মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি দিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিযোগিতায় যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে এতে স্থান করে নিতে হয়। এরপর চান্স হলে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। চার বছরে স্নাতক শেষে আরেক বছর রয়েছে মাস্টার্স। এভাবে বহু কষ্টে উচ্চশিক্ষার এই ধাপ শেষে সবচেয়ে প্রত্যাশিত ও আনন্দঘন মুহূর্ত তথা সমাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহ থাকে সবাই। সনদপ্রাপ্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা জীবনের অন্যতম অনুপ্রেরণা হিসেবেও কাজ করে। আর সেই সমাবর্তনের মাধ্যমে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন শিক্ষার্থীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে ঘিরে গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। গ্র্যাজুয়েটরা সমাবর্তনের গাউন পরে বন্ধু, সহপাঠী, পরিচিতদের নিয়ে সেইসব স্মৃতি ফ্রেমবন্দি করে রাখছেন। তবে সবচেয়ে আনন্দদায়ক মুহূর্ত হচ্ছে, অনেকেই বাবা–মাকে নিয়ে এসেছেন। নিজের সফলতার আনন্দ ভাগাভাগি করছেন তাদের সঙ্গে। কেউ আবার বাবাকে গাউন পরিয়ে দিচ্ছেন, মায়ের মাথায় দিচ্ছেন হ্যাট। সন্তানের অর্জনে শামিল হতে পেরে খুশি অভিভাবকরাও। দীর্ঘ অপেক্ষার পর শিক্ষার্থীরা তাদের গর্বের ডিগ্রি হাতে নিবেন। আর সঙ্গে ফিরছে পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন, আবেগছোঁয়া উচ্ছ্বাস, হাসি আর আনন্দাশ্রুর সম্মিলন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে বর্তমানে ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আইনজীবী হিসেবে আছেন মিজানুর রহমান। সমাবর্তনের দিন স্মরণীয় করতে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর থেকে নিয়ে এসেছেন মা ও বাবাকে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মূল অনুপ্রেরণা ছিল আব্বা–আম্মার দোয়া। অনেক সময় হতাশা এলে তাদের কথা চিন্তা করে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতাম। উনারাও আমাকে অনুপ্রেরণা এবং সাহস দিতেন। এজন্য আজকের আনন্দের সম্পূর্ণ ক্রেডিট তাদেরই। তাই বাড়ি থেকে অনেক দূরে হলেও আব্বা–আম্মাকে নিয়ে এসেছি। তারাও খুব আনন্দিত। মিজানুর রহমানের বাবা বলেন, ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে এটা আমাদের জন্য আনন্দের। আমি আর ওর মা যে কত খুশি, বলে বোঝাতে পারবো না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। মিজানুর রহমানের মা বলেন, ছেলেকে গাউন–টুপিতে গ্র্যাজুয়েট হিসেবে দেখা গর্বের। দোয়া করি ও যেন সৎভাবে দেশের সেবা করতে পারে। পরনে কালো গাউন আর মাথায় বিশেষ হ্যাট। সমাবর্তনের চিরায়ত দৃশ্য এটি। গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের বহুল প্রতীক্ষিত দিন সমাবর্তন। গতকাল চবির গ্র্যাজুয়েটদের সব আবেগ যেন রূপ নিয়েছে উচ্ছ্বাসে। সমাবর্তনে অংশ নিয়ে একদিকে আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্য শোনা, অন্যদিকে আকাশে টুপি উড়িয়ে ছবি তোলা। চবি ক্যাম্পাসে গতকাল বুধবার আবহ অনেকটা মহোৎসবের মতো। গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে উৎসবে মেতেছেন তাদের স্বজনরাও। এদিকে সমাবর্তন বক্তৃতায় গ্র্যাজুয়েটদের দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথিরা। সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মুখর হতে থাকে গ্র্যাজুয়েটদের পদচারণায়। সকাল ৭টা থেকে গ্র্যাজুয়েটরা ক্যাম্পাসে আসা শুরু করেন। অনেকে আগেই ক্যাম্পাসের হলে ও আশপাশে অবস্থান নিয়েছেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণায় কোণায় লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। যেদিকে চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। সকালে নিজ নিজ বিভাগে গিয়ে যারা আগের দুইদিন গাউন নেননি তারা গাউন, খাবার ও আইডি কার্ড সংগ্রহ করেন। যারা আগেই গাউন নিয়েছেন তারা খাবার আর আইডি নেন। এরপর ছবি তোলায় ব্যস্ত সবাই। সবাই মেতে ওঠেন দিনটিকে ফ্রেমে বন্দি করে রাখার প্রতিযোগিতায়। ২৩’শ একরের ক্যাম্পাসের কোথায় পা ফেলার জায়গা নেই। নানান ভঙ্গিতে, পোজে ছবি তোলেন গ্র্যাজুয়েটরা। কেউ বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে হাস্য–রসাত্মক ছবিও তোলেন। ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার, সাইন্স ফ্যাকাল্টি মসজিদ, বুদ্ধিজীবী চত্বর, বিজয় ৭১ চত্ত্বর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যান, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, সেন্ট্রাল ফিল্ড, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও আশপাশের এলাকা, ফরেস্ট্রি, প্রতিটি অনুষদের বিভাগ, প্রতিটি হল, ঝুলন্ত ব্রিজ, প্রতিটি দর্শনীয় স্থান সবখানে যেন ছিল ছবি তোলার মহোৎসব।
