(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আগের রাতের সেই রেস্তোরাঁয় গ্রিলড ফিশ এবং কয়েক রকমের সবজি খেলাম। সবই গ্রিলড। ঢেঁঢশ, কাঁচামরিচ, বেগুন সবই কয়লায় পুড়ে বিক্রি করা হচ্ছে। পোড়ার সিস্টেমেও রয়েছে বিশেষ কায়দা, কোন দাগ নেই সবজির শরীরে, অথচ হাত দিলেই গলে গলে যাচ্ছে! এখানেও চীনা বুদ্ধি সক্রিয় বলে মনে হলো! দোকানি এক গাল হেসে করিম খাবার কেমন হয়েছে তাও জানতে চাইলো। আমরা বিগলিত হাসিতে তার উত্তর দিলাম। অবশ্য একথা ঠিক যে, মাছ এবং সবজির গ্রিলড আসলেই ভালো ছিল।
সেই পুরানো পথ মাড়িয়ে হোটেলে পৌঁছলাম। করিম ভাই নিজের রুমে চলে গেলেন। আমি রিসিপশনে বসে বসে কয়েকটি ফোন করলাম। মনে হলো, বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে ভালো লাগবে। রিসিপশনের মেয়েটিকে বাইরের সিকিউরিটি নিয়ে প্রশ্ন করলাম। সে কিছু বুঝলো বলে মনে হলো না, শুধু হাসলো। আমি বাইরে পা বাড়ালাম।
বসন্তের শহর কুনমিং, সবসময়ই যেনো বসন্ত ছুঁয়ে থাকে চারপাশে। কী এক মুগ্ধতা! গাছগাছালীতে ছুঁয়ে আসে বসন্ত, আলো আঁধারীতে নীরবতা! বিশাল ফুটপাত ধরে হাঁটার সময় শহরটিতে কী শান্তি এবং মুগ্ধতা নিয়ে যে রাত নামে তার টের পাচ্ছিলাম। রাজপথ জনশূন্য, কোন পথচারী নেই কোথাও। ক্ষণে ক্ষণে দুই চারটি দ্রুতগতির গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিলো। ভবনগুলোতেও আলো আঁধারীর খেলা। গাছের ঢাল থেকে ঝুলে থাকা বর্ণিল কাগজের ইলেক্ট্রিক লন্ঠনগুলোতেও রঙের খেলা। নিয়নসাইনগুলোতেও চলছে বর্ণিল বিজ্ঞাপন। আরো কিছুক্ষণ হাঁটলাম। কেউ আমার পথ আটকালো না, কেউ আমাকে কোত্থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি জানতে চাইলো না। কোন ছিনতাইকারী বা কিশোর গ্যাংয়ের কবলে পড়লাম না। আহারে শান্তি! রুমে ফিরে ডিভানে হেলান দিলাম। জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়ার পর খলখল করে উঠলো কুনমিং শহর। একটু আগে দেখে আসা সেই রাজপথ, সেই আলো–আঁধারী, সেই রঙের খেলা যেনো নতুন মাত্রায় ধরা দিল। ডিভানে হেলান দিয়ে আমি শহর দেখতে লাগলাম। চা কফির আয়োজন রয়েছে। বানিয়ে খেতে ইচ্ছে করছিল না। পানি খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার বিছানা উপরে, ডুপ্লেক্স। কাঠের ঘোরানো সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠলাম। বিশাল চওড়া বিছানার পাশের পুরোটা জুড়েই কাচের জানালা। পর্দা সরিয়ে ঝলমলে একটি শহরের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি নিদ্রাদেবীকে আহ্বান জানালাম। ইন্টারকমের শব্দে ঘুম ভাঙলো। নিশ্চয় করিম ভাই। এখানে আমাকে ফোন করার মতো আর তো কেউ নেই। হ্যালো বলতেই করিম ভাই বেশ দ্রুত তৈরি হতে বললেন। হোটেলেই ব্রেকফাস্ট। তিনি জানালেন যে, একেবারে রেডি হয়ে নামুন। নাস্তা সেরেই গাড়িতে উঠবো। গাড়ি চলে এসেছে।
বিল বেশ শব্দ করেই বললো, গুড মর্নিং স্যার। কেমন আছেন। সে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে জুতা পাল্টে নিতে বললো। ক্যাডস পরার পরামর্শ দিল। বললো, হাঁটতে হবে, পাহাড়ে। সিঁড়িও পিচ্ছিল থাকে। ফরমাল সু’ দিয়ে পারবেন না। আমি বেশ দ্রুত রুমে গিয়ে জুতা পাল্টে গাড়িতে উঠলাম।
কুনমিং শহর থেকে ছবির মতো সুন্দর একটি রাস্তা ধরে দুই ঘন্টারও বেশি গাড়ি চালানোর পর বিল বললো, আমরা পৌঁছে গেছি। খেয়াল করে দেখলাম যে, পাহাড় পর্বত ডিঙ্গিয়ে আমরা অত্যন্ত সমতল একটি জায়গায় পৌঁছে গেছি। এটিই জিউশিয়াং গুহা এলাকা। চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং শহর থেকে প্রায় একশ’ কিলোমিটার দূরে একটি বিস্ময়কর কার্স্ট গুহা সমষ্টি। এখানে প্রায় ১০০টিরও বেশি গুহা রয়েছে, যা চীনের বৃহত্তম কার্স্ট গুহা গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। এই গুহা সমষ্টি ‘কার্স্ট গুহার জাদুঘর’ নামে খ্যাত।
জায়গাটি সমতল হলেও মনে হচ্ছিল পাহাড়ের উপর। চারদিকে সবুজে সবুজে ঢেকে থাকা পাহাড়ের মাঝে চমৎকার একটি উঠোনের মতো জায়গা। তবে বিশাল। পুরো জায়গাটিকে অসাধারণ নান্দনিকতায় গড়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে দোকানপাটও। খাবারের রেস্তোরাঁ, ক্যাফে এবং স্যুভেনির বিক্রি হচ্ছিলো দোকানগুলোতে। পুরো এলাকাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে একটি পাহাড়ী শহরের ছোঁয়া। বলা বাহুল্য যে, অধিকাংশ দোকানই চালাচ্ছে নারীরা। তরুণী থেকে শুরু করে বৃদ্ধা পর্যন্ত বসে রয়েছে দোকানে দোকানে। তারা পর্যটকদের পণ্য কেনার জন্য নানাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণেরও কসরত করছে।
দোকানগুলোর পাশে বিশাল পার্কিং এরিয়া। পার্কিংয়ে হাল ডিজাইনের অসংখ্য গাড়ি।
বিল আমাদেরকে নিয়ে একটি ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে চলে গেলো। সেখানে গাড়ি রেখে আমাদের নিয়ে গেল একটি লিফটের সামনে। বিশাল লিফট। আমরা আরো কয়েকজন পর্যটকের সাথে লিফটে নিচে নামতে শুরু করলাম। লিফটে কত নিচে নামলাম বুঝতে পারলাম না, তবে লিফট থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগুতেই আমি বিস্ময়ের মহাসাগরে ডুবতে শুরু করলাম।
আমাদের চোখের সামনে বিশাল একটি গুহার মুখ। বাইরে থেকে মনে হচ্ছিলো বিশাল এক অন্ধকার গুহার মুখ হা করে আছে। গুহার মুখের সামনে অনেকগুলো লোক বসে রয়েছে। তাদের কেউ খাটিয়ার মতো, কেউবা হাতলওয়ালা চেয়ারের মতো বিশেষ ধরনের এক একটি জিনিস নিয়ে বসে আছে। বিল বললো, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী টাইপের যেসব মানুষ হেঁটে গুহা দর্শন করতে পারে না, তাদেরকে এরা কাঁধে তুলে গুহা দেখিয়ে আনে। বিনিময়ে টাকা নেয়। দরদাম করেই এদের নিয়োগ দেয়া উচিত বলেও বিল মন্তব্য করলো। আমার দিকে তাকিয়ে বিল মুচকি হেসে বললো, চড়বেন নাকি এদের কাঁধে!
