চলতি মৌসুমে নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যা অর্ধেকে এবং ক্রমান্বয়ে তা শূন্যে নামিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসময় তিনি চট্টগ্রামকে এই কাজে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন। তিনি গতকাল বুধবার দুপুরে নগরের সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন এবং অক্সিজেন–হাটহাজারী মহাসড়কের উন্নয়ন সংক্রান্ত’ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। এসময় প্রধান উপদেষ্টা এবার বর্ষায় জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকে নগরবাসী কতটা মুক্তি পাবেন সেটা জানতে চান সংশ্লিষ্টদের কাছে।
জলাবদ্ধতা ইস্যু প্রাধান্য পেলেও সভায় নগর সরকার, আগ্রাবাদ বক্স কালভার্ট পরিষ্কার, জেলা স্টেডিয়াম বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে দেয়া বরাদ্দ বাতিল, খাল–নালা পরিষ্কারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জন্য ইক্যুপমেন্ট সংগ্রহ, চট্টগ্রাম–হাটহাজারী সড়কে যানজট নিরসন, কালুরঘাটে ডেন্টাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
‘আশানুরূপ ফল না এলে সব জলে যাবে’ : ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এ বছর যেহেতু বর্ষা মৌসুম ইতোমধ্যে এসে গেছে তাই এবার সমস্যা পুরোপুরি সমাধান সম্ভব হবে না। কিন্তু গত কয়েক মাসে সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাতে যদি এবছর আশানুরূপ ফল না আসে তাহলে তো সব কিছু মনে হবে জলে গেল।
সভায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা নানা উদ্যোগ ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এরপর প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা অনেক রকম থিওরিটিক্যাল আলোচনা করেছি, সেসব আর করতে চাই না, আমরা চাই জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে চিরতরে বের হয়ে আসতে। কিন্তু সেটা একবারেই হবে না, তাই আমাদেরকে ক্রমান্বয়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
ড. ইউনূস বলেন, চট্টগ্রাম শহরের যে সক্ষমতা রয়েছে অন্য অনেক অনেক শহরের সেই সক্ষমতা নেই। তাই চট্টগ্রামের সকল প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় হতে হবে এবং নাগরিক সমাজকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে একটি প্রতীকী সমস্যা এবং খুবই জটিল সমস্যা। এই সমস্যা নিরসনের মাধ্যমে অন্যান্য শহর ও জেলা উৎসাহিত হবে, তাই চট্টগ্রামকে এই কাজে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে।
কতটা মুক্তি মিলবে, জানতে চেয়েছেন উপদেষ্টা : এবার বর্ষায় জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকে নগরবাসী কতটা মুক্তি পাবেন তা জানতে চেয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিষয়টি নিশ্চিত করে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জানতে চেয়েছেন, জলাবদ্ধতার কত পার্সেন্ট এবার আমরা কমাতে পারব। মূলত উনি (প্রধান উপদেষ্টা) এটাই শুনতে চাচ্ছিলেন, আমরা এত যে কাজ করেছি, কত শতাংশ এবার জলাবদ্ধতার হাত থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে পারব? এটা কি ২০ শতাংশ, ৩০ শতাংশ নাকি ৪০ শতাংশ, না ৫০ শতাংশ? আমি বলেছি, আমি ১০০ শতাংশ বলব না, ইনশাল্লাহ ৫০ শতাংশ। গত ছয় মাস ধরে আমরা যে কাজ করেছি, খাল খনন করেছি, অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়েছি ও নালাগুলো পরিষ্কার করেছি। এখান থেকে আশা করতে পারি, ৫০ পার্সেন্ট হলেও জনগণকে স্বস্তি দিতে পারবো। এটা আরো বেশিও হতে পারে।
সভায় জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল–নালা পরিষ্কারের সুবিধার্থে মেশিনারিজ এবং ইক্যুপমেন্ট সংগ্রহে সিটি কর্পোরেশনের আটকে থাকা ২৯৮ কোটি টাকার প্রকল্পের বিষয়টিও তুলে ধরেন মেয়র। এ প্রসঙ্গে আজাদীকে তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল–নালা পরিষ্কার এবং বর্জ্য অপসারণের জন্য ইক্যুপমেন্ট এবং মেশিনারিজগুলো সংগ্রহ করা খুব জরুরি, এগুলোর বিকল্প নেই। প্রকল্পটি ৩৯৮ কোটি টাকার ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় ১০০ কোটি টাকা কমিয়ে ২৯৮ কোটি টাকা করে ফেলে। ২০২২ সাল থেকে আটকে আছে। সেটার কথা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি যাতে যন্ত্রপাতি আমরা কিনতে পারি।