অনেকে গত দুই দিন ধরে ছবি তুললেও সমাবর্তনের দিনে ছবি তোলার বিশেষ আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারেননি। শেষ মুহূর্তে সবারই চাওয়া ছিল চার বছরের স্নাতক জীবনের আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপনী দিনের মুহূর্তগুলো ধরে রাখা। তাই তো অধিকাংশ শিক্ষার্থী গ্রাম থেকে নিজের বাবা–মাসহ পরিবারের সদস্যদের এনেছেন ক্যাম্পাসে। বাবার গায়ে গাউন আর মায়ের মাথায় তুলে দিচ্ছেন সমাবর্তনের বিশেষ টুপি। তাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন ক্যাম্পাস। নিয়ে যাচ্ছেন নিজের আবাসিক হল দেখাতেও। ক্যাম্পাসে এসেছিলেন বাংলা বিভাগের আব্দুল্লা মাসুদ। পরে প্রিয় ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়েই সমাবর্তনের টুপি বাবাকে পরিয়ে দেন। যে মানুষটির অকুণ্ঠ সমর্থন ও পরিশ্রমে এত দূর আসা, যেন এভাবেই তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন তিনি। সমাবর্তন নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে শাওন নামে এক শিক্ষার্থী জানান, সমাবর্তনের দিনটি তার কাছে বিশেষ একটি দিন। এ দিনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। স্মৃতির পাতায় দিনটি ধরে রাখতে বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া গাউন ফেরত নেওয়ার আগে আরও কিছু চমৎকার মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দি করার ইচ্ছে শাওনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে কথা হয় আরেকজনের সঙ্গে। তিনি জানান, আজকের দিনটি তার কাছে একটু বিশেষ। তিনি সন্তান এবং স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ৫ম সমাবর্তনে যোগ দিয়েছেন। সামিয়া নামে এক অভিভাবক সন্তানের সমাবর্তনে আসার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, আমিও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। ৩৩ বছর আগে এখানে আমাদের পদচারণা ছিল। আমি সে সময় সমাবর্তন নিতে পারিনি। কিন্তু আমার মেয়ে সমাবর্তন পেয়েছে। তার সমাবর্তনের আনন্দ ভাগাভাগি করতে আমি এসেছি।
কিন্তু এই আনন্দের জোয়ারে দাঁড়িয়ে কিছু গাউন যেন শূন্য। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পাশের দেয়ালে চোখ পড়তেই দেখা যায় তিন তরুণের মুখ, তাদের গায়ে গাউন, হাতে সনদ। দেয়ালজুড়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন শহীদ হৃদয়, ফরহাদ ও পলাশ। কেউ জীবনের জন্য লড়াই করে শহীদ, কেউ মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে চিরবিদায়–তবু আজকের এই দিনে তারাও যেন সবার সঙ্গে ফিরে এসেছেন।
পতিত স্বৈরাচার সরকারের বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো চবির ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ও ফরহাদ হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। অন্যদিকে, মানবিক দায়িত্ববোধ নিয়ে বানভাসি মানুষের পাশে গিয়ে ফাহিম আহমেদ পলাশ হারান তার জীবন। যাদের সাহস ছিল, স্বপ্ন ছিল, আজ তারা নেই, কিন্তু তাদের চেহারা, গর্ব আর গাথা রয়ে গেছে এই ক্যাম্পাসের দেয়ালে। সেদিন হৃদয় তরুয়া ও ফরহাদের রক্তে লাল হয়েছিল চট্টগ্রামের রাজপথ। তাদেরকে নিশ্চয়ই আজও ভুলেননি দেশবাসী। এক সমাবর্তী বলেন, ওরাও তো আমাদের মতোই স্বপ্ন দেখেছিল। আজ ওরা নেই, কিন্তু দেয়ালটা যেন ওদের ফিরে নিয়ে এসেছে। এই গ্রাফিতি কেবল একটি চিত্র নয়, এটি প্রতিবাদের স্মারক, দায়িত্ববোধের প্রতিচ্ছবি, হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনার নীরব কণ্ঠস্বর। ক্যাম্পাসের উচ্ছ্বাসের মাঝে এই নিঃশব্দ দেয়াল বারবার মনে করিয়ে দেয়, আদর্শের মৃত্যু হয় না, সাহস ফিরে ফিরে আসে।
সমাবর্তনের অনুভূতি প্রকাশ করে ইতিহাস বিভাগের মো. কামাল উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে দিয়েছে স্বপ্ন দেখার সাহস। সাথে আরও দিয়েছে একজন জীবনসঙ্গী। কৃতজ্ঞতা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি। এদিন দুপুর দুইটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে শুরু হয় সমাবর্তন অনুষ্ঠান। বিপুল পরিমাণ কনভোকি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। এতে প্রধান উপদেষ্টাকে ডি–লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, অর্জিত এই বিদ্যা, এই সনদ, এই প্রজ্ঞা সমাজে আলো ছড়ানোর আগে যেন তোমাদের অন্তরকে সম্পূর্ণরূপে আলোকিত করে, সেই চেষ্টা করবে। তোমরা তোমাদের অনুজদের জন্য অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেদের মানবিক, অসামপ্রদায়িক, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। উপাচার্য আরও বলেন, বর্তমান পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর। তোমরা সর্বদা এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকবে। মানবসভ্যতার উন্নয়নে যেই প্রযুক্তি তোমাদের ব্যবহার করার কথা, সচেতন থেকো সেই প্রযুক্তি যেন তোমাদের ব্যবহার করে না ফেলে। নিজেদের সময়কে সর্বোচ্চ সুন্দর এবং সৃষ্টিশীল কাজের পেছনে ব্যয় করো।