভারী কিংবা অল্প বৃষ্টিতে নগরের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে, এই নিয়তি একপ্রকার মেনে নিয়েছে নগরবাসী। এমনকি বৃষ্টি না থাকলেও অনেক সময় জোয়ারের পানিতেও ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজার, হাসপাতালসহ বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার ঘটনা এখানে নৈমিত্তিক। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যে ভূমিকা পালন করছে, তা প্রশংসনীয়। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার কঠোর বাস্তবায়ন চায় নগরবাসী।