আমি হেসে সামনে পা বাড়ালাম। তবে ভয়ে ভয়ে। গুহার ভিতরে প্রবেশ করার পর আমার মনে হলো, একটা স্বপ্নপুরীর মধ্যে পা রেখেছি। গুহার শুরুতেই এক দীর্ঘ সিঁড়িপথ, ভেজা। দেয়ালের গা ঘেঁষে পানি পড়ছে টপটপ করে। মনে হচ্ছিলো পাহাড়ের হৃৎস্পন্দন শুনছি। গুহার অভ্যন্তরে বিরাজ করছিল এক ভিন্ন আবহ, শরীর মনে অন্যধরনের অনুভূতি খেলা করছিল। দেয়ালজুড়ে অসাধারণ সব চুনাপাথরের স্তম্ভ, বিশাল বিশাল খুঁটি ও ছাদ মিলে যেন প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া কোনো রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়েছি।
আলো–আঁধারির মাঝে পথ চলছিলাম। কোথাও কোথাও পথ পিচ্ছিল। পাহাড়ের গুহার ভিতরের পাথরের উপর পথ তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোথাও টাইলস বসানো হয়েছে। যতই এগুচ্ছিলাম, ততই ভালো লাগছিল। আমি শুধু আশ্চর্যই নয়, আমার বিস্ময়ের সীমাও যেনো প্রসারিত হচ্ছিলো। এই গুহা যেন কেবল একটি গুহা নয়, যেন এক স্থির, হাজার বছরের পুরনো শিল্পগাথা। একেকটা স্তম্ভ, একেকটা পাথর যেন কেউ নিপুণ হাতে গড়েছে বহু কষ্ট করে, হাজার বছর ধরে।
গুহার জন্য চীন বিখ্যাত। চীনের নানা অঞ্চলে প্রাকৃতিক, কৃত্রিম এবং অতিমানবীয় বহু গুহা রয়েছে। গতবার চীন সফরকালে জেজিয়াংয়ে অনেকগুলো গুহা দেখেছিলাম। কিন্তু এই গুহাটি একেবারেই অন্যরকম। অন্যরকম মানে এক ভয়ংকর বিস্ময়কর। কী নিপুন শিল্পই না গুহার পরতে পরতে। যতই সামনে যাচ্ছিলাম ততই বিস্মৃত হচ্ছিলাম। কী অপার বিস্ময় না আমার জন্য অপেক্ষা করছিল এখানে। শত সহস্র সিঁড়ি এবং টাইলস করা ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটছিলাম। কখনো সিঁড়ি ভেঙ্গে পাহাড়ে আবার কখনোবা সমান রাস্তায় হাঁটছিলাম।
কিছুটা এগুনোর পর আমাদের চোখের সামনে হেসে উঠলো বিশাল স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের পাথরের রাজত্ব। গতকাল দেখা স্টোন ফরেস্টের মতো নয়, তবে প্রায় একই রকমের পাথর। গুহার ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরগুলোকে মনে হচ্ছিলো প্রাকৃতিকভাবে গড়া প্রাসাদের স্তম্ভ। কোনোটা দেখতে বিশাল পাখার মতো, কোনোটা সরু সুচের মতো, আবার কোনোটা জ্বলন্ত মোমবাতির শিখার মতো উঁচু হয়ে আছে। হাজার বছর ধরে জমে ওঠা চুনাপাথরের এই গঠন প্রকৃতির কী অপরিসীম ধৈর্যের ফসল তা ভাবছিলাম। কী দারুণ এক শিল্পকর্ম। আবার কোন কোটি উপর থেকে ঝুলে রয়েছে। গুহার ছাদ থেকে বিশাল বিশাল পাথর ঝুলে রয়েছে। মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি মাথার উপর পড়বে! আলো আঁধারীর খেলা আমাদের সঙ্গী। যখন পাথরগুলোর উপর আলো খেলা করছিল, তখন মনে হচ্ছিলো স্বর্গলোকের অলিন্দে হাঁটছি!
চারপাশে ঠান্ডা হাওয়া, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, মৃদু জলধ্বনি, আর পাথরের গায়ে পড়া আলোকচ্ছটা মিলিয়ে জিউশিয়াং গুহার ভিতরের পরিবেশ একান্তই কাব্যিক, একান্তই অতিমানবিক।
একটি স্থানে এসে থমকে দাঁড়ালাম। বিল বললো যে, জায়গাটির নাম ‘দ্য ফিয়রি ফিল্ডস’– বা ‘পরীদের মাঠ’। এখানে গুহার ছাদ থেকে ঝুলে থাকা পাথরগুলোকে আলোর মাধ্যমে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, মনে হয় অসংখ্য পরী যেন নীরবে নিচে তাকিয়ে আছে, কিংবা গুহার ছাদে বসে তারা গান গাইছে। হঠাৎ তাকালে মনে হবে একদল পরী মাঠে নৃত্য করছে।
গুহার ভিতরে চমৎকার একটি হলরুমের মতো জায়গা, বিশাল। প্রায় ১৫ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এই ভূগর্ভস্থ হলটি একটি বিশাল পাথরের ছাদ দ্বারা আবৃত, যেখানে কোনো স্তম্ভ নেই। মাথার উপরে ছাদ! ছাদ মানে পাহাড়। বিস্ময়কর এই স্থানটির নাম নাকি ‘দ্য লায়ন হল’। গুহার এই অংশটা যেন এক বিশাল রাজসভা, ছাদ এত উঁচু যে দেখেই ভয় লাগছিলো। কোনকারণে এই ছাদ ধসে পড়লে পর্যটকদের অবস্থা যে কী হবে তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছিল। হলটির ছাদের অর্থাৎ পাহাড়ের তলদেশের পাথরের গঠন দেখে মনে হচ্ছিলো, বড়সড় একটি সিংহ মুখ খুলে শিকার ধরতে দাঁড়িয়ে আছে, এখনি গর্জে উঠবে। (চলবে) লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।