মেয়র বলেন, চলমান প্রকল্পের ৩৬টি খাল আমাদের বুঝিয়ে দিলে ব্যবস্থাপনার জন্য বাজেট প্রয়োজন, সেটা বলেছি। তিনি বলেন, সভায় জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। স্বল্প মেয়াদের মধ্যে যে সংস্কার কাজগুলো চলছে সেই কাজগুলোকে আরও বেশি ত্বরান্বিত করা। মধ্যমেয়াদী কিছু পরিকল্পনা আমাদের আছে। আরও ২০টা খাল, যেগুলো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সংস্কার করবে। চায়না পাওয়ারের সাথে আমাদের কথা হয়েছে এবং উনিও তাতে একমত হয়েছেন যাতে সবাই মিলে সে কাজটা আমরা ত্বরান্বিত করতে পারি।
শাহাদাত বলেন, দীর্ঘমেয়াদে জনসচেতনতা বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের শ’খানেক স্কুল দিয়ে তারা শুরু করতে চান এবং পরে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাকে যুক্ত করবেন।
সভায় জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান কার্যক্রম নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন। এতে সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, জেলা প্রশাসনসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো জলাবদ্ধতা নিরসনে কী কাজ করছেন তা তুলে ধরা হয়।
আগ্রাবাদ বক্স কালভার্ট : সিটি মেয়র ডা. শাহদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, সভায় স্থপতি জেরিনা হোসেন বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদে জলাবদ্ধতার সমস্যার কথা বলেন। তখন আমি বলেছি, আমরা নাসির খাল খনন করছি। আগ্রাবাদ বক্স কালভার্ট খননের পরিষ্কারের কথা বলেছি। এর প্রেক্ষিতে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ওটা আমরা করে দিচ্ছি, তার জন্য অলরেডি অনুদান চলে আসছে।
নগর সরকার ইস্যু : সভায় সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন নগর সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। তিনি বলেন, পরিকল্পিত নগরায়নের স্বার্থে বর্তমানে আপনাদের সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে বা স্থানীয় সরকারের যে সংস্কার সেখানে নগর সরকার প্রথমেই আসতে হবে। নগর সরকার না আসলে প্রকৃত নগরায়ন অর্থাৎ প্ল্যানড আর্বানাইজেশন কখনো হবে না। বিষয়টি নিশ্চিত করে মেয়র আজাদীকে বলেন, এটাতে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) খুব প্লিসড (সন্তুষ্ট) হয়েছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
জেলা স্টেডিয়াম স্টেডিয়াম ইস্যু : নগরের কাজীর দেউড়ি সংলগ্ন চট্টগ্রাম জেলা স্টেডিয়ামটি ২৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে) বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয় সভায়। সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসন ও একটি ক্রীড়া ক্লাবের প্রতিনিধি। অবশ্য এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, সভায় একজনের বক্তব্য ছিল মাঠটা চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস)। এটা যেন বাফুফেকে দেয়া না হয়। বাফুফে মাঝে মধ্যে ব্যবহার করতে চাইলে সিজেকেএস থেকে অনুমতি নিয়ে যেন করে। ওই প্রেক্ষিতে আমার কাছে জানতে চাইলে বলেছি, মাঠটা নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা হয়েছিল, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় মনে করেছিল এটা তাদের মাঠ। আসলে এটা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। সুতরাং এটা জেলা ক্রীড়া সংস্থার মাঠ। জেলা ক্রীড়া সংস্থার মাঠ বাফুফেকে সরাসরি দিয়ে দেয়া আইনগতও না।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম জেলা স্টেডিয়ামটি প্রথমে ১০ বছরের জন্য এবং পরবর্তী সময় ২৫ বছরের জন্য বাফুফেকে বরাদ্দ দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ।
অন্যান্য : সভায় হাটহাজারী সড়কে যানজট নিরসন নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিভিন্ন প্রস্তাবনা ছিল। এছাড়া নগর জামায়াতের আমীর শাহজাহান চৌধুরী হাটহাজারী–দোহাজারী পর্যন্ত কমিউটর টেন চালু এবং চট্টগ্রাম–কঙবাজার সড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করার প্রস্তাব করেন।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, শিক্ষা উপদেষ্টা সি. আর আবরার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, প্রধান উপদেষ্টার স্পেশাল এনভয় লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম।